বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড : ক্রীড়নক ও হন্তারকদের মনঃতত্ত্ব

871

Published on আগস্ট 12, 2021
  • Details Image

আসিফ কবীর:

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা ছিল ‘হাইলি মোটিভেটেড’। আমাদের নিকট অতীতে দেখা হলি আর্টিজানে যেমন মোটিভেটেড একদল দুর্বৃত্ত হামলা চালায় ও নিরীহ মানুষদের বেঘোরে হত্যা করে (১লা জুলাই ২০১৬, নিজেদের প্রত্যক্ষ করা এ নৃশংস ঘটনা পরিক্রমা থেকে মোটিভেশন: মগজ ধোলাই’র তীব্রতা ও কুফল বুঝতে সরণ নিতে পারি)। থাইল্যান্ডের মার্কিন দূতাবাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় চাইতে দেনদরবার চালানোকালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের মূল্যায়নে ব্যাংককে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত চার্লস এস হোয়াইটহাউসের স্বাক্ষরিত তারবার্তায় বলা হয় ফারুককে আমাদের কাছে খুবই মোটিভেটেড মনে হয়েছে। তবে রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকে সে বেশ বিভ্রান্ত। (২৪৫৩৬ নং প্রতিবেদন)

মার্কিন অবমুক্ত করা গোপন নথির ভিত্তিতে বলা যায় বঙ্গবন্ধুর খুনীরা ভেঙ্গে যাওয়া দুই পাকিস্তানকে একত্রীকরণে কাজ করছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল (অব.) এম. এ হামিদ, পিএসসি। তার গ্রন্থ- তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ এ তিনি লিখেছেন- বঙ্গবন্ধু হত্যায় তিনি দেশের বাইরের কোন ইন্ধন ছিল বলে তিনি মনে করেন না। (১৬ সংখ্যক (নং) অনুসন্ধান, ১০৮ পৃ:, নবম সংস্করণ, হাওলাদার প্রকাশনী)।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেশের রাষ্ট্রপতি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা সর্বজনমান্য ব্যক্তিকে সপরিবারে হত্যা করতে হবে এমন চিন্তার সূত্রপাত কোত্থেকে বা এমন ভাবনা মাথায় এলো কেন? এই প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান করাই আমাদের আজকের আলোচনার মূল লক্ষ্য হবে।

পরবর্তীতে হত্যাকারীরা তাদের দেয়া সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন স্থানে বলেছে, তারা হত্যার উদ্দেশ্যে যায়নি, ‘ . . . অপ্রস্তুত সৈন্যরা এতে হতভম্ভ হয়ে পড়ে। . . . শেখ মুজিব আমাদের প্রস্তাবে রাজি হলে ১৫ আগস্টের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত।’ বা জাতির পিতার পরিবারে সদস্যদেও হত্যার বিষয়ে সাফাই দিয়ে বলেছে, ‘ বন্ধ দরজায় এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণের সময় অন্যদের সঙ্গে সে (শেখ রাসেল, দশ বছর বয়সে শহিদ) মারা যায়।’ [১৫ই আগস্ট ১৯৯২ বাংলাবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ফারুক রহমানের সাক্ষাৎকার]

অর্থাৎ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দূরবর্তী ও কোনরকম প্রভাবমুক্ত অবস্থায়ও হত্যাকারীদের অন্যতম একজন নিজেদের দায় ঢাকতে এমন কথা বলেছে। কারণ, যতই দম্ভোক্তি তারা করুক, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড যে ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনা, সেটি তাদেরও উপলব্ধির বাইরে ছিল না।

একই সাক্ষাৎকারে ফারুক রহমান বলে, ‘শেখ মুজিবকে সুকর্নর মতো বন্দী করে নির্বাচনের মাধ্যমে নয়া সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছি, কিন্তু কোন কূল পাইনি।’ তার মানে হল, ১. বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা এতই আকাশ ছোঁয়া এবং ব্যক্তিত্ব প্রবাদ প্রতীম ছিল যে, তাঁকে কারান্তরীণ বা নির্বাসনে পাঠিয়েও প্রতিপক্ষ নিশ্চিত হতে পারত না। ২. তাঁর যে কোন উপায়ে জীবনাবসান ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতার অন্য কারো অধিষ্ঠান দেশের মানুষ মানবে না। অবশ্য ব্যাংককের মার্কিন দূতাবাস থেকে প্রেরিত প্রতিবেদনে দেখা যায় তারা ভেঙ্গে যাওয়া পাকিস্তান একত্র করতে কাজ করছিলো। অর্থাৎ রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ ছাড়াও দেশের অনুসৃত মূলনীতি, আদর্শ ও গতিধারার বাঁকবদল এই হত্যা পরিকল্পনার সাথে সম্পর্কিত ছিল।

৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫, ব্লেয়ার হাউস, ওয়াশিংটনে ঐদিন স্থানীয় সময় বেলা আড়াইটায় কিসিঞ্জার-ভুট্টোর প্রায় ঘন্টাখানেক বৈঠক হয়। বৈঠকে ভুট্টো কিসিঞ্জারকে তার প্রশ্নের জবাবে বলেন মুজিব সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে তিনি সন্দিহান। কিসিঞ্জার যোগ করেন সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করবে। ভুট্টো সহমত প্রকাশ করেন। ভুট্টো এ আলোচনায় বলেন, আমরা চীনকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের তাদের যে সম্মতি ও উদ্যোগ তা স্থগিত রাখতে অনুরোধ করেছি।

১৯৭৩ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস থেকে পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো রিপোর্টে বলা হয়: ভুট্টো চীনকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের বাইরে রাখতে (আপাত:) সফল হয়েছে। সৌদি আরব ও জর্ডানের মতো ঐতিহ্যগত মিত্র দেশগুলোর পাশাপাশি আলজেরিয়া, লিবিয়া প্রভৃতি মুসলিম দেশগুলোর সাথে পাকিস্তান সম্পর্ক উষ্ণ করছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান, যুদ্ধবন্দী ফেরত ও ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার বিলম্বিত করা এ সম্পর্কোন্নয়নের মূল উদ্দেশ্য।

ইসলামাবাদ থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হেনরি আলফ্রেড বাই রোড ১৮ই আগস্ট এক তারবার্তায় (১৯৭৫ ইসলামা ০৭৫৪৫) লিখেছেন: একাত্তরে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ ঘোষণার মধ্যদিয়ে যে দ্বিজাতিতত্ত্বের মৃত্যু ঘটেছিল, তা আবার পুনরুজ্জীবিত হওয়ায় ইসলামাবাদ আনন্দে উদ্বেল হয়ে পড়ে।

প্রশ্ন জাগে এখানে, যে মুক্তিযোদ্ধা নামধেয় খুনীরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়, তারা পরাজিত পাকিস্তানের চেতনাগত (পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন গঠন বললেও অত্যুক্তি হয় না) উত্থানের সহযোগী হয় কেমন করে? প্রসঙ্গত: সরকার সাম্প্রতিক তাদের প্রদত্ত মুক্তিযুদ্ধের খেতাব বাতিল করেছে।

১৯৭২ সালে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম হন্তারক ফারুক রহমান অস্ত্র সংগ্রহে যায়। এরপর ১৯৭৩, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালেও একাধিকবার ফারুক ও রশিদ মার্কিন দূতাবাসে গেছে।

১৯৭৪ সালের ১৩ই মে ফারুক রহমান মার্কিন দূতাবাসের ‘জনসংযোগ কর্মকর্তা’ গ্রেশামের বাসায় উপস্থিত হয়ে জানায়, সে ‘উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার নির্দেশে’ মার্কিন মনোভাব জানতে এসেছে।

এর আগে ১৯৭৩ সালের ১১ জুলাই খন্দকার আব্দুর রশিদ (ফারুকের ভায়রা) মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে বলেছিল: (তৎকালীন) ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে অস্ত্র সংগ্রহে একটি কমিটি গঠন হয়েছে। তাই সে বিভিন্ন বৈদেশিক মিশন থেকে সমরাস্ত্রের কারিগরি দিক ও দাম জানতে এসেছে। লক্ষণীয় যে, তদানীন্তন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ প্রকৃতপক্ষে অস্ত্র ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি ছিলেন। জিয়াউর রহমান নয়। খন্দকার মোশতাক আহমেদের সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনই মার্কিনী যোগাযোগ ছিল। জিয়াউর রহমানও তার নিজের মত করে মার্কিন মনোভাব জেনেছিল। এখানে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের অনতিপর থেকেই বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র চলে আসছিল। সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব বা সমালোচনায় বিদ্ধ করার যে প্রয়াস নেয়া হয়, সেগুলি অনায়াসে নাকচ হয়ে যায়।

আমরা আরও লক্ষ্য করি, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে যেসব দেশ খুশী ছিল না, খুনী চক্র তাদের পাশে পেতে, বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তীতে মোশতাক সরকার স্বীকৃতি লাভে অথবা তারা পাশে থাকবে ভেবে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে চেষ্টা করেছে। মার্কিন সরকার বা দূতাবাস খুনীদের পেশাগত শৃঙ্খলা পরিপন্থী যোগাযোগ বা অভ্যুত্থান চেষ্টার খবর বঙ্গবন্ধু সরকারকে জানানোর শিষ্টাচার দেখায়নি।

২২শে আগস্ট ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার পররাষ্ট্র দপ্তরে প্রেরিত রিপোর্টে লিখেন : আমরা বুঝতে পারি যে রেডিও বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান বর্জন করেছে। ব্যতিক্রমটুকু শুধু এখনো জাতীয় সংগীতেরই বেলায় (যা আইয়্যুব খানও পাকিস্তানি আমলে করেছিলেন)।

অন্যদিকে বাইরোড ইসলামাবাদ থেকে ওয়াশিংটনে লিখেন: জামায়াতে ইসলামীর আধ্যাত্মিক নেতা মাওলানা মওদুদি মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণকে ‘আল্লাহর আশীর্বাদ’ ও ‘ইসলামের বিজয়’ বলেছে।

... ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থান হিসাবনিকাশ সমূলে বদলে দিয়েছে। শেখ মুজিব সম্পর্কোন্নয়নে পাকিস্তানের সে আকাঙ্ক্ষাকে তিরোহিত করেছিল, তাকে সঠিক ধারায় আনতে পাকিস্তান এখন ব্যস্ত।

... পাকিস্তান সরকার মনে করে যে ১৫ই আগস্টের ঘটনা একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ এবং দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি ও সমর্থন জানিয়ে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, খন্দকার মোশতাক আহমেদের কাছ থেকে তার প্রতিউত্তর পেয়ে তারা সন্তুষ্ট।

অন্যদিকে, কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় বোস্টারকে মুজিব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে একটি সংবাদ ছাপা হয়। বোস্টারকে সিআইএর লোক হিসাবে গণ্য করা নিয়ে দিল্লী-ওয়াশিংটন সম্পর্কের উষ্ণতা লোপ পায়। ঢাকা ডেটলাইনে সংবাদটির শিরোনাম ছিল : ‘চিলির আসল খলনায়ক এখন ঢাকায়’ ; বিবরণীতে বলা হয়, চিলিতে আয়েন্দের বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর পটভূমি তৈরীর সময় (১৯৭৩) বোস্টার ছিলেন সেখানকার মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দি এফেয়ার্স।

প্রাসঙ্গিক হবে যে, ২১শে ডিসেম্বর ১৯৭২ সিআইএ’র বাংলাদেশ রিপোর্টে বলা হয়, সরকার পরিবর্তন হবে এক আকষ্মিক আঘাতে। মুজিবের উত্তরসূরি তাঁর দল থেকেই আসবে। সিআইএ, এন আই সি ফাইলস, জব ৭৯-আর ০১০১২। এত আগে এমন কথা বলা সম্ভব তখনই, যখন ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার শুরু হয়ে যায়। এবং সেটা স্বাধীনতা লাভের প্রথম বছরেই, দেখতে পাই।

২২শে আগস্ট ১৯৭৫ প্রাভদা পত্রিকার নিবন্ধে ১৫ই আগস্টের ঘটনার তীব্র নিন্দা করা হয়। প্রাভদায় পর্যবেক্ষকের ছদ্মনামে প্রকাশিত নিবন্ধে সোভিয়েত অনুসৃত নীতির প্রকাশ ঘটে। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের উপর শ্রদ্ধাবনত আলোকপাতের পর উল্লেখ করা হয় বঙ্গবন্ধুর ও তাঁর পরিবারে হত্যাকারী “কসাইদের” বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে ‘বৈধ আক্রোশ’ (লেজিটেমেট ইনডিগনেশন) ছড়িয়ে পড়ছে। তাঁর বিয়োগান্তক ঘটনায় সোভিয়েত জনগণ তীব্র শোক প্রকাশ করছে।

আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনাটির একদিন পর ১৬ই আগস্ট কলকাতায় মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়। ভারতীয় পত্রপত্রিকা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর প্রকাশ করে। এর কয়েকদিনের মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সফররত মার্কিন সিনেটর টমাস এফ ইগলটনের কাছে ব্লিৎজ পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু হত্যায় সিআইএ’র সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে প্রকাশিত নিবন্ধ চাঞ্চল্যকর বলে মন্তব্য করেন। বোম্বের বামপন্থী সাপ্তাহিক ক্ল্যারিটি ২৩শে আগস্ট ১৯৭৫ প্রথম পৃষ্ঠায় নিবন্ধের শিরোনাম করে ‘বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে সিআইএ’।

ভারত মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে কোন উদ্যোগ নেয়নি। উল্লেখ্য ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেন বঙ্গভবনে মোশতাাকের সাথে সাক্ষাৎ করে একটি নোট ধরিয়ে অনুসরণের জন্য কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে থেকে চাপ দেন। যা বঙ্গভবন ভিন্নভাবে প্রচার করে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে বলেন : আমি রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা কিংবা রাজনৈতিক খুন, বিশেষ করে যাঁরা তাঁদের জাতির জন্য বড় অবদান রেখেছেন তাঁদের হত্যার ঘোরতর বিরোধী। ... শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে আমি গভীরভাবে শোকাহত। লঙ্কা সম সমাজ পার্টি সরকারের শরিক দলগুলির অন্যতম ছিল। ১৮ই আগস্ট তারা এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য নতুন শাসকদের সমালোচনা করে। শ্রীলঙ্কার আথাথা নামীয় সংবাদপত্রে একইদিনে সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে ‘নিষ্ঠুর এবং অমানবিক হত্যাযজ্ঞ’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়। তারা নির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করে মুজিব উৎখাতের ঘটনায় মার্কিন পিএল ৪৮০ তহবিল অর্থায়ন করে। পত্রিকাটি মনে করে: বাংলাদেশের ঘটনা দক্ষিণ এশীয়াকে অস্থিতিশীল করা ও এখানকার সরকার উৎখাতের সামাজ্যবাদী চক্রান্তের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভুটান ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে।

বঙ্গবন্ধুর হন্তারকরা ৪ঠা নভেম্বর ১৯৭৫ ব্যাংকক পৌঁছায়। তাদের মুখপাত্র ফারুক রহমান সেখানে প্রেসকে বলে: মেজর জিয়াউর রহমান ঢাকায় পুরো ক্ষমতা দখলের পর (৭ নভেম্বরের পরে) বাংলাদেশে আমার ফেরার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। ব্যাংককে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হোয়াইটহাউস নিজ দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরে লেখেন : আমরা যদি তাদের (খুনীদের) অবস্থানের মেয়াদ বাড়াতে বলি তাতে থাই সরকার ভাববে এই আশ্রয়প্রার্থী হন্তারকদের সাথে বাংলাদেশে আমরাও জড়িত ছিলাম। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার মুখে হেনরি কিসিঞ্জার ২৭৫৮৭৪ বার্তায় ব্যাংককের মার্কিন দূতাবাসকে নির্দেশনা দিয়ে বলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেবে না। ভিসার জন্য আবেদন করলে নিয়ম অনুযায়ী দেখা হবে। এদিকে প্রেসিডেন্ট আবু সাদ’ত মোহাম্মাদ সায়েমের (মুখ্য) সচিব মাহবুব আলম চাষী এবং নতুন পররাষ্ট্র সচিব তবারক হোসেন বোস্টার ও ডেপুটি চীফ অফ মিশনের সাথে ১৭ই নভেম্বর কথা বলে। তারা যুক্তরাষ্ট্রে খুনীদেও আশ্রয়ের জন্য অনুরোধ করে। অন্যথা থাইল্যান্ডকে আশ্রয়দানে অনুরোধ করতে বলে। অন্যদিকে তবারক হোসেন ঢাকার মার্কিন দূতাবাসকে আরও জানায় লাতিন আমেরিকার কোন দেশকে রাজি করাতে চেষ্টা করছে তার সরকার। হন্তারকদের আশ্রয় না দেয়ার ব্যাপারে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে চিঠি দিয়েছিলেন। এদিকে ৬ই নভেম্বর বনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (সম্ভবত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী) জার্মানীকে অনুরোধ জানান, খুনীদের আশ্রয় না দেয়ার। ঢাকার জার্মান রাষ্ট্রদূত মি. রিটার একই সুপারিশ করেন তার দেশকে। খুনীরা ২৪ নভেম্বর বেনগাজী, লিবিয়ায় পৌঁছান। সেখানে ফারুক এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলে: তার সরকার ও জনগণ যাদের বিরুদ্ধে (ভারত) লড়াই করছিল, বাংলাদেশ এখন সেসব শত্রুবেষ্টিত। এই সংগ্রামে পাশে দাঁড়াতে ‘মুসলিম ভাইদের’ আহ্বান করি।

ইতিহাস নিষ্পন্ন যে সিআইএ আয়েন্দের উৎখাতের জন্য তিনটি গ্রুপকে সমর্থন দিয়ে চলছিল। সেই আলোকে সন্দেহ জাগে মুজিব সরকারের উৎখাতে এদেশেও একাধিক গ্রুপকে সক্রিয় রেখেছিল কিনা। গবেষক, সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ১৯৯২ সালে ফারুক রহমানের নেয়া সাক্ষাৎকারে এমনই একটি লিড পান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সমসাময়িক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদেশী রাজনীতিক, সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান হত্যায় মদদদানের অভিযোগে মার্কিন কংগ্রেসই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। এসময় সিআইএ ও এফবিআই’র উদ্দিষ্ট বিষয়ে গোপন তৎপরতার অনুসন্ধানে দুটি কমিটি গঠিত হয়। একটির নেতৃত্বে ছিলেন সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ। এ কমিটি তার প্রধানের নামে চার্চ কমিটি হিসাবে পরিচিতি পায়। অপর কমিটিটি সিনেট কর্তৃক গঠিত ইন্টেলিজেন্স কমিটি, যার পরিচিতি পাইক কমিটি হিসাবে। দুটি কমিটিই আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭৫ সালে। তবে সর্বাত্মক অসহযোগিতার মুখে তাদের কোন সাফল্য নেই।

মার্কিন অবমুক্ত করা নথির নিরিখে বলা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দেশ সমূহ বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু পরবর্তী সময়ে দ্রুত স্বীকৃতি দেয় শুধুমাত্র ‘ইসলামের’ নামে স্বার্থোদ্ধারকারী নতুন সরকারকে ক্ষমতায় স্থায়ীকরণের আশায়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এ প্রক্রিয়ায় আবার বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কনফেডারেশন গঠনের তার যবনিকা ঘটা স্বপ্নের পুনরুত্থান ঘটিয়ে যুথবদ্ধ (!) পাকিস্তানের অলীক কল্পনায় বেশ খানিকটা অগ্রসর হয়ে যায়। তার নতুন সরকারকে প্রেরিত শুভেচ্ছা বার্তায় এর ইঙ্গিতও মেলে। সেখানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম মনগড়াভাবে উল্লেখ করেন।

রজার মরিস, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে হেনরি কিসিঞ্জারের স্টাফ অ্যাসিস্টেন্ট ছিলেন। তার একটি মূল্যায়ন এ আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। তা হল, কিসিঞ্জার মনে করতো বাংলাদেশের ঘটনাবলি তার জন্য একটি ব্যক্তিগত পরাজয়। একজন নির্বাসিত, নির্যাতিত নেতা হিসাবে মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একটি ট্যাঙ্কে চেপে কাস্ত্রোর (ফিডেল কাস্ত্রো) হাভানায় পৌঁছানোর পর বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন স্বদেশে ফেরা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রতি দ্বিতীয় বৃহৎ চপেটাঘাতের একক ঘটনা।

আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পর্ব থেকেই। স্বাধীনতা অর্জনের অনতিপরে ১৯৭২ সালেই সরকার উৎখাতের চেষ্টা শুরু, সিআইএর আগাম ভবিষ্যদ্বানী এবং ভুট্টোর আত্মবিশ্বাসী মন্তব্য থেকে ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত, সূদুর গ্রোথিত শিকড় ও সঙ্গীয় শক্তিসমূহের ধারণা লাভ হয়। একটি সদ্য স্বাধীনদেশে সহস্র সীমাবদ্ধতা আর সতত পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু সরকারকে সমালোচনায় বিদ্ধকারী নিন্দুকরা যে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য ছিল তা বলাই চলে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্রপ্রস্তুতে কাজ করা ব্যক্তি বা মহল যে কতটা অবিবেচক ছিল তা বুঝতে পারা যায় জাতিসংঘের একজন সুইস নাগরিক কর্মকর্তার স্বতঃপ্রণোদিত উদ্যোগে।

জাতির পিতা যখন যুদ্ধের ধকল কাটিয়ে তাঁর ঈস্পিত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই ভেঙ্গে যাওয়া দুই পাকিস্তানকে একত্রীকরণের দুরভিসন্ধি নিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে। এই আঘাত শুধু জাতির পিতা বা তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে হানা হয়নি, এ আঘাত প্রকৃতপক্ষে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে। জাতিসংঘের তদানীন্তন আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল ড. ভিক্টর এইচ উমব্রিখট মার্কিন সরকারের প্রতি খুনীদের আশ্রয় না দেয়ার আহবান জানিয়ে ১৭ নভেম্বর ১৯৭৫ এক পত্রে লেখেন: গত বার মাস ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিরাট উন্নতি ঘটেছিল। ভালো খাদ্য পরিস্থিতি, বৃহত্তর খাদ্য মজুদ, ব্যাপক রপ্তানী ও ঘাটতি বিহীন বাজেটও ছিল। ছিল জনহিতকর কর্মসূচি, জনবান্ধব প্রশাসন প্রভৃতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের উত্তম অংশটিকে কেন নির্মূল করা হল, তা উপলব্ধি করা দুরূহ।

এই অল্প কথার চিঠিটি থেকে মূর্ত ও বিমূর্তভাবে (কিংবা বলতে পারি বিটউইন দি লাইনস: দুই চরণের মাঝের অব্যক্ত বক্তব্যে) পাঠকের বুঝতে বাকী থাকে না যে কতটা অপরিমিত অন্যায় অপপ্রচার চালানো হয় বঙ্গবন্ধু সরকার উৎখাাতের ক্ষেত্রপ্রস্তুত এবং এই মহাপুরুষের জীবনাবসানের পরও বহুকাল পর্যন্ত। অধিকন্তু জাতির পিতাকে পরিবারের সদস্যদের সহ হত্যা করায় কী নিদারুন গ্লানি বহন করে চলতে হয় সমগ্র জাতির। যা ইনডেমনিটি কালো আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মাধ্যমে কিছুটা লাঘব হয়।

তথ্য ঋণ: ওয়েবসাইটে অবমুক্ত মার্কিন গোপন নথি; মিজানুর রহমান খান, মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড; উইকিলিকস্।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত