ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

3613

Published on মার্চ 19, 2022
  • Details Image

বিশ্বজিত ঘোষঃ

পূর্ববাংলার পশ্চাৎপদ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে উচ্চশিক্ষায় আকৃষ্ট করা এবং বাংলায় ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে পরিকল্পিত এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বহু গুণী মানুষের সান্নিধ্যে ধন্য হয়ে ওঠে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অম্ল-মধুর সম্পর্কের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন বঙ্গবন্ধু, এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থন করার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতার পর এই বিশ্ববিদ্যালয় তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কয়েক ঘণ্টা আগে ১৯৭৫ সালের মধ্য-আগস্টে সপরিবারে শহীদ হন বঙ্গবন্ধু।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, একটি মহৎ প্রতিষ্ঠান আর একজন মহান মানুষ, উভয়ই প্রায় সমান বয়সী। শতবর্ষ আগে প্রায় কাছাকাছি সময়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান আর ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জের মিশন স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৪১ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে আইএ পাস করে এখানেই ভর্তি হন স্নাতক শ্রেণিতে। ১৯৪৭ সালে ইসলামিয়া কলেজ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং সেপ্টেম্বর মাসে বেকার হোস্টেলের আবাস ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। অতঃপর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নতুন রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। এ পর্বে প্রধানত তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রথমত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতৃস্থানীয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমবেত করা এবং নেতৃত্ব প্রদান এবং তৃতীয়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলন সমর্থন করা ও কারাবরণ।

নঈমুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে গঠিত ছাত্রলীগের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক ছিল খুবই নিবিড়। বস্তুত, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় প্রায় সবাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এই ছাত্র-সংগঠন সৃষ্টিতে শেখ মুজিবুর রহমানই পালন করেন মুখ্য ভূমিকা। বস্তুত, তার একক চিন্তা ও উদ্যোগের ফলেই গঠিত হয়েছে এই ছাত্র-সংগঠন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা আবদুল মতিন উপস্থাপন করেছেন এভাবে : “১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো। এর মাস চারেক পর একদিন শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের ফজলুল হক হলে আসেন। তিনি এক ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা দেন। আমিও শ্রোতা হিসেবে ওই ছাত্রসভায় উপস্থিত ছিলাম। তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমরা পাকিস্তান পেয়েছি। একে উন্নত করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এজন্য দরকার একটি শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন। চলুন, আমরা শাহ আজিজুর রহমানের কাছে যাই এবং নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে নতুন করে শক্তিশালী করার জন্য তাকে বলি।’ শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমরা বেশ কয়েকজন ছাত্র শাহ আজিজুর রহমানের কাছে গেলাম। শাহ আজিজুর রহমান তখন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান শাহ আজিজুর রহমানকে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিল সভা ডাকার জন্য অনুরোধ করেন। শাহ আজিজুর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাব অনুযায়ী কাউন্সিল সভা ডাকতে রাজি হলেন না। শাহ আজিজুর রহমান নাজিমউদ্দীন সরকারের সমর্থক। কাউন্সিল সভা আহ্বান করা হলে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে তার নেতৃত্ব বহাল থাকবে না, তা তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘আপনারা এগিয়ে আসুন, আমরা একটি নতুন ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলি।’ আমি তার প্রস্তাবে রাজি হলাম। মোগলটুলী ওয়ার্কার্স ক্যাম্প-সমর্থিত নেতৃস্থানীয় ছাত্ররা শেখ মুজিবুর রহমানের আবেদনে সাড়া দিলেন। অলি আহাদ, নঈমুদ্দীন আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান এবং আমিসহ আরও কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ছাত্র ফজলুল হক হল মিলনায়তনে এক কর্মীসভায় বসি। এ সভায় আমরা ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠন করি। অলি আহাদ ও মোহাম্মদ তোয়াহা সংগঠনের নাম থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দেওয়ার জন্য সভায় দাবি জানান। এই দাবির বিরোধিতা করে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘এ সময় এটা বাদ দেওয়া ঠিক হবে না। সরকার ভুল ব্যাখ্যা দেবে। পরে সময় হলে তা বাদ দেওয়া যাবে।’ আমি শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানালাম। ‘মুসলিম’ শব্দ রাখা হলো। অলি আহাদ তা মেনে নিলেন। মোহাম্মদ তোয়াহা তা মানলেন না। তিনি এই সংগঠনের সঙ্গে তার আর কোনো সম্পর্ক রাখলেন না। আমরা নঈমুদ্দীন আহমেদকে এই নতুন ছাত্র সংগঠনের আহ্বায়ক নির্বাচন করি। ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।”

শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তা ও উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ১৯৪৭-১৯৫২ কালপর্বে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সফল করার জন্য শেখ মুজিবই সংগঠনের সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠন সৃষ্টি করলেও এর মূল কোনো পদে নিজেকে রাখেননি। নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করাই ছিল তার মূল লক্ষ্য। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম সাংগঠনিক কমিটির অন্যতম সদস্য। নঈমুদ্দীন আহমদ আহ্বায়ক থাকলেও সংগঠনের মূল দায়িত্ব পালন করতেন শেখ মুজিবুর রহমান। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন: ‘যদিও নঈমুদ্দীন কনভেনর ছিল, কিন্তু সবকিছুই প্রায় আমাকেই করতে হতো।’ 

অতএব, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগঠনে যে ভূমিকা পালন করেছে, সংগঠনের মূল চালিকশক্তি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান যে তার অংশী, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায়, এমআর আখতার মুকুলের ভাষ্য : ‘১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন সংগ্রামী ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ক্লাসে ভর্তি হন। এ সময় তিনি অনুভব করেন যে, অচিরেই মুসলিম লীগের ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এসব ইস্যুর অন্যতম হবে বাংলা ভাষার আন্দোলন। এ জন্যই শেখ মুজিব স্বয়ং উদ্যোগ গ্রহণ করে ... পৃথব ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করলেন।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালে শেখ মুজিবুর রহমানের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। ছাত্রলীগের নানা অনুষ্ঠান বা সাংগঠনিক আলোচনা সভায় তিনিই পালন করতেন মুখ্য ভূমিকা। সাংগঠনিক কাজে এক হল থেকে অন্য হলে তিনি যাতায়াত করতেনÑ কলাভবনের নানা কাজে অংশগ্রহণ করতেন। এভাবে বিবেচনা করলে বলা যায়- ১৯৪৮-৪৯ কালপর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ সংগঠনসূত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্কের একটা প্রধান অনুষঙ্গ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। এ সূত্রে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও তমদ্দুন মজলিসের যৌথ উদ্যোগে ফজলুল হক মুসলিম হলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের একটি বর্ধিত সভা আহ্বান করা হয়। এই সভা আহ্বানে শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের শিক্ষার্থী কামরুদ্দীন আহমদ। এই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আবুল কাসেম, রণেশ দাশগুপ্ত, আজিজ আহমদ, সরদার ফজলুল করিম, অজিত গুহ, শামসুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, নঈমুদ্দীন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, তোফাজ্জল আলী, মোহাম্মদ তোয়াহা, আলী আহমেদ, মহিউদ্দীন, আনোয়ারা খাতুন, শামসুল আলম, শহীদুল্লা কায়সার, শওকত আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, লিলি খান, আবদুল আউয়াল, ওয়াহেদ চৌধুরী, নূরুল আলম, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ। উল্লেখ্য, এদের অধিকাংশই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এই সভায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ পুনর্গঠিত হয়। এটিকেই বলা হয় ‘দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ বা ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন শামসুল আলম। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদ্দুন মজলিস, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রাবাস থেকে দুজন করে প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনে তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে মযহারুল ইসলাম লিখেছেন : ‘এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিব বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং তার ভূমিকা ছিল যেমন বলিষ্ঠ, তেমনি সুদূরপ্রসারী।’ 

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ২ মার্চের সভাতেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে এবং পাকিস্তান গণপরিষদে সরকারি ভাষার তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ববাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংগঠনিক সফরে বেরিয়ে পড়েন, উদ্দেশ্য জেলায় জেলায় ১১ মার্চের কর্মসূচি পালনের ব্যবস্থা করা। শেখ মুজিবুর রহমান এ উদ্দেশ্যে ফরিদপুর, যশোর, খুলনা ও বরিশাল সফর করেন। সর্বত্রই ছাত্রসভা করে তিনি ১১ মার্চের কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানান। ১১ মার্চের ধর্মঘট সম্পর্কে বিস্তারিত কর্মসূচি নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি সভা বসে। এই সভা সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লেখেন : ‘রাতে কাজ ভাগ হলো- কে কোথায় থাকব এবং কে কোথায় পিকেটিং করার ভার নেবে।’ ১১ মার্চের ধর্মঘটের জন্য ছাত্ররা ব্যাপক প্রস্তুতি চালায়- কে কোন স্থানে পিকেটিংয়ে নেতৃত্ব দেবে, তাও ঠিক করা হয়। পিকেটিং চলাকালে নেতৃস্থানীয় কেউ গ্রেপ্তার হলে তার দায়িত্ব কে গ্রহণ করবে, তাও ঠিক করা হয়। এসব কর্মসূচি প্রণয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান।

১১ মার্চ সেক্রেটারিয়েটের গেটে পিকেটিং করার সময় পুলিশ শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের চুক্তির মাধ্যমে ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে চলে আসেন। ১৬ মার্চ দুপুর একটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রদের বিশাল সমাবেশ হয়। সেই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ছাত্র-জমায়েতে শেখ মুজিবুর রহমানের এটাই প্রথম সভাপতিত্ব করা। এ সম্পর্কে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন : ‘১৬ তারিখ সকাল দশটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রসভায় আমরা সকলেই যোগদান করলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসল সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য। সকলেই সমর্থন করল। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হলো। অনেকেই বক্তৃতা করল। সংগ্রাম পরিষদের সাথে যেসব শর্তের ভিত্তিতে আপস হয়েছে তার সকলগুলিই সভায় অনুমোদন করা হলো। তবে সভা খাজা নাজিমুদ্দীন যে পুলিশি জুলুমের তদন্ত করবেন, তা গ্রহণ করল না; কারণ খাজা সাহেব নিজেই প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আমি বক্তৃতায় বললাম, ‘যা সংগ্রাম পরিষদ গ্রহণ করেছে, আমাদেরও তা গ্রহণ করা উচিত। শুধু আমরা ঐ সরকারি প্রস্তাবটা পরিবর্তন করতে অনুরোধ করতে পারি। এর বেশি কিছু না।’ ছাত্ররা দাবি করল, শোভাযাত্রা করে আইন পরিষদের কাছে গিয়ে খাজা সাহেবের কাছে এই দাবিটা পেশ করবে এবং চলে আসবে। আমি বক্তৃতায় বললাম, তার কাছে পৌঁছে দিয়েই আপনারা আইনসভার এরিয়া (বর্তমান জগন্নাথ হল) ছেড়ে চলে আসবেন। কেউ সেখানে থাকতে পারবেন না। কারণ সংগ্রাম পরিষদ বলে দিয়েছে, আমাদের আন্দোলন বন্ধ করতে কিছুদিনের জন্য সকলেই রাজি হলেন।” এই পর্বে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রসঙ্গত প্রণিধানযোগ্য আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর এই ভাষ্য : ‘শুধু তাই নয়, ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ থেকে ভাষা আন্দোলনের ছাত্রনেতাদের মুক্তি লাভের পর আন্দোলনের নেতৃত্ব মুখ্যত শেখ মুজিবের হাতেই আবার চলে আসে।’

পরিষদ ভবনে খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে দাবি উত্থা পন সূত্রে বিরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়। উপায়ান্তর না দেখে মুখ্যমন্ত্রী সেনাবাহিনী তলব করেন। সেনা সদস্যরা ছাত্রদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায় এবং পরিষদ ভবনের পেছনের দরজা দিয়ে খাজা নাজিমুদ্দীনকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। এ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন : ‘এক শোভাযাত্রা করে আমরা হাজির হয়ে কাগজটা ভিতরে পাঠিয়ে দিলাম খাজা সাহেবের কাছে। আমি আবার বক্তৃতা করে সকলকে চলে যেতে বললাম এবং নিজেও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে চলে আসার জন্য রওনা করলাম। কিছু দূর এসে দেখি, অনেক ছাত্র চলে গিয়েছে। কিছু ছাত্র ও জনসাধারণ তখনো দাঁড়িয়ে আছে আর মাঝে মাঝে স্লোগান দিচ্ছে। আবার ফিরে গিয়ে বক্তৃতা করলাম। এবার অনেক ছাত্রও চলে গেল। আমি হলে চলে আসলাম। প্রায় চারটায় খবর পেলাম; আবার বহু লোক জমা হয়েছে, তারা বেশিরভাগ সরকারি কর্মচারী ও জনসাধারণ, ছাত্র মাত্র কয়েকজন ছিল। শামসুল হক সাহেব চেষ্টা করছেন লোকদের ফেরাতে। মাঝে মাঝে হলের ছাত্ররা দু-একজন এমএলএকে ধরে আনতে শুরু করেছে মুসলিম হলে। তাদের কাছ থেকে লিখিয়ে নিচ্ছে, যদি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে না পারেন, তবে পদত্যাগ করবেন।... আমি ছুটলাম অ্যাসেম্বলির দিকে। ঠিক কাছাকাছি যখন পৌঁছে গেছি তখন লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করতে শুরু করেছে পুলিশ। আমার চক্ষু জ্বলতে শুরু করেছে। পানি পড়ছে, কিছুই চোখে দেখি না। কয়েকজন ছাত্র ও পাবলিক আহত হয়েছে। আমাকে কয়েকজন পলাশী ব্যারাকের পুকুরে নিয়ে চোখে-মুখে পানি দিতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পর একটু আরাম পেলাম। দেখি মুসলিম হলে হইচই। বাগেরহাটের ডা. মোজাম্মেল হক সাহেবকে ধরে নিয়ে এসেছে। তিনি এমএলএ। তাকে ছাত্ররা জোর করছে লিখতে যে, তিনি পদত্যাগ করবেন। আমাকে তিনি চিনতেন, আমিও তাকে চিনতাম। আমি ছাত্রদের অনুরোধ করলাম, তাকে ছেড়ে দিতে। তিনি লোক ভালো এবং শহীদ সাহেবের সমর্থক ছিলেন। অনেক কষ্টে, অনেক বুঝিয়ে তাকে মুক্ত করে বাইরে নিয়ে এলাম। একটা রিকশা ভাড়া করে তাকে উঠিয়ে দিলাম। হঠাৎ খবর এলো, শওকত মিয়া আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। তাড়াতাড়ি ছুটলাম তাকে দেখতে। সত্যই সে হাতে, পিঠে আঘাত পেয়েছে। পুলিশ লাঠি দিয়ে তাকে মেরেছে। আরও কয়েকজন সামান্য আহত হয়েছে। সকলকে বলে আসলাম, একটু ভালো হলেই হাসপাতাল ত্যাগ করতে। কারণ পুলিশ আবার গ্রেপ্তার করতে পারে।’

১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ পরিষদ ভবনের সামনে কর্মসূচি পালনকালে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদে ওইদিন রাতে ফজলুল হক মুসলিম হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ এক সভায় মিলিত হন। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান যোগদান করেন। পরিষদ ভবনের সামনে প্রতিবাদ সভায় অংশগ্রহণ, পুলিশের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সভায় বাগবিত-া হয় এবং একে অপরকে দোষ দিতে থাকে। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান উভয় পক্ষকে শান্ত করান। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফরের কারণে সংগ্রাম পরিষদ কঠোর কোনো কর্মসূচি না দিয়ে ১৭ মার্চ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধু প্রতিবাদ ধর্মঘটের ডাক দেয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ১৭ মার্চ পূর্ববঙ্গের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। এই দিন বেলা সাড়ে বারোটায় বটতলায় এক প্রতিবাদী ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিপুলসংখ্যক অংশগ্রহণ করে। প্রতিবাদী ছাত্রসভায় সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ। আন্দোলনের সামগ্রিক পরিস্থিতি, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফর, ভবিষ্যৎ করণীয়Ñ এসব বিষয় নিয়ে বক্তৃতা করেন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, আবদুর রহমান চৌধুরী, অলি আহাদ প্রমুখ। সভায় বক্তারা পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর জুলুমকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করেন। ছাত্র ফেডারেশনের কয়েকজন কর্মী রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে প্রতিনিধিত্ব দাবি করে বক্তব্য রাখলে সভায় হট্টগোল দেখা দেয়। এ সময় সব পক্ষকে শান্ত করতে শেখ মুজিবুর রহমান মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরের আগে সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান তিনি। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতি ছাত্র নেতৃবৃন্দের বিশ্বাসে তখনো চিড় ধরেনি। তারা ধারণা করেছিলেন ঢাকা এসে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা সমস্যার একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান দেবেন।

পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেলের ঢাকা সফর উপলক্ষে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সমুদয় কর্মসূচি ১৭ মার্চ অপরাহ্ন থেকে স্থগিত করা হয়। ওইদিন রাত ৯টায় ফজলুল হক মুসলিম হলের হাউজ টিউটরের কক্ষে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় উপস্থিত থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে সকলকে ধারণা দেন। ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক কার্জন হলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বিশেষ সমাবর্তন সভায় ভাষণ দেন। সমাবর্তন সভায় জিন্নাহ বলেন : ‘আমি খুব স্পষ্ট করেই আপনাদের বলছি যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, এবং অন্য কোন ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এই কথা শুনে সমাবর্তনে অংশগ্রহণকারী ছাত্ররা তাৎক্ষণিক এর প্রতিবাদ করে। তারা ‘নো নো’ বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানায়। কার্জন হলে সমাবর্তন হলের ভেতরে সেদিন ছিলেন না শেখ মুজিবুর রহমান, কেননা তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট নন। তিনি সংগঠনের কর্মীদের নিয়ে হলের বাইরে অবস্থান করছিলেন। যখন জিন্নাহর বক্তৃতার বিষয় জানতে পারলেন, তখন কর্মীদের নিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন শেখ মুজিব। হল থেকে জিন্নাহ যখন বেরিয়ে যান, তখনো শেখ মুজিবুর রহমান শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ উচ্চারণ করেন এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানাতে থাকেন। জিন্নাহর পক্ষে এবং বিপক্ষে আন্দোলন আরম্ভ হয়। ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল অপরাহ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে কতিপয় ছাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে বক্তৃতা দেয়। এ সংবাদ অবগত হয়েই শেখ মুজিবুর রহমান ফজলুল হক মুসলিম হলে গিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানান। এ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শেখ মুজিবুর রহমান লেখেন : ‘জিন্নাহ চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরে ফজলুল হক হলের সামনে এক ছাত্রসভা হয়। তাতে একজন ছাত্র বক্তৃতা করেছিল ...।’ সে বলেছিল : ‘জিন্নাহ যা বলবেন তাই আমাদের মানতে হবে। তিনি যখন উর্দুই রাষ্ট্রভাষা বলেছেন, তখন উর্দুই হবে।’ আমি তার প্রতিবাদ করে বক্তৃতা করেছিলাম, আজও আমার এই কথাটা মনে আছে। আমি বলেছিলাম, ‘কোনো নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে।’

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতি অনুরাগ থাকলেও তার অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী বক্তব্য কিছুতেই মেনে নেননি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বরং এ সূত্রেই রাজনীতির বৃহত্তর ক্ষেত্রে ক্রমে অনুপ্রবিষ্ট হলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণসহ নানা কারণে সরকার পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মীদের ওপর দমনপীড়ন আরম্ভ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃস্থানীয় অনেক ছাত্রকে কারাবন্দি করা হয়, অনেককে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হয়। সরকারি দমনপীড়নের প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘জুলুম প্রতিরোধ কমিটি।’ শেখ মুজিবুর রহমানকে করা হয় এই কমিটির আহ্বায়ক। ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীনের সভাপতিত্বে একটি সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’-এর এই সভায় সংগঠনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, দবিরুল ইসলাম, নাদের বেগম প্রমুখ বক্তৃতা করেন। এ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন: “ছাত্ররা আমাকে কনভেনর করে ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালন করার জন্য একটা কমিটি করেছিল। একটা দিবসও ঘোষণা করা হয়েছিল। ... এই প্রথম পাকিস্তানের রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আন্দোলন এবং জুলুমের প্রতিবাদ। এর পূর্বে আর কেউ সাহস পায় নাই। তখনকার দিনে আমরা কোনো সভা বা শোভাযাত্রা করতে গেলে একদল গু-া ভাড়া করে আমাদের মারপিট করা হতো, সভা ভাঙার চেষ্টা করা হতো। ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবসে’ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ও কিছু গুণ্ডা আমদানি করা হয়েছিল। আমি খবর পেয়ে রাতেই সভা করি এবং বলে দিই, গুণ্ডামির প্রশ্রয় দেওয়া হলে এবার বাধা দিতে হবে। আমাদের বিখ্যাত আমতলায় সভা করার কথা ছিল; কর্তৃপক্ষ বাধা দিলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের মাঠে মিটিং করলাম। একদল ভালো কর্মী প্রস্তুত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে রেখে দিলাম, যদি গুণ্ডারা আক্রমণ করে তারা বাধা দেবে এবং তিনদিক থেকে তাদের আক্রমণ করা হবে যাতে জীবনে আর রমনা এলাকায় গুণ্ডামি করতে না আসে- এই শিক্ষা দিতে হবে।”

শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক এবং সম্পর্কসূত্র আপাত ছিন্ন হওয়ার সূত্রে ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনের কথা এসে যায়। ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে স্তব্ধ করার মানসে নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের বন্দি করতে থাকে। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ওপর নানামাত্রিক নির্যাতন নেমে আসে। তাদের অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন ... ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করেছে এবং ছাত্ররা তার সমর্থনে ধর্মঘট করছে। নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীরা বহুদিন পর্যন্ত তাদের দাবি পূরণের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন-নিবেদন করেছে এ কথা আমার জানা ছিল। এরা আমার কাছেও এসেছিল। পাকিস্তান হওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রেসিডেন্সিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এখন এটাই পূর্ববাংলার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্র অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কর্মচারীদের সংখ্যা বাড়েনি। তাদের সারাদিন ডিউটি করতে হয়। পূর্বে বাসা ছিল, এখন তাদের বাসা প্রায়ই নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কারণ নতুন রাজধানী হয়েছে, ঘরবাড়ির অভাব। এরা পোশাক পেত, পাকিস্তান হওয়ার পরে কাউকেও পোশাক দেওয়া হয় নাই। চাউলের দাম ও অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। চাকরির কোনো নিশ্চয়তাও ছিল না। ইচ্ছামতো তাড়িয়ে দিত, ইচ্ছামতো চাকরি দিত।... এরা ধর্মঘট করেছে... কর্তৃপক্ষ এদের দাবি মানতে অস্বীকার করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সকল কর্মচারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত কর দেবেন ঠিক করেছেন।’

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর সামগ্রিক পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে গেল। এবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা, কখনো প্রধানমন্ত্রী, কখনো রাষ্ট্রপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও সুযোগ পেল পূর্বসূরির অন্যায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের। সিদ্ধান্তের প্রায় ২৪ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাকে আজীবন সদস্যপদ প্রদান করে। যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বহিষ্কার করে, উত্তরকালে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হয়েছিলেন তিনি। এ এক অবিস্মরণীয় অনুষঙ্গ। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর। কিন্তু তার কয়েক ঘণ্টা আগে ঘাতকচক্র তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বৃহত্তর রাজনীতিতে তার যাত্রা শুরু, সেখান থেকেই তিনি নতুন বিপ্লবের ডাক দিতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনার যে নতুন রূপরেখা প্রস্তুত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, তার সূত্রপাত তিনি করতে চেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকেই, সেই সূত্রে জীবনে এবং মরণে বঙ্গবন্ধু মিশে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গভীরভাবে। প্রসঙ্গত প্রণিধানযোগ্য তৎকালীন ছাত্রনেতা মাহবুব জামানের এই স্মৃতিচারণ : ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা ১৪ আগস্ট রাতে। পরের দিন সকালে উনার (বঙ্গবন্ধু) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। তাই সর্বশেষ প্রস্তুতির খবর জানাতে আমি ও আমাদের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার (প্রফেসর আবদুল মতিন চৌধুরী) গিয়েছিলাম গণভবনে।’... আমরা যাওয়ার পরই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘সব রেডি তো? আমি কিন্তু অনেক দিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই দ্বিতীয় বিপ্লবের আসল কাজ শুরু হবে। কাল থেকেই নতুন দিন শুরু হবে।

বঙ্গবন্ধু যাতে এই নতুন দিন শুরু করতে না পারেন, সেজন্য দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা ১৫ আগস্টের প্রথম লগ্নে তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিক এই শুভলগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গভীর সম্পর্কের কথা আমাদের মনে পড়ে এবং এই সম্পর্ক সূত্রেই আমরা হয়ে উঠি সন্দীপিত- সুষমবণ্টনভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে হয়ে উঠি প্রাণিত।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ আমাদের সময়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত