1363
Published on ফেব্রুয়ারি 16, 2022স্কোয়াড্রন লীডার সাদরুল আহমেদ খান (অবঃ):
২১শে ফেব্রুয়ারি বাঙ্গালী ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় আর এর সাথে বঙ্গবন্ধুর নাম নিবিড়ভাবে জড়িত। জাতির পিতা ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৫৬, ১৯৬২, ১৯৬৯ এর আন্দোলনের দিনগুলোতে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নে, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করার মাধ্যমে ভাষার মর্যাদা সমুন্নত করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীতে বঙ্গবন্ধু এক অনবদ্য বক্তৃতায় শোক কে শক্তিতে রূপান্তরিত করার এক অমিত ভাষণ দিয়েছিলেন, যা ছিল প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য বাঙ্গালী জাতিকে প্রস্তুত করার রণকৌশল । এ যেন, ৭ই মার্চ ও ২৬ মার্চের জন্য জাতিকে পূর্ব প্রস্তুতিমূলক সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন সমরনায়ক। পাকিস্থানী গোয়েন্দা সংস্থা এ ভাষণ নিয়ে বিশেষ রিপোর্ট এ উল্লেখ করেছিল যে, এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে ডাক দিয়েছিলেন, আর যুদ্ধে শহীদ নয় গাজী হবার আত্মবিশ্বাস দিয়েছিলেন । শহীদ দিবসের প্রতিশোধে বাঙ্গালীদের কাপুরুষ নয় সাহসী হতে ইন্দন দিয়েছিলেন, রক্ত দিয়ে হলেও দাবী আদায়ে রুখে দাঁড়াতে বলেছিলেন ।
১৯৭১ সালের একুশের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক শোভাযাত্রা করে সভাস্থলে পৌঁছালেন । তিনি বলেন, বাঙ্গালীরা বহু রক্ত দিয়েছে, ১৯৫২ সাল থেকে যে রক্ত দেয়া শুরু হয়েছিল, তা কবে শেষ হবে জানা নেই। তাই শহীদ দিবসে তিনি শপথ নিতে বলেন, “যে পর্যন্ত সাত কোটি মানুষ তাদের অধিকার আদায় করতে না পারবে, সে পর্যন্ত বাংলার মা, বোন, ভাইয়েরা শহীদ হবে না, গাজী হবে ।“
তিনি বলেন, যে ষড়যন্ত্রকারীরা ১৯৫২ সালে গুলি করে বাঙ্গালীদের শহীদ করেছিল তারা তাদের কাজ শেষ করে নাই, ষড়যন্ত্র চলছে , ভবিষৎ এ চলবে । কিন্তু বাংলাদেশের চেহারা তারা দেখে নাই । তিনি উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ আপনারা আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারেন, ভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে শুরু হয় । ১৯৫২ সালে বাঙ্গালী ভাইয়েরা রক্ত দিয়ে প্রমান করেছে বাংলা ভাষা কে আমরা অমর্যাদা করতে দিব না, রক্তের বিনিময়ে হলেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেছি ।“
তিনি হুশিয়ারি দিয়ে বলেন, “যারা বাঙ্গালীদের দমাতে চায়, যারা বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার মানুষ কে লুট করতে চায়, কলোনি করতে চায় , নিজেদের বাজার করতে চায়, এতো বড় বিজয়ের পরও যারা ষড়যন্ত্র করতে চায়, তাদের জেনে রাখা উচিৎ ১৯৫২ সালের বাঙ্গালী আর ১৯৭১ সালের বাঙ্গালীর মধ্যে পার্থক্য আছে ।“
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের দুঃশাসনের কথা তুলে ধরে বলেন, “১৯৫২ সালে এ পবিত্র দিনে বাংলার ভাই বোনেরা রক্ত দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে, দরকার যদি হলে আমরা বাংলার মানুষ রক্ত দিতে জানি । বাঙ্গালী ১৯৫২ সালে শহীদ হয়েছে, ৫৪ সালের অত্যাচার, ৫৮ সালের অত্যাচার, ৬২ সালের শহীদ , ৭ই জুনের শহীদ, ৬৯ এর গণআন্দোলনে শহীদ হয়েছে, নাম নাজানা অচেনা ভাই বোনেরা রক্ত দিয়েছে । কিন্তু আজকে বাংলার মানুষ শুধু গুলি খেয়ে শহীদ হচ্ছেনা, না খেয়ে শহীদ হচ্ছে । কাপড় পায় না, পেটে খাবার নেই, পাকিস্তানিরা সব শোষণ করে নিয়ে যাচ্ছে, বাংলার মানুষ কে বাজারে তুলেছে, বাংলার সম্পদ লুট করেছে , বাংলার মানুষকে পথের ভিখারি করেছে ।“
আঞ্চলিক রাজনীতির উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা কারো উপর বেইনসাফ করতে চাই না, পাঞ্জাব তার অধিকার পাক, সিন্ধ তার অধিকার পাক, পাঠান তার অধিকার পাক, বেলুচ তার অধিকার পাক , আমরাও বাঙ্গালী আমরা আমাদের স্বাধিকার চাই, এখানে কোন আপোষ নাই ।“ তাই তিনি সবাইকে অনুরোধ করে বলেন, বাংলার ঘরে ঘরে যেতে, প্রস্তুত হয়ে যেতে, বাংলাদেশের ভাইয়েরা আর শহীদ নয় গাজী হয়ে মায়ের কোলে ফিরে যেতে হবে, শহীদ নয় গাজী ।
তিনি ৫২ এর শহীদদের কথা স্মরণ করে তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, “আমাদের ভাইদের কথা ভুলতে পারি না, যাদের মা আজও কাঁদে, যাদের বাবা আজও কাঁদে, যাদের ছেলে মেয়ে চিৎকার করে বাবা কে খুজে বেড়ায় । সে শহীদের আত্মা বাংলার ঘরে ঘরে , বাংলার দোয়ারে দোয়ারে আঘাত করে বলছে, বাঙ্গালি তুমি কাপুরুষ হয়ও না, বাঙ্গালি তুমি জানের জন্য ভয় করোনা, সংগ্রাম করে এগিয়ে যাও ।“ তাই তিনি শহীদ দিবসে সবাই কে নিয়ে শপথ নেন, “সবাই রক্ত দিবে, দাবী ছাড়বে না, দাবী আদায় করে ছাড়বে ।“
বঙ্গবন্ধু সকলকে সতর্ক করে বলেন, “সামনের দিন আরো কঠিন হবে, ষড়যন্ত্রকারীরা থামে নাই, তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, আমরা সকলের ভ্রাতৃত্ব কামনা করি, কিন্তু তার অর্থ এই নয় কেউ সাত কোটি মানুষকে গোলাম করে রাখবে, তার অর্থ এই নয় বাংলাদেশকে বাজার বা কলোনি করে রাখবে ।“
তিনি ৬৯ এর গণআন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, যে রক্ত দিয়ে বাংলার মানুষ একদিন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে তাঁকে মুক্ত করে এনেছে, তিনি শহীদ দিবসে ওয়াদা করে গেলেন নিজ রক্ত দিয়ে হলেও ৬৯ এর রক্তের প্রতিদান দিবেন। তিনি আরও বলেন, “মানুষ পয়দা হয় মৃত্যুর জন্য, বেঁচে আছি এটা একটা এক্সিডেন্ট, আজ ঘুরছি কাল মরে যেতে পারি। যারা দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন তাঁরা পথ দেখিয়ে গেছেন, এখন যারা শহীদ হবেন তারাও পথ দেখিয়ে যাবেন, ভবিষ্যৎ বংশধর বুক উচু করে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে, আমি বাঙ্গালী, আমি মানুষ, আমার স্বাধিকার আছে, আমার অধিকার আছে ।“
এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু তার রণকৌশল ব্যক্ত করলেন, “ শহীদ দিবসে আপনাদের কাছে অনুরোধ আপনারা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলেন । আমরা সবার প্রতি সহানুভূতিশীল, কিন্তু কেউ যদি অন্যায়ভাবে আমাদের উপর শক্তি ব্যবহার করতে চায়, নিশ্চয় এদেশের মানুষ তা সয্য করবে না ।“
একুশের শহীদের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “যতোদিন পর্যন্ত বাংলা থাকবে, বাংলার মাটি থাকবে, বাংলার আকাশ থাকবে, ততোদিন পর্যন্ত একুশের শহীদের কথা কেউ ভুলতে পারব না। কারণ ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে এই ইতিহাস খুজে পাওয়া যায়না এই বাংলার মাটি ছাড়া ।“
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি রোমন্থনে তিনি বলেন, “সে আন্দোলনে আমিও জড়িত ছিলাম, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ আমি গ্রেফতার হয়ে জেলে যাই । ১৯৫২ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী জেলের মধ্যে আমি অনশন ধর্মঘট করি, আর একুশে ফেব্রুয়ারী সর্বাত্মক আন্দোলনের পরামর্শ দিতে থাকি। ২৭ ফেব্রুয়ারী আমাকে স্ট্রেচারে করে জেল থেকে বের করে দেয়া হয়, যদি আমি মরে যাই জেলের বাইরে যেন মরি , এই আন্দোলনের সাথে আমি জড়িত ছিলাম, আজও জড়িত আছি, জানিনা কতদিন থাকতে পারব তবে প্রস্তুত আছি”।
সবশেষে তিনি উপস্থিত জনতাকে দাবী আদায়ের কথা তুলে ধরে বলেন, “আপনাদের কাছে এটুকু বলব এই বাংলার মানুষ যেন আর অপমানিত না হয়। আর যারা শহীদ হয়েছেন তাদের রক্তের সাথে যেন কেউ বেঈমানী না করে । মনে রাখবেন, আপনারা নিশ্চয় জানেন এবং বিশ্বাস করেন শহীদের রক্ত কখনো বৃথা যায় নাই, আর যাবেওনা ইনশাল্লাহ । তাই আপানাদের কাছে বিদায় নিচ্ছি এই রাত্রবেলা, না জানি আবার কবে দেখা হয়, আপনারা প্রস্তুত হয়ে যান, আমরা যখন রক্ত দিতে শিখেছি, বাঙ্গালী তার দাবী আদায় করবেই ।
উপস্থিত জনতাকে দাবী আদায়ের সোচ্চার করতে বঙ্গবন্ধু নিজেই স্লোগান ধরলেন,
“শহীদ স্মৃতি অমর হোক, জয় বাংলা । “
লেখকঃ সদস্য, অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ