224
Published on নভেম্বর 17, 2025আমার বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়গুলো এসেছে একটি সাজানো, ভুয়া ট্রাইব্যুনাল থেকে—যা গঠন করেছে এবং পরিচালনা করছে এমন একটি অনির্বাচিত সরকার, যার কোনো গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট নেই। এই রায়গুলো পক্ষপাতদুষ্ট, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মৃত্যুদণ্ডের রায় স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে থাকা চরমপন্থী শক্তিগুলোর লক্ষ্য হলো আমাকে বাংলাদেশের শেষ নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া এবং আওয়ামী লীগকে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিশ্চিহ্ন করা।
ড. মুহাম্মদ ইউনুসের বিশৃঙ্খল, সহিংস ও সমাজবিরোধী শাসনের অধীনে যারা আজ কষ্ট পাচ্ছেন, সেই লক্ষ লক্ষ মানুষকে এই সাজানো নাটকের মাধ্যমে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না। তারা স্পষ্টভাবে দেখেছেন—এতদিন যে কথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) চলছে, তার উদ্দেশ্য কখনো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা বা ২০২৫ সালের জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলীর প্রকৃত অনুসন্ধান করা ছিল না। এর আসল উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগকে বলির পাঠা বানানো এবং ড. ইউনুস সরকার ও তার মন্ত্রীদের ব্যর্থতা থেকে বিশ্বের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া।
তার শাসনে রাষ্ট্রসেবা ভেঙে পড়েছে। দেশের অপরাধপ্রবণ রাস্তাগুলো থেকে পুলিশ উধাও, ন্যায়বিচার বিপর্যস্ত; আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ওপর হামলা হয় কিন্তু কোনো শাস্তি নেই। হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত, নারীর অধিকার দমিত। প্রশাসনের ভেতরে হিজবুত-তাহরীরসহ ইসলামি উগ্রপন্থীরা বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায়। সাংবাদিকদের কারাবন্দি করা হচ্ছে, ভয় দেখানো হচ্ছে, অর্থনীতি থমকে গেছে, আর ইউনুস নির্বাচন পেছানোর পর দেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল—আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিষিদ্ধ করেছে।
এসবই প্রতিষ্ঠিত সত্য—আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, এনজিও এবং আইএমএফ-এর মতো নিরপেক্ষ সংস্থা দ্বারা যাচাই করা। আমি ইউনুসের অবশিষ্ট বিদেশি সমর্থকদের মনে করিয়ে দিতে চাই—বাংলাদেশে একজন মানুষও তাকে ভোট দেয়নি, ভোট দেওয়ার সুযোগও পায়নি। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জনগণের; আগামী বছরের নির্বাচন অবশ্যই অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে।
আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই—আইসিটি আমাকে যে অভিযোগগুলো দিয়েছে, আমি সেগুলো সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করি। গত বছরের জুলাই-আগস্টে যারা নিহত হয়েছেন—রাজনৈতিক বিভাজনের উভয় পক্ষের মানুষসহ—সকলের মৃত্যুতে আমি গভীর শোকাহত। কিন্তু আমি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতা কখনোই কোনো প্রতিবাদকারীকে হত্যার নির্দেশ দিইনি।
নিচে আমি অভিযোগগুলোর সারবস্তু নিয়ে আরও মন্তব্য করেছি। তবে তার আগে বলতে চাই—আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যূনতম সুযোগও দেওয়া হয়নি, এমনকি আমার অনুপস্থিতিতে আমার নিয়োগকৃত আইনজীবীদের আদালতে প্রতিনিধিত্ব করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
যদিও এর নাম “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল”, বাস্তবে আইসিটির সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি কোনোভাবেই নিরপেক্ষ বা স্বাধীন নয়। নিচের অকাট্য সত্যগুলো বিবেচনা করলেই এর প্রকৃত উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়:
• আমার বিরুদ্ধে রায় আগেই নির্ধারিত ছিল।
• বিশ্বের কোনো প্রকৃত সম্মানিত বা পেশাদার বিচারক বাংলাদেশের এই আইসিটিকে সমর্থন করবেন না।
• ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যে আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আজ তা ব্যবহার করা হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নিতে। সেই সরকারের বিরুদ্ধে, যে সরকার দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বিরামহীনভাবে কাজ করেছে।
আমি আমার অভিযোগকারীদের মুখোমুখি হতে কোনো ভয় পাই না। শর্ত একটাই: বিচারটি হতে হবে একটি প্রকৃত, স্বাধীন ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ট্রাইব্যুনালে, যেখানে প্রমাণ ন্যায়সংগতভাবে যাচাই ও পর্যালোচনা করা হবে। সেই কারণেই আমি বারবার অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানিয়েছি এই অভিযোগগুলো হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) উপস্থাপন করতে।
অন্তর্বর্তী সরকার কখনো এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে না কারণ তারা জানে, আইসিসি আমাকে খালাস দেবে। একই সঙ্গে তারা আশঙ্কা করে যে, আইসিসি তাদের নিজেদের ক্ষমতাকালীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ডও খতিয়ে দেখবে।
আমাদের সরকার ছিল জনগণের ভোটে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত, এবং আমরা শুধুমাত্র তাদের কাছে জবাবদিহি করতাম। নির্বাচনের সময় আমরা তাদের কাছে ম্যান্ডেট চেয়েছি, এবং ক্ষমতায় থাকাকালে সাধারণ নাগরিকদের ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে সর্বদা সতর্ক থেকেছি।
অন্যদিকে ড. ইউনূস অসাংবিধানিকভাবে এবং চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর প্রত্যক্ষ সমর্থনে ক্ষমতায় এসেছেন। তার শাসনে ছাত্র, গার্মেন্টস শ্রমিক, চিকিৎসক, নার্স, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণির প্রতিটি আন্দোলন–বিক্ষোভ দমন করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে নির্মমভাবে। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। যারা এসব অন্যায়ের খবর প্রকাশ করেছেন সেই সাংবাদিকরা হয়রানি, নিপীড়ন ও হামলার শিকার হয়েছেন।
ক্ষমতা দখলের পর ইউনূসের বাহিনী গোপালগঞ্জে হত্যাযজ্ঞ ও হামলা চালায় এবং আহত ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধেই ফৌজদারি মামলা দেয় নির্যাতিতকে অপরাধী বানিয়ে। সারা দেশে লাখ লাখ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সমর্থকের বাড়িঘর, ব্যবসা ও সম্পত্তি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ধ্বংস করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত এই প্রতিশোধমূলক হামলা, অগ্নিসংযোগ ও গণপিটুনি যা ইউনূসের পরিকল্পিত নির্দেশে সংঘটিত হয়েছে। এসব অপরাধের দায়ীদের সম্পূর্ণ দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। বরং আইসিটির আপোষহীন প্রধান প্রসিকিউটর এই সাজানো আদালতে মিথ্যা তথ্য পেশ করে প্রতিটি অপরাধের বোঝা আওয়ামী লীগ সদস্যদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। সন্ত্রাসী, চরমপন্থী ও দণ্ডপ্রাপ্ত খুনিদের জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, আর কারাগার ভরে উঠেছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দিয়ে।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে যা ঘটেছে, তা আমাদের দেশের জন্য একটি ভয়াবহ ট্র্যাজেডি—অনেক পরিবার তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছে। বিশৃঙ্খলা থামানোর জন্য আমরা যে পদক্ষেপ নিয়েছিলাম, তা আমরা সৎ উদ্দেশ্যে নিয়েছিলাম এবং প্রাণহানি কমানোর চেষ্টা করেছিলাম। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়—কিন্তু এটিকে জনগণের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত হামলা হিসেবে ব্যাখ্যা করা বাস্তবতাকে বিকৃত করা।
আইসিটির প্রসিকিউটরদের উত্তেজনাপূর্ণ দাবি সত্ত্বেও তারা এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দেখাতে পারেনি যাতে বোঝা যায় আমি জনতার বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। যেসব অডিও-ট্রান্সক্রিপ্ট দেখানো হয়েছে, সেগুলো খণ্ডিত এবং প্রসঙ্গবহির্ভূত। বাস্তবতা হলো—মাঠ পর্যায়ের নিরাপত্তা বাহিনী প্রতিষ্ঠিত আইনগত প্রোটোকল মেনে পরিস্থিতি সামলাচ্ছিল।
৬ থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত ছাত্ররা অবাধে আন্দোলন করেছে—তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়েছিল। তাদের সব দাবি আমি মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু মধ্য জুলাই থেকে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে—কারণ গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ অবকাঠামো ভাঙচুরের ফলে ইন্টারনেট বিভ্রাট দেখা দেয়।
বিশৃঙ্খলার সময় বহু থানাসহ সরকারি ভবনে আগুন লাগানো হয়, অস্ত্র লুট হয়, সরকারি স্থাপনা আক্রান্ত হয়। এসব সহিংসতার মুখে সরকার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে শৃঙ্খলা ও সংবিধান রক্ষা এবং জীবন বাঁচাতে কাজ করেছিল।
আইসিটির প্রসিকিউটররা দাবি করেছে—রাষ্ট্রের ভবনগুলো পুড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। অথচ বহু ছাত্রনেতা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে—তারা এসব অগ্নিসংযোগ করেছে। আরও যেসব প্রমাণ প্রসিকিউশন দেখিয়েছে, সেগুলোও সন্দেহজনক। তারা বারবার একটি জাতিসংঘের (ইউএন) রিপোর্ট উদ্ধৃত করেছে—যা গোপন সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, এবং সংশ্লিষ্ট সাক্ষীদের অনেকে নিজেরাই অভিযোগের মুখোমুখি বা জোরপূর্বক মিথ্যা তথ্য দিতে বাধ্য হয়েছেন। যেসব নথি আওয়ামী লীগের সদস্যদের নির্দোষ প্রমাণ করতে পারত এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্টদের দায় দেখিয়ে দিত—তা জাতিসংঘের পরিদর্শকদের কাছ থেকে গোপন করা হয়েছে।
এ সহিংসতায় আরও অনেক অজানা রহস্য আছে—যা অন্তর্বর্তী সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে আড়াল করেছে। বিশেষত, আন্দোলনের শুরুতে “উস্কানিদাতা”দের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ রয়ে গেছে। সাক্ষ্য ও ফরেনসিক প্রমাণ দেখায়—এই উস্কানিদাতাদের কাছে সামরিক গ্রেডের অস্ত্র ছিল, যার মধ্যে ৭.৬২ ক্যালিবারের গুলিও রয়েছে—যা তারা পুলিশ ও সাধারণ নাগরিকদের ওপর হামলা করতে, পরিস্থিতি উত্তেজিত করতে এবং সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ সৃষ্টি করতে ব্যবহার করেছে। ১৮ জুলাই ২০২৪-এ আমি এসব ঘটনা তদন্তে একটি বিচারিক অনুসন্ধান কমিটি গঠন করি—একজন হাইকোর্ট বিচারকের নেতৃত্বে। কমিটি কাজও শুরু করেছিল। কিন্তু ইউনুস ক্ষমতা দখল করার পরপরই তদন্ত বন্ধ করে দেন।
জাতিসংঘের ১,৪০০ মৃত্যুর যে বহুল উদ্ধৃত সংখ্যা, তা বিতর্কিত। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যাচাইকৃত সংখ্যা ৮৩৪। মনে হচ্ছে উচ্চসংখ্যাটিতে এনএসআই-এর দেওয়া যাচাইবিহীন তালিকা যুক্ত হয়েছে এবং সেখানে মৃতদের মধ্যে আন্দোলনকারীদের হাতে নিহত পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীরাও অন্তর্ভুক্ত। অথচ মাত্র ৬১৪ পরিবার শহীদের পরিবার হিসেবে রাষ্ট্রীয় সহায়তা পেয়েছে। সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধান বলছে—এই তালিকার ৫২ জন গুলিতে মারা যাননি; অসুস্থতা, দুর্ঘটনা বা অন্য কারণে মারা গেছেন—এমনকি ঘোষিত মৃতদের মধ্যে প্রায় ১৯ জন পরে জীবিত পাওয়া গেছে। অর্থাৎ পুরো চিত্রই অস্পষ্ট, এবং অন্তর্বর্তী সরকার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মৃতদের একটি তালিকা প্রকাশ করতে অস্বীকার করছে।
আমি আইসিটির অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোও ভিত্তিহীন বলে প্রত্যাখ্যান করছি। আমার সরকারের মানবাধিকার ও উন্নয়ন রেকর্ড নিয়ে আমি গর্বিত। আমরা ২০১০ সালে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুক্ত করেছিলাম, মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি, বিদ্যুৎ ও শিক্ষায় প্রবেশাধিকার বাড়িয়েছি, এবং ১৫ বছরে দেশের জিডিপি ৪৫০% বৃদ্ধি করেছি—যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে উত্তোলন করেছে।
এই অর্জনগুলো ইতিহাসে নথিভুক্ত। এগুলো কোনোভাবেই এমন নেতৃত্বের পরিচয় নয়, যারা মানবাধিকারে উদাসীন। আর ড. ইউনুস ও তার প্রতিহিংসাপরায়ণ অনুসারীরা এমন কোনো অর্জনের দাবি করতে পারে না—যা এর সামান্য কাছাকাছিও পৌঁছায়।