2345
Published on আগস্ট 15, 2021বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম তাঁর ‘বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি’ গ্রন্থে লিখেছেন, “মিলিটারি এখন শাসন করছে, যেমনটা তারা করে এসেছে ১৯৫৮ সালের পর থেকে; সামান্য কিছু বিরতি অবশ্য মাঝখানে ছিল। অবশ্যই মিলিটারি মানে সেনাবাহিনী (The Army); আর মিলিটারি বা সেনাবাহিনীর শাসন মানে সেনা প্রধানের নেতৃত্ব।”[বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি, পৃষ্ঠা ২৯]
বিচারপতি সায়েম ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকও ছিলেন তিনি। ১৫ অগাস্ট রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার পর খুনিচক্রের অন্যতম খোন্দকার মোশতাক আহমদ জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান পদে নিযুক্ত করেন। মিলিটারি শাসন মানেই সেনাপ্রধানের নেতৃত্ব যে! তাই খোন্দকার মোশতাক ‘যোগ্য’ব্যক্তিকেই সেনাবাহিনী প্রধান পদে বেছে নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে ফের পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নিতে জিয়াউর রহমান দীর্ঘ সময় ধরেই সক্রিয় ছিলেন, নিষ্ঠুরতা ও ধূর্ততায় যার জুড়ি মেলা ভার। তিনি ঘাতক ফারুক-রশীদ-ডালিম চক্রকে উৎসাহ দিয়েছেন, আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। পাশাপাশি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিয়ে আসার জন্য।
বিচারপতি সায়েম সামরিক শাসনামলে সেনাবাহিনী প্রধানের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রসঙ্গে লিখেছেন,
১৯৭৬ সালের ২৬ নভেম্বর সোনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমানের হাতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ছেড়ে দিতে হয়। আর পরের বছর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তিনি আমাকে অপমানজনকভাবে সরিয়ে দেন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে।
বিচারপতি সায়েম জিয়াউর রহমানকে তুলনা করেছেন ১৯৭১ সালে নিষ্ঠুর গণহত্যাকারী জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে। তিনি লিখেছেন,
জিয়াউর রহমান ‘একটি স্থায়ী সার্ভিসের অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন এবং সেইসঙ্গে স্থল, নৌ ও বিমান- তিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যেকটির ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। এ সব পদে জেনারেল ইয়াহিয়া বহাল ছিলেন বাংলাদেশের চূড়ান্ত মুক্তি ও বিজয় লাভ করা পর্যন্ত।’ [বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি- পৃষ্ঠা ২২]
এরপরও বিচারপতি সায়েম ভরসা রেখেছিলেন জিয়াউর রহমানের ওপর। তিনি লিখেছেন-
সেনাবাহিনী প্রধান, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান আমাকে ‘নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন, তিনি নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন। কিন্তু আমি তখন ভাবতে পারিনি যে নির্বাচনে তিনি নিজেই অংশ নেবেন। সে রকম ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই এবং সামরিক আইনের অধীনে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবেও, অর্থাৎ ক্ষমতাসীন হয়েই তিনি নির্বাচন করবেন এবং সেই নির্বাচনে নিজে অংশগ্রহণ করবেন এমন চিন্তা তখন আমার মাথায় আসেনি’[পৃষ্ঠা ৩৬]
ক্ষমতালিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য জিয়াউর রহমান প্রবঞ্চনা করেছেন, হিংস্র ও বেপরোয়া হয়েছেন- এ সব বুঝতে আমাদের সমস্যা হয় না।
খুনি মোশতাকের ষড়যন্ত্রের ঘনিষ্ঠ দোসর ছিলেন জিয়াউর রহমান, সেটা স্পষ্ট হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টেই। দু’জনেই বাংলাদেশ বেতারের নাম বদলে পাকিস্তানি কায়দায় ‘রেডিও বাংলাদেশ’ রাখা কেন্দ্রে হাজির হয়েছেন সকালেই, বঙ্গভবনের ‘রাষ্ট্রপতির শপথ’অনুষ্ঠানেও জিয়াউর রহমান সক্রিয়। খোন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার মিটিয়ে দিতে দেরি করেননি- রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ৯ দিনের মাথায় জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান পদে নিয়োগ দেন। ।
জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের পথ অনুসরণ করেন। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে আইয়ুব খান নিজেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ। জিয়াউর রহমান প্রথমে খোন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যূৎ করার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ৭ নভেম্বর রাষ্ট্র ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে নিজেই উভয় পদ গ্রহণ করেন।
ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একের পর এক প্রতিবাদী কর্মসূচি গ্রহণ করতে থাকে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান লেখা হয়। খোন্দকার মোশতাক বঙ্গভবনে জাতীয় সংসদ সদস্যদের সভা ডাকেন, যাদের প্রায় সকলে ছিল আওয়ামী লীগ দলীয়। জাতীয় ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সংসদ সদস্যদের আহ্বান জানান এ প্রহসনের বৈঠক বর্জনের জন্য। আমরা ৪ নভেম্বর (১৯৭৫) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলা থেকে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবন পর্যন্ত শোক মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করি। এ কর্মসূচি কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি, বেতার-টিভিতেও প্রচার পায়নি। আমরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুমে যাই, হাতে হাতে লিফলেট বিলি করি। ধূর্ত জিয়াউর রহমান বুঝতে পারেন, খোন্দকার মোশতাকের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। তিনি নিজেই খবর দিয়ে জাতীয় ছাত্রলীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা ইসমত কাদির গামার সঙ্গে সায়েন্স ল্যাবরেটরি-গ্রিন রোডের সংযোগস্থলের পেট্রল পাম্পে দেখা করে বলেন, ‘আপনাদের আন্দোলনের সঙ্গে আমি রয়েছি। মোশতাককে সরাতে হবে।’ উত্তরে ইসমত কাদির গামা বলেন, ‘খুনিচক্র ও তাদের দোসর সকলকে শুধু ক্ষমতা থেকে অপসারণ নয়, বিচার করতে চাই।’
কিন্তু জিয়াউর রহমান চেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রকে বাঁচাতে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে। ক্ষমতা পুরোপুরি হাতে নেওয়ার পর তিনি খুনিদের বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেন। দেশের ভেতরে দেন ব্যবসার সুযোগ। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক শাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে জিয়াউর রহমানের নির্দেশে শাহ আজিজুর রহমান উত্থাপন করেন সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বিল। এই শাহ আজিজুর রহমান ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে গণহত্যায় সর্বতোভাবে সহায়তা দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান তাকে মুক্তি দিয়ে নিজ দল বিএনপিতে টেনে নেন এবং প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্ব দেন।পঞ্চম সংশোধনীতে ১৫ অগাস্ট নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন ও মুক্তিযুদ্ধের পথ থেকে বাংলাদেশকে সরিয়ে নিতে খুনিচক্র যা যা করেছিল, সবকিছুর বৈধতা দেওয়া হয়। খুনিরা দম্ভ করে বলেছিল- তারাই ‘শেখ মুজিবকে সবংশে হত্যা করেছে।’ খুনিরা এটাও বলত- জিয়াউর রহমান বরাবর তাদের সঙ্গেই ছিলেন।
১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সামরিক আইন বলবৎ ছিল তখন। আওয়ামী লীগের শত শত নেতা জেলে। ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করলেই জেল। বঙ্গবন্ধুর নাম এমনকি আভাসে-ইঙ্গিতেও বলা যাবে না। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল ১৫ অগাস্ট থেকেই। সরকারবিরোধী মিছিল-সমাবেশ করার অধিকার ছিল না। ত্রিশ লাখ নারী-পুরুষ-শিশুর আত্মদানে অর্জিত বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ যায়। সমাজতন্ত্র বর্জন করা হয়। একাত্তরে পাকবাহিনীর গণহত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের প্রত্যক্ষ সহযোগী রাজাকার-আলবদর ও তাদের দল জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগকে রাজনীতি করার অধিকার দেওয়া হয়। জিয়াউর রহমান সহজেই জয়ী হন প্রহসনের এ নির্বাচনে।
পঞ্চম সংশোধনীতে ১৫ অগাস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, খুনিদের বিচার না করার কুখ্যাত বিধান- ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি প্রদান, জিয়াউর রহমানের একক সিদ্ধান্তে সংবিধান সংশোধন, গণভোটের প্রহসন সব বৈধতা পায়।
বঙ্গবন্ধুসহ নারী-শিশুদের খুনিদের বিচার করা যাবে না- ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামে পরিচিত এ বিধান জারি করেছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ। ১৯৭৮ সালের ৩ জুনের রাষ্ট্রপতি ও ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির পার্লমেন্ট নির্বাচনের পর সব অপরাধ হালাল করা হয়ে গেছে ‘সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর’ মাধ্যমে। তবে ১৫ অগাস্ট ও ৩ নভেম্বরের প্রত্যক্ষ ঘাতকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আরও কিছু দায় ছিল জিয়াউর রহমানের। এরা তো তারই লোক। তার হয়েই কাজ করে দিয়েছে। খুুনিদের কেউ যেন কখনও বিচার করতে না পারে, সে জন্য ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই জাতীয় সংসদে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরের কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটিকে আরেক দফা অনুমোদন দিয়ে আইনে পরিণত করা হয়।
বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছ থেকে দেখা’ গ্রন্থে লিখেছেন,
পরিকল্পনা কমিশনে দায়িত্ব পালনকালে দেখেছেন দেশের বিরাজমান পরিস্থিতির ব্যাপারে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমানের গভীর আগ্রহ ছিল। সেনাবাহিনীর সীমিত গণ্ডির বাইরেও সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। [পৃষ্ঠা ৫৫]
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম লিখেছেন,
১৯৭৪ সালে চোরাচালন বন্ধে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। এ সময়ে জিয়াউর রহমান তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানান, ভারতে ৫ থেকে ১০ লাখ টনচাল পাচার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর বাজেয়াপ্ত করা পণ্যের তালিকা থেকে দেখা যায়, চোরাচালানের ক্ষেত্রে চালের তেমন গুরুত্বই নেই। যদি বাস্তবেই চাল ব্যাপক হারে চোরাচালান হতো জনসাধারণ, বাংলাদেশ রাইফেলস ও সেনাবাহিনীর তা চোখ এড়াতে পারত না। কিন্তু আমাদের আলোচনায় জিয়াউর রহমান সন্তুষ্ট হননি। [পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭]
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম লিখেছেন,
জিয়াউর রহমানের সামাজিক জীবন ক্যান্টনমেন্টের বাইরেও বিস্তৃত ছিল। বেসামরিক সমাজের সঙ্গেও তিনি সম্পর্ক রাখতেন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় বেতন কমিশন গঠন করলে জিয়াউর রহমান ও সাইফুর রহমানকে তার সদস্য করা হয়। পরবর্তীকালে সাইফুর রহমানকে তিনি প্রথমে বাণিজ্যমন্ত্রী ও পরে অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। [পৃষ্ঠা ৫৮]
অধ্যাপক নুরুল ইসলামের গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি, ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে জিয়াউর রহমান জিয়াউল হক নামে এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে জানান, ‘দেশের সাধারণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহী।’ [পৃষ্ঠা ৫৯]
দুই জনের বৈঠকের আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন,
দেশের রাজনীতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে সেনাবাহিনীর একজন জেনারেলের এই মাত্রায় আগ্রহ পরিষ্কারভাবেই একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। …আমার মনে হয়েছিল শিগগিরই যে একটি পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে যখন তিনি সামরিক সরকার প্রধান হলেন, তখন মনে হলো অর্থনৈতিক,সামাজিক ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান আহরণ এবং সমাজের বিভিন্ন অংশের ও স্তরের লোকজনের সঙ্গে তাঁর ওই মেলামেশা ছিল হয়তো ভবিষ্যতে কোনো দিন যদি তাঁর ওপর দেশ শাসনের দায়িত্ব পড়ে, তার জন্য প্রস্তুতি। [পৃষ্ঠা ৬০-৬১]
খোন্দকার মোশতাক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন, এটা আমাদের জানা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকাশিত গোপন দলিলেও এর উল্লেখ রয়েছে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল যায় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পক্ষে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কথা বলার জন্য। এ দলের নেতৃত্ব প্রদানের কথা ছিল খোন্দকার মোশতাক আহমদের। কিন্তু তিনি স্বাধীনতা প্রশ্নে কোনো বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিতে পারেন এবং এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গে আপসের কথাও বলতে পারেন, এমন ধারণা থেকে তাকে এ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম লিখেছেন,
খোন্দকার মোশতাক যে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এটা বঙ্গবন্ধু জানতেন এবং নানাভাবে সেটা বুঝিয়েও দিতেন। ১৯৭৪ সালের মে মাসে ভারত সফরকালে রাষ্ট্রীয় ভোজের আগে ঠাট্টাচ্ছলে ইন্দিরা গান্ধীকে উদ্দেশ্য করে মোশতাককে দেখিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, মোশতাকের সঙ্গে আমার মধুর সম্পর্ক- আমার ‘শালা’। বাংলাদেশে শ্যালক-ভগ্নিপতির সম্পর্ক খুবই মধুর। ইন্দিরা গান্ধীসহ আমরা জানতাম, দু’জনের মধ্যে আত্মীয়তার কোন সম্পর্ক নেই। আমি পাশেই ছিলাম, বুঝতে পারি দু’জনের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। [পৃষ্ঠা ৫০]
দিল্লি থেকে ফেরার পথে বিমানে বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সামনেই বলেন, গতরাতে একটি অদ্ভূত স্বপ্ন দেখেছি- সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাকে হজরত ইব্রাহিমের (আ.) মতো সবচেয়ে প্রিয় লোককে কোরবানি দিতে বলেছেন। অনেক চিন্তার পর আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি- এ প্রিয় ব্যক্তি অবশ্যই মোশতাক। [পৃষ্ঠা ৫৩]
ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান ১৯৭৫ সালের ১৪ অগাস্ট সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরীর সঙ্গে গণভবনে গিয়েছিলেন পরদিনের কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনার জন্য। খোন্দকার মোশতাক সেখানে ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুকে বলছেন- পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচিতে যেতে পারবেন না। সকালে কুমিল্লা যেতে হবে ‘তিনসনি’কিছু কৈ মাছ ধরা পড়েছে, আপনার জন্য নিয়ে আসব। উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, কৈ মাছ আনতে কি তোর যেতে হবে? ‘চোরা’, তুই নতুন কী ষড়যন্ত্র করছিস?
প্রকৃতপক্ষে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই গণভবনে খোন্দকার মোশতাক গিয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই।
খোন্দকার মোশতাককে কেন্দ্র করে সক্রিয় চক্র এবং জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চাভিলাষী ও নেতৃত্বলোভী অফিসার ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বাংলাদেশকে ভ্রান্ত পথে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তাদের এই অশুভ আঁতাতে মদদ মেলে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা বা সিআইয়ের। বিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ, গণতন্ত্র উন্নয়নের পথে চলার স্বপ্ন মিলিয়ে যায়। এ থেকে উদ্ধার পেতে কঠিন সংগ্রাম শুরু হয়, যা চলে দুই দশকেরও বেশি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ, তিনি এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন এবং সফল হন। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনিদের বিচারে সোপর্দ করেন এবং কয়েকজনের দণ্ড কার্যকর করা হয়। কিন্তু ঘাতকদের যারা পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছে এবং পরে নিজেরাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েছে, যাদের কারণে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে সরে গিয়েছিল এবং একাত্তরের গণহত্যাকারী ও ধর্ষকরা পুনর্বাসিত হয়েছিল, যাদের কারণে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নযনের ধারা থেকে পিছিয়ে পড়ে যারা এখনও বিচারের আওতায় আসেনি। মরণোত্তর হলেও এই বিচার এখন সময়ের দাবি এবং সন্দেহ নেই যে এমন উদ্যোগে জিয়াউর রহমান ও খোন্দকার মোশতাক আহমদের নাম থাকবে সবার ওপরে।
লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক
সৌজন্যেঃ bdnews24