3330
Published on জানুয়ারি 10, 2021কৃষিবিদ দীপক কুমার বনিক দীপু:
১০ জানুয়ারি ১৯৭২, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের পূর্ণতা আসে এই দিনে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে দীর্ঘ সারে নয় মাস পর মুক্তি পেয়ে ৯ জানুয়ারি ১৯৭২, বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনের হিথ্রু বিমানবন্দরে পৌছান, তারপরই বাঙ্গালী জাতি জানতে পারে, তাদের প্রানের নেতা পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে। মুহুর্তেই সুরের মূর্ছনার মত ছড়িয়ে পরে এই সুসংবাদ। উৎকন্ঠা কাটিয়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সংবাদে, লাখো বাঙ্গালি সেদিন আনন্দাশ্রু ঢেলেছে।
বঙ্গবন্ধু উনার মুগ্ধতা দিতে বাঙ্গালির হৃদয় ও মস্তিষ্কে জায়গা করে নিয়েছিলেন। তাইতো ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পূর্ণতা আসে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ এ লাখো মানুষের আনন্দাশ্রুতে।
দিনটি ছিল স্বপ্নময়তায় ভরা, শত দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে প্রিয় নেতাকে একনজর দেখার অপেক্ষায় লাখো জনতা সেদিন জড়ো হয়েছিল বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে।
মুহুমুহু জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়েছে সারা ঢাকা।
লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে, ভারতে যাত্রা বিরতি ছিল নয়াদিল্লিতে। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান।
ভারতের মাটিতে লাখো মানুষ বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালী জাতির পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সরকার ও জনগণের ভুমিকার কথা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করেন ও ধন্যবাদ জানান।
বাঙ্গালি জাতি অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে। কখন তাদের নেতা আসবে? কখন তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে?
অতঃপর স্বাধীন বাংলার নতুন সুর্যালোকে, সুর্যের মত চির ভাস্বর উজ্জল মহান নেতা ফিরে আসেন, তার প্রানপ্রিয় স্বদেশ ভূমিতে। তাকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশের মাটিতে স্পর্শ করে ঘোষনা করল সেই মহানায়কের আগমনবার্তা। লক্ষকোটি মানুষের “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” শ্লোগানে মুখরিত হল বাংলার আকাশবাতাস।
সদ্য স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে পা রেখে কিংবদন্তী এ মহানায়ক শিশুর মত আবেগে আপ্লুত হলেন, আনন্দ ও বেদনার অশ্রুধারা নামল তার দুচোখে। প্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে এদেশের মানুষ সেদিন আনন্দে উদ্দেলিত হয়েছিল, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আনন্দাশ্রু সজল সেদিন মুক্তিকামী বাঙ্গালী।
লক্ষ জনতার বিশাল সমাবেশে ভাষন দিতে গিয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধু বারেবারে হৃদয়ের রুদ্ধ আবেগে অধীর হয়ে পরছিলেন।
লাখো শহীদের আত্মদানের কথা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরন করে বঙ্গবন্ধু সেদিন বক্তব্য শুরু করেন। আবেগে আপ্লুত বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেন আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের স্বাদ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। কারাগারের ফাসির কাষ্ঠে দাড়িয়েও বাংলার মানুষের প্রতি আস্থার তিনি হারাননি, ফাসির কাষ্ঠে দাড়িয়েও উনি বাংলার জয়গান গেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তোমারা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও আমার আপত্তি নাই, মৃত্যুর পর তোমরা আমার লাশটা বাঙ্গালীর কাছে দিয়ে দিও।
বিশ্বের সকল মজলুম জনগন যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছে তাদের প্রতি মোবারকবাদ জানান। বঙ্গবন্ধু উনার বক্তব্যে বাংলাদেশের মিত্রদের চিনিয়ে দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু এক কোটি বাঙ্গালী ভারতে আশ্রয় দেওয়া, খাবার দেওয়া, মিত্রবাহিনীর সাহায্যের কথা উল্লেখ করে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতীয় জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
মুক্তিযুদ্ধের শহীদের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার বহু ভাই, বহু কর্মী, বহু মা-বোন আজ দুনিয়ায় নাই, আমি তাদের দেখবো না। আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় বড় ভালবাসি, বোধহয় তারজন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে।
উনি বলেছিলেন, নম নম নম সুন্দরী মম জননী জন্মভূমি গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি। আমি জানতাম না যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতকে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারব কি না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়ের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে।
কতটুকু দেশপ্রেম থাকলে, কতটুকু আবেগ থাকলে একজন মানুষ দেশকে এভাবে অনুভব করতে পারেন!
দেশের মাটিতে পা রেখেই প্রথম বক্তব্যেই বঙ্গবন্ধু জাতিকে দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
উনি বলেছেন,
এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে, যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়,
এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবেনা, যদি আমার মা-বোনেরা কাপড় না পায়।
এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবেনা, যদি এ দেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের উন্নয়নে আশু পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য উনি জনসাধারণের প্রতি আহবান জানান। রাস্তা ঘাট যেগুলো ভেঙে গিয়েছে সেগুলো নিজেরা ঠিক করতে, জমিতে ধান বুনতে অনুরোধ করেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা উল্লেখ করে উনি সকলকে ঘুষ না খেতে অনুরোধ করেন।
বঙ্গবন্ধু শান্তির বাংলাদেশ দেশ গড়াতে চেয়েছেন, চুরি-ডাকাতি, লুটতরাজ না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে উনি অনুরোধ করেছিলেন।
আটকে পরা পাকিস্তানিদের প্রতি নির্যাতন না করার অনুরোধ জানিয়ে উনি বলেছিলেন, "আমরা মানুষ, মানুষ ভালোবাসি"।
বঙ্গবন্ধু বিশাল উদার মনের অধিকারী ছিলেন, তেমনি ছিলেন ইস্পাতসম কঠিন। ফাসির কাষ্ঠে দাড়িয়েও উনি বলেছিলেন, আমি বাঙ্গালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। রাজাকার, আল-বদরদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে আদালতের মাধ্যমে শান্তি নিশ্চিত করার কথা উনি দৃঢকন্ঠে উচ্চারণ করেন। উনি সারাবিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, শান্তিপূর্ণ বাঙ্গালী রক্ত দিতে জানে আবার শান্তিপূর্ণ বাঙ্গালী শান্তি বজায় রাখতেও জানে।
পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনের কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু পাকিস্থানীদের ধর্ম নিয়ে রাজনীতির সমালোচনা করেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা কেমন হবে তাও তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন দেখা যায় উনার বক্তব্যে। উনি বলেছিলেন, আমার রাষ্ট্রে, এই বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা। এই বাংলাদেশে হবে গনতন্ত্র, এই বাংলাদেশ হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র।
নতুন করে বাংলাকে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে উনি বলেছিলেন, "নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা, বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে, এই আমার জীবনের সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য, আমি যেন এই কথা চিন্তা করেই মরতে পারি। "
বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে আজ হাটছে তার প্রিয় স্বদেশ তারই কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে। শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ এক অনন্য উচ্চতায় যাবে, সারা বিশ্ব অবাক বিশ্বয়ে দেখবে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, শেখ মুজিবের বাংলাদেশ সেই দিন আর বেশি দূরে নয়। পিতা তুমি অনন্তলোকে বসে শুধু দোয়া করিও, আশির্বাদ করিও।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখকঃ সদস্য, কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সাংগঠনিক সম্পাদক, কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন, ঢাকা