বঙ্গবন্ধু এখন আরও শক্তিশালী

1504

Published on আগস্ট 16, 2021
  • Details Image

ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ:

বছর ঘুরে আবারও এসেছে আগস্ট। আগস্টকে আমরা শোকের মাস বলি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হারিয়েছি। আমরা একই সঙ্গে হারিয়েছি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকেও। সেই সময়ে আমরা আরও হারিয়েছি বঙ্গবন্ধুর পুত্র, পুত্রবধূ এবং তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ স্বজনদেরও। তাই আগস্ট আমাদের কাছে শোকাবহ। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রিয় দুই কন্যা পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।

ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা ও নিজস্ব ভূখণ্ড দিয়েছেন। বাংলাদেশ, বাঙালি ও বঙ্গবন্ধু- একটির সঙ্গে অপরটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ও অবিচ্ছেদ্য। বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেমন অবিচ্ছেদ্য, তেমনি বিশ্বের নিপীড়িত, বঞ্চিত ও শোষিত মানুষেরও তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণা। বিশ্বের হাতেগোনা যে কজন নেতা সম্মোহনী নেতৃত্বের অধিকারী বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের অন্যতম।

জনসাধারণের কাছ থেকে এমন অকুণ্ঠ ভালোবাসা, সম্মান ও শ্রদ্ধা বিশ্বের কম নেতার ভাগ্যেই জুটেছে। প্রিয় নেতাকে বিরল এ ভালোবাসা দিয়ে আমরা সম্মানিত হয়েছি। প্রিয় নেতাকে সপরিবারে হত্যা করার পর দেশবাসী বাকরুদ্ধ হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমরা ইতিহাসের মহানায়ককে হারিয়ে ফেলেছি। এ কথা এখন আর অজানা নয় যে, এই হত্যাকাণ্ড শুধু কতিপয় দুষ্কৃতকারী সেনা অফিসার দ্বারা সংঘটিত হয়নি, এতে পরাজিত শক্তির মদদও ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু মাত্র তিন বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি মনোনিবেশ করেছিলেন যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশকে পুনর্গঠনে। কিন্তু রাতের আঁধারে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাঙালি জাতির অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিদের সামান্যতম অনুশোচনাও হয়নি। তারা বীরদর্পে বাংলাদেশ বেতারে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে’ বলে ক্রমাগত ঘোষণা দিয়েছে। এই দম্ভের কারণ খুনিরা ভেবেছিল, এদেশ থেকে স্বাধীনতার পক্ষের রাজনীতি অর্থাৎ আওয়ামী লীগের রাজনীতি চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গেল। কিন্তু ইতিহাস তাদের সেই ধারণাকে ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করেছে। বাস্তব যে কখনও কখনও কারও জন্য কঠিন হয়ে আসে, বাঙালি তা-ই লক্ষ করেছে। খুনিরা নিজেরাই ইতিহাসে খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। লোকান্তরিত বঙ্গবন্ধু এখন আরও শক্তিশালী। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন। মনের গভীরে যিনি স্থান পান, তাকে সে স্থানচ্যুত করার শক্তি ও সামর্থ্য কারও থাকে না। বঙ্গবন্ধু এজন্যই জাতির কাছে অমর ও চিরঞ্জীব।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারী সরকারের সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানি ভাবধারাকে পুনরুজ্জীবিত করার অপচেষ্টা চলেছে। যে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানে মুক্তি-সংগ্রামে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, ’৭৫-পরবর্তী সময়ে সেই জয় বাংলা আওয়ামী লীগের স্লোগান হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা চলে। বাংলাদেশ বেতার ‘রেডিও পাকিস্তানের’ মতো ‘রেডিও বাংলাদেশ’ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালি ধর্মনিরপেক্ষতার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, তা ম্লান হতে থাকে।

মানুষ পেয়েও হারায়। বাঙালি হিসেবে আমরা পরম সৌভাগ্যের অধিকারী যে, বঙ্গবন্ধুর মতো মহানায়ককে আমরা পেয়েছিলাম। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, আমরা তাকে পেয়েও হারিয়েছি।

১৫ আগস্টের ঘাতকদের বিচার হওয়ায় দেশবাসী কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ইনডেমনিটি আইন করে খুনিদের বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু জোর করে চাপানো আইন বেশিদিন টেকে না। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাঙালি কখনোই নীরব থাকেনি। খুনিদের বিচারের দাবি মানুষের মন থেকে কখনোই উবে যায়নি। পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুধাবন করে বাঙালি জেগে উঠতে জানে।

বঙ্গবন্ধু মানুষকে সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। রাজনীতির নানা ঘটনা প্রবাহে আমরা থমকে দাঁড়িয়েছি বটে, তবে এখন আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই সোনার বাংলার দ্বারপ্রান্তে। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সোনার বাংলা বিনির্মাণের কাজ অব্যাহত রয়েছে। বিগত শতকের আশির দশকে বঙ্গবন্ধুকন্যা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শেখ হাসিনার আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়। মানুষ আস্থা ও ভালোবাসায় শেখ হাসিনাকে গ্রহণ করেন। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করে জনসাধারণের সেবক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার ব্রত নিয়ে শেখ হাসিনা নিরলস পরিশ্রম করছেন। আমরা লক্ষ করছি যে, এক্ষেত্রেও শেখ হাসিনা অন্ধকারের কুশীলবদের হামলার নিশানায় পরিণত হয়েছেন। তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে অতীতে তার ওপর একাধিকবার হামলা করা হয়েছে। আগস্ট মাসেরই ২১ তারিখে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল। খুনিদের নিশানা থেকে সেদিন তিনি বেঁচে গেলেও আমরা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ স্বনামধন্য অনেক নেতানেত্রীকে হারিয়েছি। এ গ্রেনেড হামলায় জিল্লুর রহমান প্রাণে বেঁচে গেলেও তিনি মারাত্মক আহত হন।

আমরা মনে করি, অন্ধকারের শক্তিরা পরাজিত হয়ে পিছু হটেছে মাত্র। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী সংগ্রামী নেতারা সরকার পরিচালনায় যুক্ত হয়েছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ২০২১ সালের মধ্যে ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ হওয়ার রূপকল্প বাস্তবায়নের পথে। কৃষক, শ্রমিক, চাকরিজীবী মেহনতি- সব মানুষ শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আমরা এখন লক্ষ্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশকে ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। এখন আমরা সেদিকে ধাবমান।

আমরা আগস্টকে মনে রেখে নতুন লক্ষ্যমাত্রার কথা উচ্চারণ করছি এ জন্য যে, এই আগস্ট মাসেই বারবার বাঙালি জাতির স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তারা সুযোগ পেলেই মরণ কামড় দিতে দ্বিধা করবে না। এজন্য আমাদের সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে কোষাধ্যক্ষ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ দৈনিক যুগান্তর

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত