5814
Published on ডিসেম্বর 30, 2021পাকিস্তানি বর্বর জান্তাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় অর্জন করে বাঙালি জাতি। লাল-সবুজের কেতন ওড়ে বাংলার মাটিতে। একদিকে ত্রিশলক্ষ শহীদের লাশের স্তূপ, চার লক্ষাধিক নির্যাতিত মা-বোনের আহাজারি; অন্যদিকে পাকিস্তানি দানবদের হাত থেকে বাংলার মাটি ও সাত কোটি মানুষের চির মুক্তি; হাজার বছরের শৃঙ্খলভাঙার উল্লাসে যখন ঢাকা পড়ে যাচ্ছিলো স্বজন হারানোর বেদনা; ঠিক তখনই পাকিস্তানের কারাগারে হত্যার চেষ্টা করা হয় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
অবশ্য এটাই প্রথম অপচেষ্টা নয়, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ফলাও করে প্রচারিত হতে থাকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে। এরমধ্যেই বিশেষ কমান্ডো বাহিনী পাঠিয়ে চারপাশ থেকে গুলি চালানো হয় বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে, গ্রেফতার করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। এরপর সংসদ ভবন এলাকা, আদমজী ক্যান্টমেন্ট স্কুল, ঢাকা সেনিনাবাসের বিভিন্ন স্থানে আটকে রাখা হয় বাঙালি জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। অবশেষে ১ এপ্রিল তাকে কঠোর গোপনীয়তার মাধ্যমে পাঠানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগারে।
করাচি, লাহোর হয়ে তাকে পাঠানো হয় উষ্ণতম অঞ্চল লায়ালপুর শহরের এক নির্জন কারাগারে। উদ্দেশ্য, অন্ধকার নির্জনপ্রকোষ্ঠের একাকিত্বের পাশাপাশি প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে ফেলা। পরবর্তীতে উত্তর পাঞ্জাবের মিয়াওয়ালি কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য নির্ধারিত নির্জন জেলে রাখা হয় বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে। জেলের অন্ধকার কূপে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হতো তার ওপর। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অদম্য সাহস ও ব্যক্তিত্বের কাছে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় পাকিস্তানিদের কূটচাল। এরপর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার চক্রান্ত করে পাকিস্তানি জান্তারা।
বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যার পর পুরনো তারিখ ব্যবহারের কূটচাল
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে, জেলবন্দি বঙ্গবন্ধুকে আসামি করে এক প্রহসনের বিচার শুরু হয় পাকিস্তানে। ১২টি সাজানো অভিযোগ তৈরি করে তারা, যার মধ্যে ৬টির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। এর আগে, মে মাসেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুকে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যার জন্য পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের কথা। তখন বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়। এরপর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয় যে, শেখ মুজিব যাতে মামলা পরিচালনা করতে পারেন, সেজন্য তাকে আইনজীবী দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর আড়ালে তারা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে।
এমনকি ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জান্তাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে যখন পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেয় জুলফিকার আলী ভুট্টো, তখনও ইয়াহিয়া তাকে অনুরোধ করেছিল যে- শেখ মুজিবকে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করে যেনো পেছনের একটি তারিখকে মৃত্যুদণ্ডের দিন বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ এবং তাদের ৯৩ হাজার প্রশিক্ষিত সেনাসদস্য বাংলাদেশে বন্দি অবস্থায় থাকায় তা বাস্তবায়নের সাহস পায়নি ভুট্টো।
এর আগে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের ২০ তারিখে পাকিস্তানি জান্তাপ্রধান ইয়াহিয়া খান মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে জানান, মুজিবের ফাঁসির আদেশ হলেও তা শিগগিরই বাস্তবায়ন করা হবে না। এই তথ্য গণমাধ্যমে আসার পর বিশ্বনেতারা বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে শঙ্কা জানিয়ে সতর্ক করে দেয় পাকিস্তান সরকারকে। পাকিস্তানি গবেষক আহমদ সলিমের গ্রন্থ, ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকীর স্মৃতিকথন, সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
জেলের মধ্যে একাধিকবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র
বাংলার মাটিতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুকে কয়েকবার এক জেল থেকে অন্য জেলে স্থানান্তার করা হয়। মিয়াওয়ালি, ফয়সালাবাদ, সাহিওয়াল ছাড়াও রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রায় ১৫০ মাইল দূরে উত্তর পাঞ্জাবের লায়ালপুর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠের একাকী কক্ষে চূড়ান্তভাবে প্রাণে মারার চেষ্টা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। এর মধ্যেই গোপন বিচারের নামে চলতে থাকে তাকে ষড়যন্ত্র। জেলে তো দূরের কথা, গোপন আদালতেও তাকে তার নিজের আইনজীবীর সঙ্গেও একাকী কথা বলতে দেওয়া হতো না। এমনকি একটি ট্রান্সমিটার বসানো থাকতো বঙ্গবন্ধুর চেয়ারে, যাতে তিনি যে কথাই বলুন না কেন, তা যেনো শুনতে পারে পাকিস্তানি জান্তারা।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে, রণাঙ্গনে পরাজয় বুঝতে পেরে, মিয়াওয়ারি কারাগারের বঙ্গবন্ধুর নির্জন সেলের সামনে একটি কবর খোঁড়ে পাকিস্তানি সেনারা। ৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে পাকিস্তানের সামরিক গোপন আদালত। রায় বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে তারা। যেকোনো মূল্যে বঙ্গবন্ধুকে শিগগিরই হত্যার নির্দেশ দেয় ইয়াহিয়া খান। তবে বাংলার রণাঙ্গণের পরিস্থিতি খুব দ্রুত বদলাতে থাকে। অন্যদিকে নির্বাচনে বিজয়ী নেতা শেখ মুজিবকে হত্যা করার ব্যাপারে পাকিস্তানকে সর্বোচ্চ সতর্কবার্তা দেয় ভারত-রাশিয়া-ফ্রান্স-ব্রিটেন-যুগোশ্লাভিয়াসহ বিশ্ব মোড়লরা। তখন প্রহসনের মৃত্যুদণ্ড বাস্তবায়নের পথ বদল করে, জেলে থাকা খুনি আসামিদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে জেলের মধ্যে হত্যার সর্বশেষ অপচেষ্টা করা হয়।
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে, ১৫ ডিসেম্বর রাতে, জেলের মধ্যে দাগি আসামিদের হাঙ্গামার ফাঁদ পেতে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। জান্তাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে সেই রাতের অন্ধকারেই, মিয়াওয়ালি কারাগারের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের গেট খুলে দেওয়া হয়। সদ্য স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠাতা যেনো আর দেশে ফিরতে না পারেন, দেশ যাতে মুখ থুবড়ে পড়ে; সেজন্য ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পর, ১৬ ডিসেম্বর প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকেও জেলের ভেতর হত্যার চেষ্টা করে পাকিস্তানি বর্বর হানাদাররা।
কিন্তু কারাগারের মধ্যে এই ষড়যন্ত্রের কথা জেনে যান একজন কারা কর্মকর্তা। এরপর সেই রাতের অন্ধকারে দ্রুত বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে বের করে বাইরে নেন তিনি। ফলে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সরকার ও বিশ্বনেতাদের চাপে অবশেষে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। ৯ জানুয়ারি লন্ডন হয়ে, ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখে আনন্দঅশ্রুতে ভেঙে পড়েন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পায় বাঙালি জাতির মহান স্বাধীনতা।