1517
Published on জানুয়ারি 10, 2022ইয়াসির আরাফাত-তূর্য:
‘‘চতুর্দিকে শোক, আহাজারি, ধ্বংসচিহ্ন, পোড়াগ্রাম, বিধ্বস্ত জনপদ
তিনি ফিরে আসলেন, ধ্বংসস্তূপের ভেতর ফুটে উঠল কৃষ্ণচূড়া
মুকুলিত হ’ল অপেক্ষার শিমুল
শোক থেকে জেগে উঠল স্বপ্ন, রক্তে বাজল দারুণ দামামা
বেদনার অশ্রুরেখা মুছে ফেলে
‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’ ব’লে হেসে উঠল
লতাগুল্ম, ধূলিকণা, পরিপূর্ণ দীপ্ত পতাকা।’’(কবিতায় বঙ্গবন্ধু ২০১২,পৃষ্ঠা ৩৭)
বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন, মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হলেন। টেনে ধরলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের হাল , মানুষ আশায় বুক বাঁধল।
অবিনাশী দুর্জয় সংগ্রামের তুলি দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বুকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মানচিত্র এঁকেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চিরকাল ভীনদেশীদের উপনিবেশিক শাসনকে উৎখাত করে বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতির জন্য প্রমিথিউসের ন্যায় ছিনিয়ে আনেন স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়।
আজকের এইদিনে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ নরঘাতক পাকিস্তানিদের থেকে মুক্ত হয়ে নিজভূমে জাতির পিতার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস।
পাকিস্তানে তিনটি কারাগারে ২৯০ দিন থাকার পর ১৯৭২ সালের এইদিনে বেলা ১:৪১ মিনিটে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। তাঁর পায়ের স্পর্শে সেদিন উদ্বেলিত হয়েছিলো বাংলার মায়ের দশদিক।
কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয়,
'ওই মহামানব আসে ।
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে ।' (শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
বর্বর পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে খুন করার কোন চেষ্টাকেই বাদ রাখেনি। পরাজয়ের ঠিক আগের রাতে জেলের মধ্যে দাঙ্গা লাগিয়ে হত্যার শেষ অপচেষ্টা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তা আর বাস্তবায়ন করতে পারেনি পাকিস্তানি জান্তারা। নরপিশাচ পাকিস্তানিদের সকল আঘাত ষড়যন্ত্রকে জয় করে নিশ্চিত করেন বাংলার স্বাধীনতা। সবশেষে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানিরা। ৯ জানুয়ারি লন্ডন হয়ে, ১০ জানুয়ারি নিজের সৃষ্ট দেশে ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বিকেলটি ছিলো বৃষ্টিস্নাত, বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি যখন তৎকালিন তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করে, তখন ঢাকার রাস্তায় আনন্দঅশ্রুতে মথিত হতে থাকে কোটি জনতা। পিতাকে একনজর দেখেই যেনো স্বাধীনতার পূর্ণতার আস্বাদ পেতে মরিয়া বাঙালি জাতি, ফিরে এলেন জাতির পিতা। 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে সমগ্র দেশ। বিমান থেকে নেমে বঙ্গবন্ধু সরাসরি চলে যান তাঁর প্রাণপ্রিয় জনতার মাঝে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে(বর্তমান সোহরাওর্দী উদ্যান) ।
‘স্বাধীন’ শব্দটি বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের গহীনতম কুঠুরি থেকে উচ্চারিত হলো,
‘ভাইয়েরা আমার, লক্ষ মানুষের প্রাণদানের পর আজ আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’
রেসকোর্সের জনসভায় তিনি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, ‘বিশ্বকবি, তুমি বলেছিলে ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তুমি দেখে যাও, তোমার আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। তোমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত করে আজ ৭ কোটি বাঙালী যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে। হে বিশ্বকবি তুমি আজ জীবিত থাকলে বাঙালীর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে নতুন কবিতা সৃষ্টি করতে।’
তাঁর বাঙালী জাতির প্রতি ছিলো অবিচল আস্থা। স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে সেদিন বলেছিলেন ‘এই বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা, এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র, এই বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।’
এরপর তিনি নতুন করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন আবেগী অথচ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে। জীবন্ত বঙ্গবন্ধুর মুখ প্রত্যক্ষ করে, তার কণ্ঠের মূর্চ্ছনায়, আন্দোলিত হয় মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। প্রতিটি বাঙালির হৃদয় পরিণত হয় পুষ্পবরষায়। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা এবং বীরমুক্তিযোদ্ধাদের বীরোচিত বিজয় পূর্ণতা লাভ করে জাতির পিতার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধে বিজয় লাভ করলেও, ১০ জানুয়ারি বাঙালি তার পরিপূর্ণ আস্বাদ লাভ করে।
কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ জাতির পিতার প্রতি অমীয় শব্দমালার নৈবেদ্য সাজান,
‘আনন্দের ঘোর কাটতে না কাটতেই,
একাত্তরের পরাজিত এজিদবাহিনী
রাত্রির অন্ধকারে সংগঠিত হয়ে পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট
সপরিবারে হত্যা করলো আমাকে।...
বহুদিন পর আজ সত্য জয়ী হয়েছে-,
সংগ্রাম জয়ী হয়েছে, সুন্দর জয়ী হয়েছে।
আজ আমার খুব আনন্দের দিন।’(মুজিবমঙ্গল, ২০১২, পৃ ৬১-৬২)
১০ই জানুয়ারি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়