আলোর পথের যাত্রা

992

Published on জানুয়ারি 9, 2022
  • Details Image

জাহাঙ্গীর আলম সরকারঃ

আজ ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫০তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ এবং বাঙালি জাতির অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের এই দিনে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তান কারাগারে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশের মাটিতে এসে তিনি আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়েন। সশস্ত্র সংগ্রাম ও অসহনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগের পর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের মধ্যে মহান নেতাকে ফিরে পেয়ে আনন্দ, উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। এই দিনটি তাই আমাদের জাতীয় ইতিহাসে স্মরণীয় দিন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

মুক্তিসংগ্রাম শুরু হওযার পুর্বে ১৬ মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। আলোচনার জন্য জুলফিকার আলী ভুট্টোও ঢাকায় আসেন। ২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলোচনা হয়। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হবার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার। বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার অপরাধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাত ১.৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২নং বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায়। ২৬ মার্চ গভীর রাতে তাঁকে বন্দী অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়।

দেশে যখন যুদ্ধ চলছে ঠিক তখন পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর পাতানো বিচার শুরু হয়। তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। কারাগারের যে সেলে বঙ্গবন্ধুকে রাখা হয়েছিল, সেই সেলের পাশে কবরও খোঁড়া হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠা প্রবল জনমতের মুখে পাকিস্তান সরকার ফাঁসির আদেশ কার্যকর করতে সাহস পায়নি। বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানায়। ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জনক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানানো হয়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, কাজেই পাকিস্তানের কোন অধিকার নেই তাকে বন্দী করে রাখার।

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারী জুলফিকার আলী ভুট্টু বঙ্গবন্ধুৃ শেখ মুজিবর রহমানের সাথে তার মুক্তির বিষয়ে নানা রকম বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করতে লাগলেন। কোন ভাবেই সুবিধা করতে না পেরে বললেন, বঙ্গবন্ধুর ঢাকা ফেরার ব্যাবস্থা হচ্ছে। তিনি জনগনের নেতা জনগনের কাছে ফিরে যাবেন। কিন্তু পরের দিন আবারো পানি ঘোলা হতে শুরু করলেন। ৭ জানুয়ারী শোনা গেলো ভিন্ন কথা পাশাপাশি লারকানায় সমাজতন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো নাচের আসর বসালেন। প্রচুর আনন্দঘন পরিবেশে নিজে নেচে, গান গেয়ে নিজের জন্মদিন পালন করলেন। অথচ সমগ্র পৃথিবী অধির অপেক্ষায় রয়েছে নেতা কখন মুক্তি পাবেন। সে দিকটায় ভুট্টোর মনোযোগ নেই। সবার মনে ভয় দানা বাধতে শুরু করলো। শ্রমতী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বব্যাপী প্রচুর জনমত গড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের তখন দাবী অভিন্ন আর তা হল বঙ্গবন্ধুর মুক্তি।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিশ্বের অগনীত জনগনের অভিন্ন দাবীর কাছে নতী স্বীকার করে ৮ জানুয়ারী রেডিও পাকিস্তান জানালেন বঙ্গবন্ধু রাত ৩ টায় পিআইএ এর বিমানে রওয়ানা দিয়েছেন। কিন্তু তখনও পরিস্কার করে বলা হল না কোথায় গিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ধৈর্য্যরে বাধ ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম এমতাবস্থায় সংবাদ সংস্থা রয়টারের খবরে সবাই জানতে পারলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর পাকিস্তানের কারাগার থেকে বেরিয়ে লন্ডনের হিথ্রো অ্যারোড্রোমে নেমেছেন। শরীরে শাদা গলা খোলা শার্ট। ধুসর বর্নের স্যুট। ওপরে ধুসর বর্নের ওভার কোট, মুখে পাইপ। সাংবাদিকদের তিনি বললেন দেখতে পাচ্ছেন আমি রিতীমতো বেচে আছি, ভাল আছি। থাকার জন্য ওঠলেন লন্ডনের হোটেল ক্লারিজেসে। হোটেল থেকে তাজুদ্দিন আহম্মেদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাথে কথা শেষ না হতেই ফোন করলেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। স্বদেশে যাওয়ার প্রাক্কালে ভারতের মাটিতে পা রাখার অনুরোধ জানালেন ভারতের জনগনের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী।

৯ জানুয়ারি লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সাথে সাক্ষাত হয়। লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লি¬তে যাত্রা বিরতি করেন। বিমান বন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি. ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আসতে স্বিকার করলেন। ১০ জানুয়ারী সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দিল্লিতে নামলেন। স্বাভাবিক ভাবেই নিরাপত্বার কারণে তার নামার সময় সূচী কাউকে সে ভাবে জানানো হয়নি। ভারতের রাস্তায় রাস্তায় দু-দেশের পতাকার পাশাপাশি পোষ্টারে লেখা গঙ্গা-পদ্মা সেম ফ্লাড, ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ সেম ব্লাড। দিলি¬র জনসভায় বঙ্গবন্ধু ইংরাজীতে ভাষন দেয়া শুরু করলেন কিন্তুু জনগনের সবার দাবী বাংলায় ভাষন দিবে তাদের নেতাকে। চারিদিকে ছরিয়ে পড়লো সেই বজ্রকণ্ঠ। তিনি বললেন- আপনাদের মহান প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী শুধু মহান ভারতের নেতা নন বরং সমগ্র মানবজাতির নেতা।

ভারতের জনসভা শেষ করে আর কাল বিলম্ব না করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দ্রুততার সাথে দেশের পথে রওয়ানা দেন। সদ্য বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত জাতি বঙ্গবন্ধুর দেশের মাটিতে ফিরে আসার জয়োল্লাসে ফেটে পড়ে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছিলে তাঁকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। আনন্দে অশ্রুসিক্ত হন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী শেখ মুজিবুর রহমান। আর এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় পূর্ণতা লাভ করে। এই দিনে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে লাখো মানুষ তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা জাতির জনককে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানায়। আবারও ঢাকার রমনার সেই রেসকোর্স ময়দান। সময় দুপুর গড়িয়েছে, অপরাহ্ন। নৌকা প্রতিকের আদলে তৈারি করা হয় পাচশো ফুট দীর্ঘ মঞ্চ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সেই মঞ্চে ওঠার পর নিজের আবেগকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তিনি বললেন আমি প্রথমে স্বরন করি বাংলাদেশের যে অগনিত হিন্দু মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে তাদের। জানতাম বাংলাকে কেউ দাবায় রাখতে পারবে না। কত লোক শহীদ হযেছেন, জান দিয়েছেন, তবু পিছু হটেন নাই। ৩০ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে এত নাগরিক মৃত্যু বরন করেন নাই, শহীদ নাই। বঙ্গবন্ধু দরাজ গলায় কান্না মাখা কন্ঠে বললেন- ...আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। অমি ওদের বলেছিলাম, তোমরা আমাকে মারতে চাও মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বঙ্গালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও ...। আপনারা আমাকে চেয়েছেন আমি এসেছি। আমার ফাসির হুকুম হয়েছিল। কবর খোড়া হয়েছিল। জীবন দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। বলেছিলাম, আমি বঙ্গালী, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, মানুষ একবারই মরে, দুবার নয়। হাসতে হাসতে মরব, তবু ওদের কাছে ক্ষমা চাইবো না। মরার আগেও বলে যাব, আমি বঙ্গালী, বাংলা আমার ভাষা, জয় বাংলা।। বলব বাংলার মাটি আমার মা। আমি মাথা নত করব না। ...আজ আমি বক্তৃতা করতে পারছি না। নমঃ নমঃ নমঃ সুন্দরী মম জননী জন্মভূমি। সেই জন্মভূমির মাটিতে পা দিয়ে আমি চোখের পানি রাখতে পারি নাই। জানতাম না, এই মাটিকে, এই জাতিকে এতো ভালোবাসী...।

স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর বাংলাদেশের মাটি থেকে মিত্র বাহিনীর সদস্যদের ভারতে ফিরে যাওয়া, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে আনা, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, ইসলামী ঐক্য সংস্থা, জাতিসংঘ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাষ্ট্রের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, বিধ্বস্ত অবকাঠামোসহ সামগ্রিক অর্থনীতির পুনর্বাসন, সংবিধান প্রণয়ন, সশস্ত্র বাহিনী পুনর্গঠন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পুনর্গঠন, সিভিল প্রশাসনের পুনর্গঠন হতে শুরু করে সবকিছু তাকে নতুন করে গড়ে তুলতে হয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে ধ্বংসস্তূপের ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুরু করেছিলেন একটি নতুন রাষ্ট্রের নির্মাণ। বঙ্গবন্ধুর ঐন্দ্রজালিক অবিস্মরণীয় নেতৃত্ব জাতিকে সেদিন যে দিক নির্দেশনা দিয়েছিল তা বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের ভিত মজবুত করে গড়ে তোলে। বলার অপেক্ষা রাখে না বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এক ঐতিহাসিক দিন। দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের সে দিনে স্বয়ং জাতির জনক তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা হিসাবে।

লেখক: আইনজীবী ও পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

(মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত