জাতির পিতা- বাংলাদেশ

966

Published on জানুয়ারি 10, 2022
  • Details Image

এম নজরুল ইসলামঃ

পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের পরও একাত্তরের বিজয় দিবসে বাঙালীর একটি শূন্যতা ছিল। স্বজন হারানো মানুষের প্রিয় নেতা, যিনি গোটা স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যাঁর নির্দেশিত পথে গোটা জাতি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তিনি পাকিস্তানের কারাগারে। দেশজুড়ে মানুষের প্রতীক্ষা, নেতা কখন ফিরবেন। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে সেই আকাক্সক্ষা পূরণ হলো আমাদের। নেতা ফিরে এলেন বাংলায়। যে স্থানে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে আগের বছর ৭ মার্চ তিনি বাঙালীকে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন সেখানেই আবার তিনি মিলিত হলেন লাখো মানুষের সঙ্গে। কৃতজ্ঞতা জানালেন জনতা, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতাকারী সব দেশ ও শক্তিকে। কিন্তু সেই জ্বালাময়ী বক্তৃতা কান্নায় ঢেকে গেল অল্প সময়ের মধ্যে। লাখ লাখ মানুষ সেদিন বাংলার প্রিয় নেতাকে চোখ মুছতে দেখলেন। কিন্তু সেবারও তিনি মনে করিয়ে দিলেন এ জাতি দমে যেতে জানে না।

আজ ১০ জানুয়ারি। বাঙালীর জীবনের সেই ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭২ সালের আজকের এই দিনে স্বাধীন দেশের মাটিতে ফিরে আসেন এ দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যে জাতির মননে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র বুনেছিলেন, সেই দেশের রক্তভেজা মাটিতে তিনি ফিরে এলেন আজকের এই দিনে। কেমন ছিল সেই দিনটি? মহামানবের আগমনের দিনটি আগে থেকেই জানা ছিল দেশের মানুষের। তাই সকাল থেকেই অপেক্ষা, কখন ফিরবেন বাঙালীর প্রাণের পুরুষ। বাঙালীর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সোমবারের আবেগ ও আনন্দ আজকের দিনে বুঝিয়ে বলা কঠিন। একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। অন্যদিকে মানুষের মনে নতুন স্বপ্ন। নতুন করে দেশ গড়া ও নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে দেশের মানুষ তাকিয়ে ছিল যে মহামানবের দিকে, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতিতে তিনি পা রাখেন তাঁর প্রাণের মাটিতে। মাটির সন্তান ফিরলেন তাঁর প্রাণের মাটিতে। দুই চোখে কী স্বপ্ন খেলা করছিল তাঁর?

১০ জানুয়ারি বাঙালীর কাছে তিনি আবেদন জানালেন, ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সুসংহত করতে হলে দেশ গড়ার কাজে প্রত্যেককে নিয়োজিত হতে হবে। স্বাধীনতার লক্ষ্য যে মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তি সেই কথাও তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে গর্বিত জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষণা মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল। পুড়ে যাওয়া ভিটা আর সর্বস্ব হারানো মানুষের মাঝে উদ্দীপনা ছড়িয়ে দেয়ার কাজটি করলেন তিনি পরবর্তীকালেও। আমরণ সেই উদ্দীপনাকে কাজে লাগিয়ে দেশ গড়ায় নিজের অবদান রেখে গেছেন তিনি। তাঁর সেই নির্দেশনা ও দেখানো পথ ধরে বাংলাদেশ আজকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। ধ্বংসস্তূপের বাংলাদেশ আজকে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দেয়ার মতো ক্ষেত্র তৈরি করেছে। করোনাকালে পরাক্রমশালী দেশগুলোও যেখানে অর্থনৈতিক ধস ঠেকাতে হিমশিম খেয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বহু দেশকে পেছনে ফেলে দিতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান কয়েকগুণ বেড়ে এখন ঈর্ষণীয় পর্যায়ে ঠেকেছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে যুগান্তকারী সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ।

কিন্তু তার পরও বঙ্গবন্ধু উল্লিখিত অনেক জরুরী উন্নয়নই আমাদের অর্জন করা সম্ভব হয়নি। দারিদ্র্য আমাদের বড় সমস্যা। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ফারাক কিছুটা কমিয়ে আনতে পারলেও সমাজে বিত্তের খেলা বিদ্যমান। আছে দুর্নীতি আর হানাহানির মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। এমনকি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাবিরোধী একাত্তরের শত্রু বাহিনীর দোসরদের বিচার শুরু করতেও আমাদের ৪০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমরা আজ ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালের সেই দিকনির্দেশনাকে পাথেয় করে মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তি নিশ্চিত করতে পারি তাহলেই নেতার প্রতি প্রকৃত সম্মান দেখানো হবে, সেই সঙ্গে একাত্তরে শহীদ ৩০ লাখ মানুষের আত্মা শান্তি পাবে।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পা রাখার পর বিভিণ্ণ স্থানে বক্তৃতায় কেবলই দেশ ও দেশের মানুষের কথা বলেছেন। মানুষের কল্যাণে যে জীবন উৎসর্গীকৃত, সেই মহৎপ্রাণ মানুষটি কেবলই মানুষের মঙ্গলের কথা ভেবেছেন। তিনি সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। মানুষের মধ্যে নিজের স্বপ্ন বপন করতে পারতেন। বঙ্গবন্ধুকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁদের লেখা ও স্মৃতিচারণায় এক অনন্য মানবসত্তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এক অসাধারণ ক্যারিশমার রাষ্ট্রনায়ক। সব মোহের উর্ধে উঠে তিনি দেশের মানুষের কল্যাণ চিন্তা করেছেন। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ নতুনভাবে কী করে গড়ে তোলা যায়, এই ছিল তাঁর সব সময়ের চিন্তা। তিনি মানুষের বিভেদ দূর করতে চেয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু সাধারণ্যে মিশে সাধারণের মতোই জীবনযাপন করতে চেয়েছেন। নিজেকে কোন ঘেরাটোপে বন্দী করতে চাননি তিনি। মানুষের সঙ্গে মিশতে চেয়েছেন। মানুষের দুঃখ ভাগ করে নিতে চেয়েছেন। দেশের শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়েও তাঁর বাড়িটি ছিল সাধারণ একটি বাড়ি। বাড়ির আটপৌরে পরিবেশের সঙ্গে বাংলার সাধারণ পরিবারের অন্দর মহলের সাযুজ্য। এখানেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অন্যদের তফাত। তিনি অসাধারণ হয়েও জীবনযাপনে ছিলেন অতি সাধারণ। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি দেশের মানুষকে নিয়েই ভেবেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে দীর্ঘদিন থেকেই বাংলা ও বাঙালীর সমস্যা নিয়ে ভেবেছেন, তা তাঁর বক্তৃতায় স্পষ্ট। বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কি হবে সে কথাও তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন তাঁর বক্তৃতায়।

বঙ্গবন্ধু সব সময় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক। তাঁর কথা, তাঁর কাজ অনুসরণের ভেতর দিয়েই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছিলেন দেশের মানুষের জন্য। নির্যাতন-নিপীড়ন মেনে নিয়েছিলেন মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই। তাঁর মতো নিঃস্বার্থ রাজনীতিবিদ বিরল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমরা এই মানবপ্রেমী অসাধারণ রাষ্ট্রনায়ককে হারিয়েছি। তিনি বেঁচে থাকলে আজকের বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যেত। বাবার আদর্শের পতাকা বহন করে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশকে নেতৃত্বে দিচ্ছেন। আমাদের ভরসা সেখানেই। আমরা বিশ্বাস করি তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব আমাদের পৌঁছে দেবে সেই বাংলাদেশে, যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত