1219
Published on জানুয়ারি 10, 2021ড. প্রণব কুমার পান্ডে:
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক দিন। এই দিনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে সদ্য স্বাধীন দেশের পবিত্র মাটিতে ফিরে আসেন। বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের আগে তিনি পাকিস্তানি কারাগারে ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেখানে তাঁকে একটি হাস্যকর বিচারের মধ্যমে প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মুহূর্ত গণনা করতে হয়েছিল।
বিশ্বের মানচিত্রে একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বঙ্গবন্ধুর অবদানকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করা আমাদের পক্ষে একটি কঠিন কাজ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকরা বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমেই সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর বুদ্ধিমান, ও দৃঢ় নেতৃত্বের গুণাবলির কারণে তিনি চিন্তা করতে পেরেছিলেন যে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারি। আর তিনি একইভাবে সকল দেশবাসীকে পাকিস্তানি জান্তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে এবং মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হওয়ার জন্য প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। যুদ্ধের পরিণতি আঁচ করতে পেরে পাকিস্তানি জান্তা একটি জালিয়াতি মামলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। তবে, বিরোধী দল এবং বিশ্ব নেতাদের চাপের কারণে তারা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন যে কেন পাকিস্তান সরকার প্রতারণামূলক বিচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল? এই প্রশ্নের সবচেয়ে সঠিক ব্যাখ্যা হ'ল তারা ভীত ছিল এই ভেবে যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে এবং যুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কূটনৈতিক ভাবে স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসের পুরো পথটি পাল্টে দিয়েছিলেন। দীপ্ত কণ্ঠে তিনি সেদিন ঘোষণা করেছিলেন যে "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"। এই ভাষণটি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল যা যুদ্ধের গতিপথকে পরিবর্তিত করেছিল। জনগণকে প্রভাবিত করার শক্তির কারণে পাকিস্তানি জান্তা শেখ মুজিবকে নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিল।
তারপরে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশটি যখন স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন পাকিস্তানি শাসক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে সাহস পায়নি এবং তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে রাজি হয়। পাকিস্তানের কারাগারে ৯ মাসের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার পরে বাইরে এসে বঙ্গবন্ধু একদিনও বিদেশে কাটাতে চাননি। তিনি তার প্রেমময় স্বদেশে ফিরে আসার বিষয়ে খুব আগ্রহী ছিলেন। এর পরে তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন এবং নয়াদিল্লি হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে ফিরে আসার সংবাদ শুনে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ ১০ জানুয়ারির শীতের বিকেলে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের পর প্রথমবারের মতো ঢাকার রেডকোর্স ময়দানে মিলিত হয়েছিল তাদের বীরের কণ্ঠ শুনতে। তিনি তার দেশবাসীর সামনে কথা বলা শুরু করতেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পরেন এবং তাঁর দুটি চোখ অশ্রুতে ভরে ওঠে। কয়েক মিনিটের মধ্যে আবেগ থেকে বেরিয়ে এসে বজ্র কণ্ঠে তাঁর বক্তব্য শুরু করেন।
তিনি যখন কথা বলতে শুরু করলেন তখন সমগ্র জাতি তাকে 'জয় বাংলা' উচ্চারণের মাধ্যমে স্বাগত জানিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের মতো বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির তাৎপর্য অপরিসীম। একাত্তরের ৭ মার্চকে যদি স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয় তবে ১০ জানুয়ারি হবে এর পরিসমাপ্তি। বাংলাদেশের জনগণের জন্য এটি অত্যন্ত আনন্দের বিষয় এই জন্য যে ইতিহাসের দুটি ঘটনার সাথেই তিনি জড়িত ছিলেন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। অন্যদিকে, তিনি ১০ জানুয়ারির ভাষণের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ ও সাহসিকতার চেতনাকে সমুন্নত রেখে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য দেশবাসীকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
এই দিনের গুরুত্ব বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশাল, কারণ আমাদের স্বাধীনতার প্রথম দিকে তাঁর দীর্ঘস্থায়ী অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হতে পারতো। বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে ধারণকারী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন (মনঃ) মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামের মতো নেতাদের সক্রিয় ভূমিকার কারণে দলে ঐক্য রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। ফলে, উচ্চাভিলাষী কুচক্রী মহল তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তবে একই সাথে, বাস্তবতা হ'ল বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসতে না পারলে এই নেতাদের পক্ষে দলীয় ঐক্য ধরে রাখা কঠিন হতো।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরে বঙ্গবন্ধু সাড়ে তিন বছর প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সদ্য স্বাধীন দেশের দায়িত্ব গ্রহণের পরে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন, আইন শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, মুক্তিযোদ্ধদের পুনর্বাসন এবং দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন। তবে, স্বাধীন দেশের একটি সংবিধান প্রণয়ন ছিল তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেটি তিনি অনেক সদ্য স্বাধীন দেশের তুলনায় স্বল্পতম সময়ের মধ্যে করতে পেরেছিলেন। অনেকের মতে ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম উল্লেখযোগ্য সফলতা।
বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে স্বাধীনতার তিন মাসের মধ্যে তাদের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিতে রাজি করাতে সফল হয়েছিলেন। এটি সদ্য স্বাধীন একটি দেশের প্রেক্ষাপটে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল কারণ আমরা অন্যান্য স্বাধীন দেশে মিত্রবাহিনীর সদস্যদের দীর্ঘকাল অবস্থান করতে দেখেছি। এই কাজটি সম্পাদন করা খুব সহজ ছিল না। এটি বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে সম্ভব হয়েছিল। এই কাজের মাধ্যমে তিনি একটি পক্ষকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিলেন যারা মনে করেছিল সরকারের সমর্থন ব্যতীত বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পারবে না।
বঙ্গবন্ধুর পরিপক্ক কূটনীতির কারণে, যার মূল ভিত্তি ছিল "সকলের সাথে বন্ধুত্ব", মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশের বিরোধিতা সত্ত্বেও এক বছরের মধ্যে বিশ্বের ১৪০ টি দেশ বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। সংবিধানের চারটি স্তম্ভের মধ্যে "ধর্মনিরপেক্ষতাকে" অন্তর্ভূত করে তিনি একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন। এটি তাঁর পক্ষে একটি সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল। এই সিধান্তের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার গভীরতা বোঝা যায়। ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি তিনি সংবিধানের আরও তিনটি রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রকে (সকলের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে বোঝাতে) বেছে নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর অল্প সময়ের মধ্যে সকলের জন্য স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে একটি "সোনার বাংলা" প্রতিষ্ঠার অদম্য প্রচেষ্টো চালিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যারা বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়নি তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যের সাথে হত্যা করেছিল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই নক্ষত্রের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশের জনগণ স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের পরিপূর্ণতা অনুভব করেছিল। তিনি যদি ১০ জানুয়ারি দেশে না ফিরতেন তবে দেশের স্থিতিশীলতা ও বিকাশ বিঘ্নিত হতে পারতো। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে একটি শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠা করলেও দেশকে অনেক উচ্চতায় নেওয়ার সুযোগ পাননি। তাঁর মৃত্যুর পরে বেশ কিছু অশুভ শক্তি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে খাটো করার চেষ্টা করেছে। তবে, তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে কারণ বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা খুব খুশি হই যখন দেখি বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা 'সোনার বাংলা' গড়ার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে আমাদের সকলের এই শপথ গ্রহণ করা উচিত যে বাংলাদেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা সকলে সরকারকে সহযোগিতা করবো।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর