2599
Published on আগস্ট 14, 2021মোঃ ফুয়াদ হাসান:
১৫ই আগস্ট ১৯৭৫, প্রথম প্রহরে সেনাবাহিনীর কিছু বিপদগামী সদস্যের হাতে সপরিবারে নির্মম ও ন্যক্কারজনক ভাবে নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু। সেদিনই দুপুর বেলাতে (স্বঘোষিত) প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে খন্দকার মোস্তাক নিজেকে। ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, অবৈধ্য ভাবে ক্ষমতার ভোগ দখলকারী খন্দকার মোস্তাক পরিবার সহ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত খুনীদের বাচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জাড়ি করে। The Bangladesh gazette; published by Authority: লেখা এই কালো অধ্যাদেশটিতে সাক্ষর করে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম খলনায়ক খন্দকার মোস্তাক।
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটিকে দুইটি অংশে বিভক্ত করে স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোস্তাক।
এর প্রথম অংশে বলা আছেঃ ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেনো এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট সহ কোন আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনি প্রক্রিয়াতে যাওয়া যাবে না।
দ্বিতীয় অংশে বলা আছেঃ রাষ্ট্রপতি উল্লেখিত ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যায়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোন আদালতে মামলা অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। এমনকি খন্দকার মোস্তাক বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সূর্য সন্তান আখ্যায়িত করে।
এত ষড়যন্ত্র করেও খন্দকার মোস্তাক তার ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের ৫ই নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাত্র ৮৩ দিনের মাথায় সেনা কর্মকর্তা খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান মধ্যে দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন খন্দকার মোস্তাক, তার পরের দিন তিনি গ্রেফতার হন।
ক্ষমতার পালা বদল পাল্টা পালা বদলের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশের ইতিহাসের আরও এক বিতর্কিত চরিত্র মেজর জিয়া।
১৮ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭৯, সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে হ্যাঁ না মৌখিক ব্যলটের দুই তৃতীয়াংশ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মেজর জিয়া। এই দফায় তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা; ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ও চার বছরের সকল ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধ্যতা দান করে।
বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো তদন্ত কমিটি গঠন করে খন্দকার মোস্তাক। সেটিও বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিভিন্ন দেশের চাকুরী প্রদান করে পুরস্কৃত করে মেজর জিয়া।
৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট ও ৩শেরা নভেম্বরে ঘটে যাওয়া বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডকে বিচারের আওতায় আনতে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর ছেলে মোঃ সেলিম এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম লন্ডনের হাউস অফ কমেন্সে আবেদন করেন। দেশ ও বিদেশের জনসভাগুলিতে এই আবেদন বিপুল ভাবে সমর্থিত হয়। এর প্রেক্ষিতে স্যার থমাস ও কিউসির নেতৃত্বে কমিশন গঠনের উদৌগ নেয় লন্ডনের হাউস অফ কমেন্স।
১৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৮০, স্যার থমাসের নেতৃত্বে হাউস অব কমন্সে এই কমিশনের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেফ্রী থমাস ও সেখানকার সলিসিটর এব্র রোজ এই কমিশনের সভাতে যোগ দেন। কমিশনের সভা থেকে ৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ও তেশেরা নভেম্বরে ঘটে যাওয়া সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার সাথে যে সকল সেনাকর্মকর্তা নেপথ্যে জড়িত রয়েছে তাদের সনাক্ত করার কথা বলা হয় এবং কমিশনের আপাত দৃষ্টিতে কর্নেল রশিদ, ফারুক মেজর ডালিমকে প্রকাশ্য দায়ী হিসেবে চিহ্নিত ও অভিযুক্ত করা হয়।
৩০শে আগস্ট ১৯৭৬, লন্ডন সানডে টাইমসে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কর্নেল ফারুক ১৫ই আগস্টের বঙ্গবন্ধু ও ৩শেরা নভেম্বরের জেলহত্যা কান্ডের সাথে তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে। এই সাক্ষাৎকারটি আমলে নিয়ে হাউস অফ কমেন্সে গঠিত কমিশনের সদস্য ম্যাক ব্রাইডের নেতৃত্বে ১৯৭৭ সালের এপ্রিলের দিকে এম্যনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মিশন বাংলাদেশ পরিদর্শন করে। মিশনের সদস্যরা রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করেন বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা কান্ডের বিষয়ে আলোচনার জন্য। তখন রাষ্ট্রপতির তরফ থেকে জানানো হয় আইনকে তার নিজেস্ব গতিতে চলতে দেওয়া হবে।
অথচ দেখা যায় যারা বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার সাথে জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় না নিয়ে বরং বিভিন্ন দেশে চলে যাওয়ার সুযোগ তৈরী করে দেওয়া হচ্ছে দূতাবাসে চাকুরীর সুবিধা দিয়ে। এবং বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা কান্ডের বিচার নিয়ে পক্ষপাতমূলক আচরণ করা হচ্ছে। এই সকল বিষয়ের বাস্তবতা উপলব্ধি করে এবং এর প্রেক্ষিতে হাউস অফ কমেন্সে গঠিত কমিশন সিদ্ধান্ত নেয় আইন ও বিচার প্রক্রিয়া স্বীয় গতিতে চলার পথে কি কি অন্তরায় রয়েছে তা সরজমিন তদন্তের উদ্দেশ্যে কমিশনের একজন সদস্যের ঢাকা সফর অাবশ্যক। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত হয়, ১৩ই জানুয়ারী ১৯৮১ কমিশন সদস্য থমাস ও কিউসি একজন সাহায্যকারী নিয়ে সরজমিন তদন্তে ঢাকা সফর করবে। এই লক্ষে ঢাকা গমনের ভিসা লাভের জন্য তদন্ত কমিশন সচিব ও সলসিটর এব্রো রোজের মাধ্যমে ভিসা আবেদন করা হয়। বাংলাদেশ হাইকমিশন মারফত জানানো হয় যথা সময়েই ভিসা প্রদান করা হবে।
উল্লেখিত তারিখের সকালে বৃটিশ এয়ারওয়েজের সন্ধার ফ্লাইটে সুযোগ প্রদানের অনুরোধ জানালে লন্ডনের বাংলাদেশী হাইকমিশন থেকে জানানো হয় পাসপোর্ট ও ভিসা ঐদিন বিকালে ফেরত দেওয়া হবে।সেগুলা কমিশন থেকে বিকালে ফেরত চাওয়া হলে কন্স্যুলার বিভাগ বন্ধ বলে জানানো হয়। পরবর্তী সময়ে লন্ডনস্থ বাংলাদেশী হাইকমিশন সূত্র ঢাকার ভিসার বিষয় নাকচ করে দেই।
ভিসা না দেওয়ার ঘটনাতে হাউস অফ কমেন্সের গঠিত কমিশন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যেঃ বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা কান্ডের বিচার কার্যক্রম ও প্রক্রিয়াকে তার নিজেস্ব গতিতে চলতে দেওয়া হয়নি। মেজর জিয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার খুনীদের দেশ ছেড়ে নিরাপদে চলে যাওয়ার সুযোগ তৈরী একই সাথে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরীর ব্যবস্থা করেছে। মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের বিচারকার্য স্থগিত করেছেন। এই সকল বিষয় থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায় যে মেজর জিয়াই ছিলো বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পেছনের নেপথ্য ও মূল কারিগর।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হয়েছে কিন্তু এই পাপ মোচন করে কখনো কি আর দায়মুক্ত হতে পারবো আমরা? আমরা আমাদের জাতির পিতাকে রক্ষা করতে পারিনি, আমাদের স্বজাতি গোত্রের বিপদগামীরা আমাদের জাতির পিতার হত্যাকারী; এটা পুরা জাতির লজ্জা!
ক্ষমা করো পিতা মুজিবঃ শোক হোক শক্তি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখকঃ উপ আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ