3210
Published on আগস্ট 3, 2021অজয় দাশগুপ্ত:
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- কাছ থেকে দেখা’ গ্রন্থ লিখেছেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, যিনি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫ সালের প্রথম কয়েক মাস পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন- কিন্তু ‘রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার মানসিকতা এবং উৎসাহ বা প্রবণতা কোনোটাই আমার নেই। [পৃষ্ঠা ৩৯]
বঙ্গবন্ধু তাকে বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তবে দু’জনের একসঙ্গে কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পরপরই। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৬৯ সাল থেকে আমার অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে মিলে আমি বিশেষভাবে জড়িত ছিলাম যে বিষয়গুলোতে তা হলো : ছয় দফার বিষদ বিশ্লেষণ, ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের নির্দেশমালা তৈরি এবং পাকিস্তানের সম্ভাব্য নতুন সংবিধান নিয়ে যাঁরা বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন, তাদের পরামর্শ দেওয়া।’ [‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- কাছ থেকে দেখা’ গ্রন্থের ভূমিকার প্রথম পৃষ্ঠা]
এ সময়েই খোন্দকার মোশতাকে সঙ্গে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের পরিচয়। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে পরিচয় পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বে থাকার সময়। তিনি বঙ্গবন্ধুকে যেমন কাছ থেকে দেখেছেন তেমনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ষড়যন্ত্র ও তা বাস্তবায়নের হোতাদেরও দেখেছেন। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত এই গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে এর বিবরণ।
তিনি লিখেছেন, ‘ছয় দফা আসলে স্বাধীনতার পথে বিরাট একটি পদক্ষেপ। ...পাকিস্তানিরা বুঝতে ভালভাবেই পেরেছিল এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে নামেই কেবল পাকিস্তান এক দেশ থাকবে।’[পৃষ্ঠা ২৪]
তিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যদের মধ্যে সংবিধান ও ছয় দফা নিয়ে আলোচনার পর্যায়ে ‘আমাদের অতি গোপনীয়’ বিষয় লাহোরের একটি পত্রিকায় ফাঁস হয়ে যায়। আমাদের কেউ কেউ খোন্দকার মোশতাককে সন্দেহ করি। এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা ঠেকাতে সংঘবন্ধ পরিকল্পনার সুযোগ পাবে। [পৃষ্ঠা ২৬]
খোন্দকার মোশতাক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলকালে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন, এটা আমাদের জানা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকাশিত গোপন দলিলেও এর উল্লেখ রয়েছে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল যায় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পক্ষে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কথা বলার জন্য। এ দলের নেতৃত্ব প্রদানের কথা ছিল খোন্দকার মোশতাক আহমদের। কিন্তু তিনি স্বাধীনতা প্রশ্নে কোনো বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিতে পারেন এবং এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গে আপসের কথাও বলতে পারেন, এমন ধারণা থেকে তাকে এ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম লিখেছেন, খোন্দকার মোশতাক যে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এটা বঙ্গবন্ধু জানতেন এবং নানাভাবে সেটা বুঝিয়েও দিতেন। ১৯৭৪ সালের মে মাসে ভারত সফরকালে রাষ্ট্রীয় ভোজের আগে ঠাট্টাচ্ছলে ইন্দিরা গান্ধীকে উদ্দেশ্য করে মোশতাককে দেখিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, মোশতাকের সঙ্গে আমার মধুর সম্পর্ক- আমার ‘শালা’। বাংলাদেশে শ্যালক-ভগ্নিপতির সম্পর্ক খুবই মধুর। ইন্দিরা গান্ধীসহ আমরা জানতাম, দু’জনের মধ্যে আত্মীয়তার কোন সম্পর্ক নেই। আমি পাশেই ছিলাম, বুঝতে পারি দু’জনের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। [পৃষ্ঠা ৫০]
দিল্লি থেকে ফেরার পথে বিমানে বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সামনেই বলেন, গতরাতে একটি অদ্ভূত স্বপ্ন দেখেছি- সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাকে হজরত ইব্রাহিমের (আ.) মতো সবচেয়ে প্রিয় লোককে কোরবানি দিতে বলেছেন। অনেক চিন্তার পর আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি- এ প্রিয় ব্যক্তি অবশ্যই মোশতাক। [পৃষ্ঠা ৫৩]
ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুবজামান ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরীর সঙ্গে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরদিনের কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনার জন্য। গণভবনে গিয়ে দেখেন খোন্দকার মোশতাক সেখানে রয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে বলছেন, পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচিতে যেতে পারবেন না। সকালে কুমিল্লা যেতে হবে ‘তিনশনী’ কিছু কৈ মাছ ধরা পড়েছে, আপনার জন্য নিয়ে আসব। উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, কৈ মাছ আনতে কি তোর যেতে হবে? ‘চোরা’, তুই নতুন কী ষড়যন্ত্র করছিস?
প্রকৃতপক্ষে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই গণভবনে খোন্দকার মোশতাক গিয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই।
মোশতাকের ষড়যন্ত্রের ঘনিষ্ঠ দোসর ছিলেন জিয়াউর রহমান, সেটা স্পষ্ট হয় ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ৯ দিনের মাথায় তিনি জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান পদে নিয়োগ দেন। এর আগে ১৫ আগস্ট সকালে খোন্দকার মোশতাকের প্রতি সরাসরি সমর্থন জানাতে জিয়াউর রহমান ঢাকা বেতার কেন্দ্র ও বঙ্গভবনে উপস্থিত হয়েছিলেন।
জিয়াউর রহমান আইয়ুব খানকে অনুসরণ করেন- ইস্কান্দার মির্জাকে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে নিজেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ। জিয়াউর রহমান প্রথমে খোন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যূৎ করার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ৭ নভেম্বর রাষ্ট্র ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে নিজেই উভয় পদ গ্রহণ করেন। বঙ্গভবনের শেষ দিনগুলি গ্রন্থে বিচারপতি সায়েম লিখেছেন- ‘১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি জিয়াউর রহমানের হাতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ছেড়ে দেন। রাষ্ট্র্রপতির পদ ছেড়ে দেন কয়েক মাস পর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল।’ [পৃষ্ঠা ৩৫]
তিনি লিখেছেন, জিয়াউর রহমান যে সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই এবং সামরিক আইনের অধীনে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে বহাল থেকে প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনে অংশ নেবেন, সে ধারণা তিনি করতে পারেননি। [পৃষ্ঠা ৩৬]
জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন নানাভাবে। ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল জাতীয় পরিষদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বিল অনুমোদনের মাধ্যমে ১৫ আগস্ট নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন ও মুক্তিযুদ্ধের পথ থেকে বাংলাদেশকে সরিয়ে নিতে খুনিচক্র যা যা করেছিল, সবকিছুর বৈধতা দেন। খুনিরা দম্ভ করে বলছিল- তারাই ‘শেখ মুজিবকে সবংশে হত্যা করেছে।’ খুনিরা এটাও বলত- জিয়াউর রহমান বরাবর তাদের সঙ্গেই ছিলেন।
ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার পথে জিয়াউর রহমান একের পর এক পদক্ষেপ নিতে থাকেন। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সামরিক আইন বলবৎ ছিল তখন। আওয়ামী লীগের শত শত নেতা জেলে। ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করলেই জেল। বঙ্গবন্ধুর নাম এমনকি আভাসে-ইঙ্গিতেও বলা যাবে না। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল ১৫ আগস্ট থেকেই। সরকারবিরোধী মিছিল-সমাবেশ করার অধিকার ছিল না। ত্রিশ লাখ নারী-পুরুষ-শিশুর আত্মদানে অর্জিত বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ যায়। সমাজতন্ত্র বর্জন করা হয়। একাত্তরে পাকবাহিনীর গণহত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের প্রত্যক্ষ সহযোগী রাজাকার-আলবদর ও তাদের দল জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগকে রাজনীতি করার অধিকার দেওয়া হয়।
১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল জাতীয় সংসদে ‘সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী’ বিল ওঠে। এতে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ ও অন্যান্য আইন এবং উক্ত মেয়াদের মধ্যে অনুরূপ কোন ফরমান দ্বারা এই সংবিধানে যে সকল সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলোপসাধন করা হইয়াছে তাহা এবং অনুরূপ কোন ফরমান, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ বা অন্য কোন আইন হইতে আহরিত বা আহরিত বলিয়া বিবেচিত ক্ষমতাবলে অথবা অনুরূপ কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে গিয়া বা অনুরূপ বিবেচনায় কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত কোন আদেশ কিংবা প্রদত্ত কোন দণ্ডাদেশ কার্যকর বা পালন করিবার জন্য উক্ত মেয়াদের মধ্যে কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আদেশ, কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং ঐ সকল আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা, বা কার্যধারাসমূহ বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং তৎসম্পর্কে কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোন কারণেই কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’
১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, খুনিদের বিচার না করার কুখ্যাত বিধান- ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি প্রদান, জিয়াউর রহমানের একক সিদ্ধান্তে সংবিধান সংশোধন, গণভোটের প্রহসন- সব বৈধতা পায়।
বঙ্গবন্ধুসহ নারী-শিশুদের খুনিদের বিচার করা যাবে না- ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এ বিধান জারি করেছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ। ১৯৭৮ সালের ৩ জুনের রাষ্ট্রপতি ও ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির পার্লমেন্ট নির্বাচনের পর সব অপরাধ হালাল করা হয়ে গেছে ‘সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর’ মাধ্যমে। তবে ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের প্রত্যক্ষ ঘাতকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আরও কিছু দায় ছিল জিয়াউর রহমানের। কারণ এরা তো তারই লোক। তার হয়েই কাজ করে দিয়েছে। খুনিদের কেউ যেন কখনও বিচার করতে না পারে, সে জন্য ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই জাতীয় সংসদে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরের কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটির আরেক দফা অনুমোদন প্রদান করা হয়।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, দেশের বিরাজমান পরিস্থিতির ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের গভীর আগ্রহ ছিল। সেনাবাহিনীর সীমিত গণ্ডির বাইরেও সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। [পৃষ্ঠা ৫৫]
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম লিখেছেন, ১৯৭৪ সালে চোরাচালন বন্ধে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। এ সময়ে জিয়াউর রহমান সাক্ষাৎ করে জানান, ভারতে ৫ থেকে ১০ লাখ টন চাল পাচার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর বাজেয়াপ্ত করা পণ্যের তালিকা থেকে দেখা যায়, চোরাচালানের ক্ষেত্রে চালের তেমন গুরুত্বই নেই। যদি বাস্তবেই চাল ব্যাপক হারে চোরাচালান হতো জনসাধারণ, বাংলাদেশ রাইফেলস ও সেনাবাহিনীর তা চোখ এড়াতে পারত না। কিন্তু আমাদের আলোচনায় জিয়াউর রহমান সন্তুষ্ট হননি। [পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭]
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম লিখেছেন, জিয়াউর রহমানের সামাজিক জীবন ক্যান্টনমেন্টের বাইরেও বিস্তৃত ছিল। বেসামরিক সমাজের সঙ্গেও তিনি সম্পর্ক রাখতেন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় বেতন কমিশন গঠন করলে জিয়াউর রহমান ও সাইফুর রহমানকে তার সদস্য করা হয়। পরবর্তীকালে সাইফুর রহমানকে তিনি প্রথমে বাণিজ্যমন্ত্রী ও পরে অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। [পৃষ্ঠা ৫৮]
অধ্যাপক নুরুল ইসলামের গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি, ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে জিয়াউর রহমান জিয়াউল হক নামে এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে জানান, ‘দেশের সাধারণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহী।’ [পৃষ্ঠা ৫৯]
তিনি লিখেছেন, দু’জনের বৈঠকে ‘দেশের রাজনীতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে সেনাবাহিনীর একজন জেনারেলের এই মাত্রায় আগ্রহ পরিষ্কারভাবেই একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। ...আমার মনে হয়েছিল শিগগিরই যে একটি পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে যখন তিনি সামরিক সরকার প্রধান হলেন, তখন মনে হলো অর্থনৈতিক,সামাজিক ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিক জ্ঞান আহরণ এবং সমাজের বিভিন্ন অংশের ও স্তরের লোকজনের সঙ্গে তাঁর ওই মেলামেশা ছিল হয়তো ভবিষ্যতে কোনো দিন যদি তাঁর ওপর দেশ শাসনের দায়িত্ব পড়ে, তার জন্য প্রস্তুতি। [পৃষ্ঠা ৬০-৬১]
খোন্দকার মোশতাককে কেন্দ্র করে সক্রিয় চক্র এবং জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চাভিলাষী ও নেতৃত্বলোভী অফিসার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশকে ভ্রান্ত পথে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তাদের এই অশুভ আঁতাতে মদদ মেলে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সিআইয়ের। বিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ,গণতন্ত্র উন্নয়নের পথে চলার স্বপ্ন মিলিয়ে যায়। এ থেকে উদ্ধার পেতে ফের কঠিন সংগ্রাম শুরু হয় বাংলাদেশের, যা চলে দুই দশকেরও বেশি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ, তিনি এই সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং সফল হন।
লেখকঃ একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক