1121
Published on আগস্ট 13, 2022শেখ ফজিলাতুন নেছা, ডাক নাম রেণু। বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে রেণু নামেই অসংখ্যবার সম্বোধন করেছেন তাকে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শ্রেষ্ঠাঙ্গিনী, তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে সদাব্যস্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সংসারের প্রাণভোমরা এই বাঙালি গৃহবধূ ক্রমেই হয়ে উঠেছেন জাতিকে স্বস্তির ছায়াদানকারী আঁচলধারিণী। তিনি যেমন একহাতে নিজের সংসার সামলেছেন, তেমনি আরেক হাতে উড়িয়েছেন জয় বাংলার পতাকা। নীরবে অথচ কতো বলিষ্ঠভাবে দেশের মুক্তিসংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলোতে ভূমিকা রেখেছেন এই মহীয়সী নারী, তা আজো অনেকের অজানা। তবে নিরপেক্ষভাবে যদি আমরা তার জীবনালেখ্য পর্যালোচনা করি, তাহলে বলতেই হবে আধুনিক বিশ্বের একজন শক্তিশালী নারীত্বের প্রতীক তিনি।
শেখ ফজিলাতুন নেছার জীবনের প্রতিকূলতা, শ্রম, ত্যাগ, কর্মনিষ্ঠা, দেশপ্রেম; এমনকি নির্লোভ ও নিরহঙ্কারের মিশেলে তিনি যেনো বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্য প্রজ্ঞাময় ব্যক্তিত্ব, অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। যে হাতে খড়ির চুলায় রান্না করে পরিবার ও অতিথিদের খাদ্য পরিবেশন করতেন, সেই হাতেই আবার ধানমন্ডির নির্মিয়মান ভবনে পানি দিতেন, সেই হাতেই আবার দেশের সার্বিক পরিস্থিতি জানিয়ে জেলবন্দি বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়মিত চিরকুট লিখতেন। প্রিয়তমর বিরহে যে চোখে তিনি অশ্রু ঝরাতেন, সহজিয়া সারল্যে দেখে রাখতেন সন্তান ও স্বজনদের, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ঠিক সেই চোখের কঠিন চাহনিতেই তিনি বড় বড় নেতাদের সঙ্গে বাতচিৎ করতেন গণমানুষের স্বার্থে। কোমলে-কঠিনে-সারল্যে এক অনুপম অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব তিনি, যিনি রেণু থেকে বেগম মুজিব এবং পরবর্তীতে নিজগুণে বঙ্গমাতা হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু জেলে যাওয়ার পর বঙ্গমাতার দৃঢ়তায় টিকে যায় ঐতিহাসিক 'ছয় দফা':
১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ 'ছয় দফা' দাবি ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপরেই স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামরিক সক্ষমতা অর্জনের দাবিতে দেশজুড়ে একাট্টা হতে থাকে বাঙালি জাতি। ফলে ছাত্রছাত্রীর পাশাপাশি এবার কৃষক-শ্রমিকরাও নেমে আসে রাজপথে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সর্বোস্তরের জনগণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিসংগ্রামে সামিল হয়। ফলে শঙ্কিত হয় পাকিস্তানি হানাদাররা। ১৯৬৬ সালের ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে দীর্ঘ মেয়াদে জেলে ঢোকায় তারা। দলীয় প্রধানের ঘোষিত দাবি বাস্তবায়নে ৭ জুন হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ।
৭ জুনের কর্মসূচি বানচালের জন্য অস্ত্র প্রয়োগের ঘোষণা দেয় স্বৈরাচার প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়ার জান্তাবাহিনী। নজরবন্দি হয়ে যান আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। ফলে তুমুল প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও এই কর্মসূচিকে সফল করতে ছদ্মবেশে বাড়ি থেকে বের হয়ে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করতেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা। ছদ্মবেশে বের হয়ে ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথরেখা তৈরি করেন তিনি। ফলে পাকিস্তানিদের গুলি উপেক্ষা করে ৭ জুন ঢাকা নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশে ছয় দফার সমর্থনে রাজপথে নেমে আসে মানুষ।
এরপর আরো তীব্র হয়ে ওঠে ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবি। ফলে পাকিস্তানিদের এজেন্ট হিসেবে এদেশেরই কিছু মানুষ ছয় দফাকে নস্যাৎ করার অপচেষ্টা চালায়। 'ছয় দফা'র বিপরীতে 'আট দফা' ঘোষণা করে তারা। এমনকি দলের অনেক নেতাও তখন আট দফা মেনে নেওয়ার প্রস্তাব দেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় এ নিয়ে তিনদিন ধরে দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হয়। সেসময় অনেক নেতা বঙ্গমাতাকে 'ছয় দফা' ছেড়ে 'আট দফা'র পক্ষে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু 'ছয় দফা' থেকে তাকে সরাতে না পেরে বিরক্ত হয়ে নেতারা বলেই ফেললেন, 'আপনি ভাবী বুঝতে পারছেন না'। তখন বঙ্গমাতা দৃঢ়ভাবে বলেছেন, 'আমি তো ভাই বেশি লেখাপড়া জানি না। খালি এই টুকুই বুঝি- ছয় দফাই হচ্ছে বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ। এটা উনি (বঙ্গবন্ধু) বলে গেছেন, এটাই আমি মানি। এর বাইরে আমি কিছু জানি না।' সেসময় বঙ্গমাতা স্পষ্ট করে বলেছেন যে- ছয় দফার জন্য বঙ্গবন্ধু জেলে আছেন, তার অবর্তমানে এই ছয় দফার একটা দাঁড়ি-কমাও বদল করা যাবে না।
বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার দূরদর্শিতা কারণেই পথ খুলে যায় স্বাধীনতার:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ছয় দফা রক্ষা পেয়েছে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার দৃঢ়তার কারণে। জেলগেটে নিয়মিত বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে তার নির্দেশনা এনে ছাত্রনেতাদের জানিয়ে দিতেন তিনি। একারণে ছয় দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু দীর্ঘদিন জেলে থাকলেও এই দাবিই হয়ে ওঠে বাঙালির ম্যাগনাকার্টা। 'আট দফা'র ষড়যন্ত্র থেকে 'ছয় দফা'কে রক্ষা করে বাঙালি জাতির মুক্তির পথ নিরবচ্ছিন্ন রাখার ক্ষেত্রে যে গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন বঙ্গমাতা; তা অব্যাহত ছিল পরবর্তীতেও। ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে জেলে বন্দি বঙ্গবন্ধুকে ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি সেনানিবাসে নিয়ে যায় পাকিস্তানি জান্তারা। ছয় দফার গণজাগরণ দমাতে ব্যর্থ হয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে এবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অপচেষ্টা করে তারা।
এসময় শীর্ষ ছাত্রনেতারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে গিয়ে নিয়মিত দেখা করতেন বঙ্গমাতার সঙ্গে। তাদের স্মৃতিচারণামূলক সাক্ষাৎকার ও রাজনীতি গবেষকদের লেখা গ্রন্থগুলো থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এই দীর্ঘ সময় ছাত্রনেতাদের আন্দোলন সংগ্রামের টাকাও দিতেন বঙ্গমাতা। শীর্ষ ছাত্রনেতারা নিয়মিত বঙ্গমাতার কাছ থেকে এই অর্থ এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা সংগ্রহ করতেন। এরপর সেই অনুসারে আন্দোলন কর্মসূচি পরিচালনা করতেন তারা। দেশ ও জাতির মুক্তির জন্য ছাত্রনেতাদের আন্দোলনের ব্যানার-পোস্টারের খরচ মেটাতে নিজের গহনা বিক্রি করে এবং ধার করে এসব অর্থ দিয়েছেন বঙ্গমাতা। যার ফলে ছাত্র আন্দোলন নস্যাৎ করার পাকিস্তানিদের পরিকল্পনা সফল হতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে জেলে থাকলেও বঙ্গমাতার মাধ্যমে নিয়মিত ছাত্রদের সাথে আত্মিক যোগাযোগ গড়ে ওঠে তার।
এজন্য আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরুর কথা শুনেই ফুঁসে ওঠে দেশবাসী। ১৯৬৯ সালের শুরুতেই ছয় দফার সমর্থনে ১১ দফা ঘোষণা করে ছাত্রসমাজ। 'জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো' স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজপথ। স্বৈরাচার আইয়ুব খানের গদি টলায়মান হয়ে ওঠে। নিজেকে রক্ষার জন্য আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তার সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব দেয় আইয়ুব খান। এতে রাজি হয় আওয়ামী লীগেও অনেক রাজনীতিবিদ। তারাও বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি নেওয়ার জন্য পরামর্শ দিতে থাকেন। তবে এই খবর পাওয়া মাত্র বিরোধিতা করেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা। এসময় পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের জেরার মুখেও পড়েন তিনি। তবে শত প্রতিকূলতা ও চাপের কাছেও মাথা নত করেননি বঙ্গবন্ধুর এই যোগ্য জীবনসঙ্গী।
৬৯-এর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্যারোলে শেখ মুজিবের মুক্তির প্রস্তাবের খবর শুনে, বঙ্গমাতা তার কন্যা শেখ হাসিনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কাছে সতর্কতামূলক বার্তা পাঠান। তিনি বঙ্গবন্ধুকে খবর পাঠান যে, দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ আছে। মামলা তুলে বঙ্গবন্ধুসহ বন্দি ৩৫ জনের সবাইকে মুক্তি দিলেই গোলটেবিল বৈঠক হতে পারে, নাহলে একা প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বৈঠকে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তার এই বার্তা পেয়ে দেশের গণমানুষের মনোভাব বুঝতে পারেন বঙ্গবন্ধু। ফলে তিনি প্যারোল নিতে অস্বীকৃতি জানান।
এসময় বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি নিতে রাজি করানোর জন্য বেগম মুজিবকে আহ্বান জানানঅনেক রাজনৈতিক নেতা। তারা ভয় দেখালেন যে, প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইয়ুব খানের সাথে বৈঠক না করলে শেখ মুজিবকে হত্যা করবে সেনাবাহিনী। কিন্তু এই ফাঁদ বুঝতে পারেন বঙ্গমাতা। তাই অবিচলভাবে এই দেশপ্রেমিক নারী বলেন, 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের ৩৫ জনের মধ্যে ৩৪ জনই বিবাহিত, আমি তো একা না, মামলা প্রমাণিত হলে ৩৪ জন বিধবা হবে। আমার একার চিন্তা করলে হবে না। কিন্তু মামলা উইথড্র না করলে উনি লাহোরের সম্মেলনে যাবেন না। এটাই শেষ কথা।'
ঊনসত্তরের অগ্নিগর্ভ দিনগুলোতে বেগম মুজিবের এই সময়োচিত সাহসী সিদ্ধান্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ, প্যারোলে মুক্তি না নেওয়ায় গণআন্দোলন আরো তীব্র হয়ে ওঠে। ছাত্র-জনতার চাপে স্বৈরাচার আইয়ুব সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করে আপামর জনতা। এরপর ২৫ মার্চ পদত্যাগে বাধ্য হয় জেনারেল আইয়ুব খান। অথচ নেতাদের পরামর্শে প্যারোলে মুক্তি নিলে এই গণআন্দোলন নসাৎ হয়ে যেত এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হতো বাঙালির মুক্তির আন্দোলন।
কারণ, প্যারোল না নেওয়ার কারণেই আন্দোলন আরো তীব্র হয় এবং বঙ্গবন্ধু জেল থেকে বিজয়ীর বেশে মুক্ত মানুষ হিসেবে বের হয়ে অবাধ নির্বাচনের দাবি জানান। পাকিস্তানি সরকার বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। সেই নির্বাচনে জিতে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার বৈধ দাবিদার হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। ফলে স্বাধীন বাঙালি জাতির জনক হিসেবে ঘোষণা করা হয় তাকে। এরপর সর্বোৎকৃষ্ট সময়ে নির্বাচনে বিজয়ী নেতা হিসেবে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এজন্যই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কেউ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলতে পারেনি। একারণে পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধু বলছেন, রেণু (ফজিলাতুন নেছা) না থাকলে আমি বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতে পারতাম না। প্রকৃতপক্ষে, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা না থাকলে বাঙালির অগ্নিঝরা আন্দোলন, নির্বাচন ও মুক্তিসংগ্রামের গতিপথ হয়তো এতো দ্রুত স্বাধীনতায় পৌঁছাতো না। তার সিদ্ধান্ত ও বিচক্ষণতার কারণেই টলায়মান সময়গুলোতে বঙ্গবন্ধু গণমানুষের মন পাঠ করতে সমর্থ হয়েছেন।
৭ মার্চ ঐতিহাসিক জনসভার আগে বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গমাতার পরামর্শ:
১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিজয়ের পর থেকেই ষড়যন্ত্র শুরু করে পাকিস্তানি হানাদাররা। বৈঠকের নামে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে তারা। এরমধ্যেই ১৯৭১ সালের ১ মার্চ হঠাৎ ঘোষণায় স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান জানায়, ৩ মার্চের অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন বাতিল। সঙ্গে সঙ্গে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা। হরতাল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। এরপর তিনি জানান, ৭ মার্চ জাতিরকে চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দেবেন তিনি।
রক্তঝরা মার্চের ৭ম দিন আসতে আসতে সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকে সাত কোটি বাঙালি। অবশেষে ৭ মার্চ বিকালে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। এই ভাষণটিকে পরবর্তীতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণের তালিকায় অন্তভুর্ক্ত করেছে জাতিসংঘ। এই ভাষণের কারণেই বিশ্বব্যাপী 'পোয়েট অব পলিটিক্স' হিসেবে অভিহিত করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। এই ভাষণ থেকেই চূড়ান্ত যুদ্ধের সার্বিক দিক নির্দেশনা পেয়েছিল বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের পরেই প্রতিটি এলাকায় সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি ও মহড়া শুরু হয় দেশে। এমনকি দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধকালেও এই ভাষণ শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন আপামর বাঙালি।
৭ মার্চের ভাষণ ছিল বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা। তাই সেদিন সকাল থেকেই লোকে লোকারণ্য হয় ঢাকা শহর। এতদিকে সেনানিবাস থেকে গোলাভর্তি কামান তাক করা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে। পাকিস্তানি গোয়েন্দারা খবর পেয়েছিল, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে সরাসরি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দিতে পারেন। তাই তারা আকাশে বোমারু বিমান নিয়ে চক্কর দিতে থাকে। বার্তা পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়, তেমন কিছু হলে সেই সামবেশে কামান ও বোমা মেরে লাখ লাখ মানুষকে রক্ত ও মাংসপিণ্ডে পরিণত করা হবে। আবার অন্যদিকে চূড়ান্ত স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার জন্যও অস্থির হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু লাখ লাখ মানুষকে হত্যার শিকার হতে দিতে চাননি তিনি, তাই ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকের ফাঁকে ফাঁকে অস্থিরতায় পায়রানি করতে থাকেন তিনি।
এমন সময় বঙ্গবন্ধুকে একাকী ঘরে ডেকে নেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা। কিছুক্ষণ একাকী শান্তভাবে বিশ্রাম করতে বলেন। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি বলেন, ‘দেখো, তুমি সারাটা জীবন এদেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছ। দেশের মানুষের জন্য কী করতে হবে তা তুমি সকলের চেয়ে ভালো জানো, আজকে যে মানুষ এসেছে, তারা তোমার কথাই শুনতে এসেছে। তোমার কারো কথা শোনার প্রয়োজন নেই। তোমার মনে যে কথা আছে তুমি সেই কথাই বলবে। আর সেই কথাই সঠিক কথা হবে। অন্য কারও কথায় তুমি কান দেবে না।' বঙ্গমাতা যখন বঙ্গবন্ধুকে এসব বলেন শান্ত করছিলেন, তখন পিতা মুজিবের মাথার কাছে বসে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনা।
সেই দিনের স্মৃতিচারণা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনা লীখেছেন, 'আব্বা কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলেন। সভায় যাওয়ার সময় আগত। তিনি প্রস্তুত হয়ে রওনা হলেন। আমরাও অন্য একটা গাড়িতে মাঠে পৌঁছালাম।...... ''
৭ মার্চের সেই অলিখিত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির চূড়ান্ত রণকৌশল ঘোষণা করেন। দীর্ঘ রণপ্রস্তুতির নির্দেশনা ঘোষণার পর সরাসরি উচ্চারণ করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের নির্দেশনা অনুসারেই সুশৃঙ্খলভাবে সংগঠিত হয় দেশবাসী। প্রস্তুত হতে শুরু করে সবাই সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য। যার ফলশ্রুতিতেই আমরা মুক্তিযুদ্ধে মহান বিজয় অর্জন করে স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি।
'অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়া চীন' গ্রন্থের নেপথ্য কথা:
হাজার বছরের দাসত্বের শৃঙ্খরে আবদ্ধ বাঙালি জাতির স্থায়ী মুক্তির জন্যই নিবেদিত ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবন। এজন্য নিয়মিত পাকিস্তানি জান্তাদের রোষানলে পড়তে হয়েছে তাকে। ৫৫ বছরের জীবনের মধ্যে প্রায় ১৩ বছর থাকতে হয়েছে জেলে। জেলে থাকা অবস্থাতেও তিনি স্ত্রী ফজিলাতুন নেছার মাধ্যমে নিয়মিত রাজনৈতিক নির্দেশনা পাঠাতেন নেতাকর্মীদের কাছে। এমনই এক সময় জেলগেটে দেখা করতে গিয়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে ধাবমান রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতি লেখার জন্য বঙ্গবন্ধুকে কয়েকটি খাতা দিয়ে আসেন বেগম ফজিলাতুন নেছা। জেলখানায় বসে সেই খাতাতেই জীবনস্মৃতি লেখেন বঙ্গবন্ধু। সেই সব স্মৃতিলিখন থেকেই পরবর্তীতে আমরা পেয়েছি 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী', 'কারাগারের রোজনামচা', 'আমার দেখা নয়া চীন' নামক গ্রন্থগুলি; যা আজ বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য ও অনন্য দলিল।
পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছার কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার উদ্যোগে গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয় এসব গ্রন্থ। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে বঙ্গবন্ধু নিজেই তার জীবনী লেখার বিষয়ে স্ত্রী রেণু (ফজিলাতুন নেছা)-এর কথা লিখেছেন। কীভাবে তার প্রিয় রেণু তাকে কয়েকটি খাতা কিনে জেলগেটে দিয়ে যান, সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ''আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বললো- 'বসেই তো আছ। লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।..... রেণু আরো একদিন আমাকে লিখতে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।' মূলত এরপরেই লিখতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধু।
পরববর্তীতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার পর তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। লুটপাট চালিয়ে বন্ধ করে রাখে ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি। ধানমন্ডির তৎকালীন ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে বন্দি করা হয় বঙ্গমাতাসহ বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই পাকিস্তানিরা ঠিক করে, বহির্বিশ্বের কাছে সবকিছু স্বাভাবিক দেখাতে হবে, তাই তারা স্কুল কলেজ খোলার নির্দেশ দেয়। এমনকি বঙ্গবন্ধুর শিশু সন্তানদেরও স্কুলে পাঠাতে বলে তারা। এসময় ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে সবার বই আনার কথা বলেন শেখ হাসিনা। তখন বুদ্ধি খাটিয়ে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা তার বড় কন্যা শেখ হাসিনাকে বলেন যে, 'একবার যেতে পারলে আর কিছু হোক না হোক তোর আব্বার লেখা খাতাগুলো যেভাবে পারিস নিয়ে আসিস।' এরপর বঙ্গমাতার নির্দেশনা অনুসারে ড্রেসিং রুমের আলমারির ওপর থেকে খাতাগুলো নিয়ে আসেন শেখ হাসিনা। পরে সেসব খাতা থেকেই পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের স্মৃৃতি তথা বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের মূল্যবাদ দলিল। বঙ্গবন্ধুকন্যার উদ্যোগে গ্রন্থ আকারে প্রকাশিক হয় 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী', 'কারাগারের রোজনামনা' ও 'আমার দেখা নয়া চীন' নামের তিনটি গ্রন্থ।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার সহজিয়া জীবন:
দেশভাগের আগেই কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশভাগের আগে অখণ্ড বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ ও স্নেহধন্য ছাত্রনেতা হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আইন বিভাগে ভর্তি হন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানিদের আগ্রাসন থেকে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য ভাষা আন্দোলনের পটভূমি রচিত হয় তার হাত ধরেই। ফলে জান্তাদের রোষানলে পড়ে জেল-জুলুমের শিকার হন তিনি। কিন্তু বাংলার গণমানুষের কাছে ততদিনে আস্থাভাজন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান তিনি।
১৯৫৪ সালে যুক্টফ্রন্টের নির্বাচন আওয়ামী লীগের মুখপাত্রে পরিণত করে শেখ মুজিবুর রহমানকে। ফলে তরুণ বয়সেই মন্ত্রিত্ব লাভ করেন তিনি, কিন্ত পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্র করে সেই মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। এরপর ১৯৫৬ সালেও আওয়ামী লীগ যখন আবার প্রাদেশিক সরকার গঠন করে, তখনও মন্ত্রিস্ব লাভ করেন বঙ্গবন্ধু। অন্যরা যখন দলের পদ ছেড়ে দিয়ে মন্ত্রিত্ব রাখতে সচেষ্ট হন, তখন দলের সাধারণ সম্পাদক পদে থেকে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন তিনি। দুইবার মন্ত্রী হওয়ার পরেও নিজ পরিবারকে নিয়ে নিরাপদে মাথা গোঁজার মতো একটা বাসস্থান ছিল না বঙ্গবন্ধুর। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে আবারো জেলে নেয় স্বৈরাচার আইয়ুব সরকার। তখন সন্তানদের নিয়ে থাকার জন্য যে বাড়িই ভাড়া নেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেচ্ছা, সেখান থেকেই তাদের কৌশলে বের করে দেয় পাকিস্তানি জান্তাদের গোয়েন্দারা। কোনো বাড়িঅলাও বাড়ি ভাড়া দিতে ভয় পেত।
তাই ১৯৬০ সালে বঙ্গবন্ধু জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বঙ্গমাতার অনুরোধে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন থেকে ঋণ নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এমনকি খরচ বাঁচানোর জন্য নির্মাণাধীন বাড়ির ইটে নিজেই পানি দিতেন তৎকালীন বাংলার সর্বোচ্চ নেতা এবং দুই বারের মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেছা।
১৯৬১ সালে ১ অক্টোবর থেকে অর্ধনির্মিত বাড়িতেই থাকতে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর পরিবার। একতলা বাড়িটিতে তখন বেডরুম ছিল মাত্র দুটো। একরুমে থাকতেন বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব। অন্য রুমে থাকতেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পাশে ছিল আরেকটি রুম, সেটি রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেই রুমেরই একপাশে থাকতেন বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল। ধানমন্ডির ওই এলাকা তখন এতো লোকারণ্য ছিল না। তাখন মাত্র দুটি বাড়ি ছিল সেখানে, রাতে শেয়াল ডাকতো, এমন ছিল এলাকাটি। এরকম একটি জায়গাতেও রুম ভাগাভাগি করে থাকতে হয়েছে তৎকালীন সময়ে দুইবারের মন্ত্রী ও পূর্ব বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সন্তানদের। সেই বাড়ি নির্মাণের ঋণ বঙ্গবন্ধু পরিবার শোধ করেছে ২১ বছর ধরে।
বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের নীরব অধ্যায়ের নাম শেখ ফজিলাতুন নেছা:
বাঙালি জাতিকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনে ৪৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। ৫৫ বছরের জীবনে প্রায় এক-চতুর্থাংশ সময় কারাগারেই কাটাতে হয়েছে তাকে। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু ১৮ বার জেলে গেছেন, প্রায় ১৩ বছর বন্দি ছিলেন কারাগারে। ততদিনে পাঁচ সন্তানের জনক তিনি। কিন্তু দেশের কাজে মন দেওয়ার কারণে সন্তানদের বেড়ে ওঠার সময়টায় সেভাবে সময় দিতে পারেননি। পরিবার পরিচালনা থেকে শুরু করে সন্তানদের মানুষ করে তোলার মূল দায়িত্বটি তাই পালন করেছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা।
এমনকি নিজের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া অর্থ দিয়েও সাহায্য করেছেন বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু যখনই বাড়ি থেকে আন্দোলন সংগ্রামের জন্য বের হয়েছেন, তখন নিজের সঞ্চয়টুকু বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিয়েছেন তিনি। অথচ বঙ্গবন্ধু তখনও বঙ্গবন্ধু হননি, পুরো যাত্রাই ছিল অনিশ্চিতে ভরা। যুকব শেখ মুজিব তার তরুণী স্ত্রীর কাছ থেকে যে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা পেয়েছেন, সেকারণেই তিনি একটি জাতির মুক্তি আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ হিসেবে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন।
দেশভাগের আগে তরুণ শেখ মুজিব কলকাতার নামকরা ছাত্রনেতা এবং অখণ্ড বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহধন্য ছিলেন। সেসময় ১৯৪৬ সালে বিহারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগে।শুধু সরকারি লোকদের ওপর আস্থা রাখতে না পেরে প্রিয় শিষ্য মুজিবকে ডাকেন সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু ফজিলাতুন নেছা তখন বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। তাই বিহারে যাওয়ার ব্যাপারে স্ত্রীর অনুমতি আছে কিনা তা বঙ্গবন্ধুকে জানতে বলেন সোহরাওয়ার্দী। চিঠির জবাবে বঙ্গবন্ধুকে তার প্রিয় রেণু লিখেছিলেন, 'আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সব চাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লার উপর আমার ভার ছেড়ে দেন।'
কয়েকদিন পর এই চিঠির কথা সোহরাওয়ার্দীকে জানান তরুণ শেখ মুজিব। তা জেনে সোহরাওয়ার্দীর মতো মানুষ পর্যন্ত ফজিলাতুন নেছা (রেণু)-র প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, 'Mujib, she is a very precious gift to you from God. Don't neglect her, please.
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানিরা যখন বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করলো; তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি রচনা করেন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠা করেন ছাত্রলীগের মতো প্রগতিশীর সংগঠন। ফলে ভাষা আন্দোলন দমানোর জন্য তাকে জেলে নেয় পাকিস্তানিরা। জেলে থাকা অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক হন তিনি। এরপর তার নেতৃত্বেই সংগঠিত হয় বাংলা ভাষার আন্দোলন। ফলে দীর্ঘমেয়াদে জেলে থাকতে হয় তাকে। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ জেল জীবনে নিয়মিত জেলগেটে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে রাজনৈতিক নির্দেশনা এনে নেতাকর্মীদের সংগঠিত রাখার গুরুভারও পালন করেছেন তার স্ত্রী ফজিলাতুন নেছা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে সর্বশেষ গ্রেফতার হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে বন্দি হিসেবে নেওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এরপর ঢাকায় পরিবারসহ জান্তা বাহিনীর প্রহরায় গৃহবন্দি অবস্থায় ছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। শুধু মুক্তিযুদ্ধের এই বন্দি সময় বাদে, বঙ্গবন্ধু জীবনে যতোবার জেলে গেছেন, সেখানেই নিয়মিত সেই জেলগেটে হাজির হয়েছেন বেগম ফজিলাতুন নেছা।
স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশবিরোধী ঘাতকরা যখন রাতের আঁধারে হামলে পড়ে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেই কালরাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়ির সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুকে যখন নরপিশাচরা গুলি করে হত্যা করে, তখন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা উচ্চ শিরে দাঁড়ান ঘাতকদের সামনে। দ্বিধাহীন কণ্ঠে তিনি বলেন, 'তাকে মেরেছো, আমাকেও মেরে ফেলো।'
শৈশবে যে মুজিবের সঙ্গে জীবনের বন্ধন রচনা হয়েছিল তার, পরিণত বয়সে সেই মুজিবকে ঘাতকদের গুলিতে প্রাণ হারাতে দেখে নিজেও আর বেঁচে থাকার কোনো প্রয়াস করেননি। তার সহযোগিতা যেমন শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করেছে, তেমনি তার সাহস ও শ্রমের কারণেই এগিয়ে গেছে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের টলায়মান দিনগুলি। অথচ এই মহীয়সী নারী কখনোই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে চাননি, সবসময় আড়ালে থেকেই দেশ ও জাতির জন্য কাজ করেছেন। নিজ পরিবারকে যেভাবে তিনি সামলেছেন, তেমনি দলীয় নেতাকর্মী এবং দেশের মানুষকেও তার স্নেহের আঁচলে ঠাঁই দিয়েছেন। এমনকি বাঙালি নারীমুক্তির আইকনিক, অদম্য ও অগ্রব্যক্তিত্ব তিনি।