2255
Published on জানুয়ারি 10, 2021অজয় দাশগুপ্তঃ
তিনি বার বার ফিরে এসেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কারের পর ফিরে এসেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসির রজ্জু ছিন্ন করে ফিরে এসেছেন। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির পর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে হত্যার পর ঘাতকরা দম্ভ করে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় মুছে দিয়েছেন। বাংলাদেশ যে ‘স্বল্পোন্নত-পিছিয়ে পড়া সম্ভাবনাহীন এক দেশের’ বদনাম ঘুচিয়ে এগিয়ে চলেছে- সেটাও যে তাঁর ফিরে আসা। তিনি বার বার বলেছেন- ভিক্ষুকের জাতির ইজ্জত নাই। ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল গঠনের সময় দ্বিতীয় বিপ্লবের যে চার দফার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন তার প্রধান লক্ষ্য ছিল নিজের পায়ে গর্বিত ভঙ্গিমায় দাঁড়াবে বাংলাদেশ। এখন গোটা বিশ্ব এ অর্জনকে স্বীকৃত দিয়ে বলছে- ‘শেখ মুজিবের বাংলাদেশ আর বাস্কেট কেস নেই।’ এ ভাবে বার বার তিনি আসেন, আসতেই থাকেন।
‘শেখ মুজিব এমন এক ব্যক্তি যাকে ভয় ছুঁতে পারে না। যদি আপনি এক শব্দে শেখ মুজিবকে প্রকাশ করতে চান তাহলে আপনাকে বেছে নিতে হবে ‘‘সাহসী’’ শব্দটা- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের জন্ম গ্রন্থে এ কথা লিখেছেন কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজের সহপাঠী কাজী আহমেদ কামাল। [পৃষ্ঠা ১৭-১৮]
বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা গেছে যে কোনো ব্যক্তি জনগণের জন্য এবং তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য কোনো প্রোগ্রাম দিয়েছে, যাহা ন্যায্য বলে জনগণ মেনে নিয়েছে। অত্যাচার করে তাহা দমন করা যায় না। যদি সেই ব্যক্তিকে হত্যাও করা যায় কিন্তু দাবি মরে না এবং সে দাবি আদায়ও হয়। ...জেলের ভেতর আমি মরে যেতে পারি তবে এ বিশ্বাস নিয়ে মরব। জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার একদিন আদায় করবে।’ [পৃষ্ঠা ২৩৯]
‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে এ কথা লিখেছেন তিনি ১৯৬৭ সালের ৩ মে থেকে ২৩ মে-এর মধ্যে। তখন স্বায়ত্তশাসনের ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবি প্রদানের কারণে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু তিনি নিরুদ্বিগ্ন। বই ও পত্রিকা পড়ছেন। লিখছেন। ফুল চাষ করছেন। ফলের গাছের যত্ন নিচ্ছেন। স্ত্রী, পুত্র-কন্যা ও আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগে রাজনৈতিক নির্দেশনা পাঠাচ্ছেন সহকর্মীদের কাছে।
কৈশোর থেকেই তিনি তেজস্বী, দৃঢ়চেতা, অভিষ্টসাধনে কৃতসংকল্প। ক্যারিশমা তো ছিলই। এই বয়সেই তাঁর প্রথম জেলজীবনের অভিজ্ঞতা ঘটে। কিন্তু কিছুতেই তিনি দমে যাননি।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাস খানেকের মধ্যেই তিনি কলিকাতাকে বিদায় জানিয়ে ঢাকায় চলে আসেন, ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে। সেই বয়সেই বুঝতে সমস্যা হয়নি যে পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব বাংলার বাঙালিদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দমিয়ে রাখতে সক্রিয়। এ জন্য মিথ্যাচার এবং ধর্মের অপব্যহার করতেও তারা দ্বিধা নেই। তিনি এ অন্যায় রুখে দাঁড়াতে উদ্যোগী হলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাড়ে চার মাসের মধ্যে গড়ে তোলেন সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক হাতিয়ার- ছাত্রলীগ। এর দেড় বছরের কম সময়ের মধ্যে মওলানা আবদুল খান ভাসানিকে সভাপতি নির্বাচিত করে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগে তাঁর পদ যুগ্মসম্পাদক, কিন্তু তিনিই প্রাণপুরুষ।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগ মাত্র দুই মাস ৭ দিনের মাথায় নেতৃত্ব দেয় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে ডাকা ১১ মার্চের হরতালে। এ দিন বিপুল সংখ্যক ছাত্র নেতা-কর্মীর সঙ্গে গ্রেফতার হন শেখ মুজিবুর রহমান, যা ছিল পাকিস্তান আমলে তাঁর প্রায় ১৩ বছর জেলজীবনের প্রথম।
পাকিস্তানে তাঁর দ্বিতীয় জেল ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিুবেতনভুক কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থন করলে ২৭ জন ছাত্রছাত্রীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। কর্তৃপক্ষ জানায়, সদাচরণের বন্ড ও আর্থিক জরিমানা দিলে শিক্ষা জীবন অব্যাহত রাখার অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু তরুণ মুজিব অদম্য। তিনি জরিমানা প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। আরও কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর স্থান হয় কারাগারে। এই কারাগারেই তাঁর কাছে হাজির হন চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী, কলিকাতায় ছাত্র আন্দোলন করার সময় যার সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। ‘সিক্রেট ডকুমেনটস অব ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি ন্যাশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’-এর প্রথম খণ্ডে বলা হয়েছে, ‘ফজলুল কাদের চৌধুরী ৯ মে (১৯৪৯) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের ছাত্র ও মুসলিম ছাত্রলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময়ে শেখ মুজিবকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপস করার প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখান করেন। ক্ষমা চাইতেও রাজী হননি। অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করায় তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের অবসান ঘটে। কিন্তু জীবনের যে পাঠ তিনি গ্রহণ করেছেন মাতৃভূমির প্রতি, জনগণের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা ও কর্তব্যবোধ থেকে, সেটাই তাকে সংকল্পবদ্ধ করে তোলে। তিনি শপথ নেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ছাত্র হিসেবে না হলেও আমি আবার ফিরে আসব।’
কী দূরদর্শীই না ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য ‘ষড়যন্ত্র’ করার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হয়। এ মামলা বাতিল ও অন্যান্য দাবিতে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারি মাসে যে প্রবল ছাত্র-গণ আন্দোলন গড়ে ওঠে তার নেতৃত্বে ছিল এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ। এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের নির্বাচিত সংগঠন ডাকসু তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায় ভূষিত করে। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাঁর আহ্বানে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
এভাবেই জাতির পিতার গৌরবময় ফিরে আসা!
কেমন অদম্য, দুঃসাহসী তিনি? ১৯৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর গ্রেফতারের দিন শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে গোয়েন্দা নোটে বলা হয়, ‘তিনি হচ্ছেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সবচেয়ে মিলিট্যান্ট সদস্য এবং ছাত্রদের একটি অংশের মধ্যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন।’ [প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২৮]
১৯৫০ সালের ২৬ মে বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে জেপু নামে একজনকে চিঠি লিখেছেন- ‘তুমি আমাকে বন্ড দিতে বলেছ। আমি বুঝতে পারি না কেমন করে তুমি আমার কাছে ‘‘বন্ড’’ শব্দটি লিখতে সাহস পেলে। আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ ছাড়া আর কারও কাছে মাথা নত করতে জানি না।’ [ পৃষ্ঠা ৪৩৯]
ত্রিশ বছর বয়সে নির্জন কারা প্রকোষ্ঠ থেকে যখন তিনি এ দৃঢ়সংকল্প প্রকাশ করেন, প্রিয়তম স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তখন দুঃখ-কষ্টের জীবন কাটাচ্ছেন বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে, সঙ্গে তিন বছরের মেয়ে শেখ হাসিনা ও এক বছরেরও কম বয়সী ছেলে শেখ কামাল।
এ বছরেরই ১৪ জুন এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়- ‘১ জুন ও ১০ জুন দু’জন গোয়েন্দা অফিসার শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তাঁর মনোভাবে কোনো পরিবর্তন নেই। এমনকি বন্ড দিয়ে জেল থেকে মুক্তিলাভে তিনি ইচ্ছুক নন।’ [পৃষ্ঠা ৪৪৮]
১৬ জুন আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শর্ত মেনে মুক্তিলাভের চেয়ে তিনি কারাগারের অভ্যন্তরে থাকা এবং মৃত্যুবরণকেও শ্রেয় মনে করেন। [পৃষ্ঠা ৪৫১]
এমন দুঃসাহস ও আত্মপ্রত্যয় সেই যৌবনেই দেখিয়েছেন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এভাবেই আমরা দেখতে পাই, বার বার তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছিল, যা তিনি অসম্মানজনক বিবেচনা করেছেন। তাকে বলা হচ্ছিল- চাকরি করুন কিংবা ব্যবসায়ে যোগ দিন। সরকারি দলে যোগ দিলে লাইসেন্স-পারমিট পেতে সমস্যা নেই। সংসারের প্রতি মনোযোগ দিন। স্ত্রী-কন্যা-পুত্রকে সময় দিন।
কিন্তু ভোগবিলাস বা নির্ঝঞ্ঝাট সংসার জীবন নয়, জনগণের কল্যাণে কাজ করাই তাঁর কাছে রাজনীতি। এটা তিনি কীভাবে ত্যাগ করবেন?
১৯৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে টানা দুই বছরের বেশি জেলজীবন, ১৯৫২ সালের মহান একুশের আন্দোলন চলাকালে অনশনের কারণে দুঃসহ শারীরিক কষ্ট- এর মধ্যেই মুক্তিলাভের ঠিক দু’মাস পর ২৬ এপ্রিল তাঁর হাতে অর্পিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব। এ সময়ে দলের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জেলে। জেলে যাওয়ার আগে ১২ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি লেখেন, ‘পূর্ব্ব বাংলার ৪।। (সাড়ে চার কোটি) কোটী মজলুমের সহায় একমাত্র আল্লাহ্ আর তোমরা কতিপয় যুবক ছাড়া আর কেহ নাই।’ [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, প্রথম খণ্ড’ পৃষ্ঠা ১৫৯]
১৯৫৪ সালে ষড়যন্ত্র করে যুক্তফ্রন্টের বিজয় নস্যাৎ করা হয়। কিন্তু শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার সদস্যদেও মধ্যে একমাত্র তিনিই নিক্ষিপ্ত হন কারাগারে, বয়সে যিনি সর্বকনিষ্ঠ।
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারি হয়। বঙ্গবন্ধু সেদিন ছিলেন রাজধানী করাচিতে। পরদিন তিনি ঢাকা চলে আসেন। তাকে গ্রেফতার করা হয় ১০ অক্টোবর। ঢাকা কারাগারের জেলর ১২ অক্টোবর গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন- ‘এ বন্দিকে মোটেই বিচলিত মনে হয়নি। তিনি অন্য বন্দিদের উৎসাহ দিয়ে বলেন, সামরিক শাসন দীর্ঘস্থায়ী হবে না এবং রাজবন্দিরা সকলে আবার জনগণের কাছে ফিরে যাবে।’
বেঙ্গল প্রাদেশিক মুসলিম লীগের এক সময়ের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম পূর্ব পাকিস্তান আইন সভার সকল সদস্যদের কাছে একটি আবেদন প্রকাশ করেছিলেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পঞ্চম খণ্ডের ৪৬-৪৯ পৃষ্ঠায় এটি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে তারিখ দেওয়া রয়েছে ১৫ ফেব্র“য়ারি, ১৯৫২। সে সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান বন্দি ছিলেন। আবুল হাশিম লিখেছেন, ‘ব্রেভেস্ট অব দি ব্রেভ অব দি ক্রুসেডারস অব পাকিস্তান এবং মুসলিম লীগের প্রথম শ্রেণির কর্মী শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে বিনাবিচারে আটক রয়েছেন।’
১৯৫৯ সালের ২৮ মার্চ বন্দিদের মামলা পর্যালোচনার জন্য গঠিত উপদেষ্টা কমিটির সুপারিশে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনায় দেখা যায় তিনি আইন বহির্ভুত কাজে যুক্ত ছিলেন এবং বর্তমান সময়ে মুক্তির সুপারিশ ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তাকে আটক রাখা হউক। [পৃষ্ঠা ৩২৪]
বঙ্গবন্ধুকে দমিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানে তাকে সর্বক্ষণ তোষামোদ করে চলা গভর্নর মোনায়েম খানের যাবতীয় চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জনপ্রিয় মুখ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব- এ মনোভাব তিনি নানা পর্যায়ে ব্যক্ত করতে থাকেন সেই ১৯৪৮ সাল থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের ফ্রেব্র“য়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রদান করেন ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচি। স্বায়ত্তশাসনের এ দাবি আদায়ে প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক শক্তি। বঙ্গবন্ধু এ কর্মসূচি উপস্থাপনের জন্য বেছে নেন লাহোর নগরীকে, যেখানে ২৬ বছর আগে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক পাকিস্তান গঠনে উত্থাপন করেছিলেন লাহোর প্রস্তাব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যথার্থভাবেই বলছেন যে এক বাঙালি পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব তোলেন লাহোরে, আরেক বাঙালি সেই লাহোরকেই বেছে নেন পাকিস্তান ভাঙার কর্মসূচি উপস্থাপনের জন্য। শত্র“র ডেরায় শত্র“কে চ্যালেঞ্জ জানানো- এমনটি কেবল বঙ্গবন্ধুই করতে পেরেছেন।
২০ মার্চ, ১৯৬৬। ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও তাজউদ্দিন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ৬-দফা আমাদের অস্তিত্বের দাবি। নির্যাতন হবে। কারাগারে নেবে। কিন্তু ক্ষান্ত দিলে চলবে না। পল্টন ময়দানের জনসভায় তিনি বলেন, পাকিস্তানে দুই অর্থনীতি প্রবর্তন করতে হবে। একই দিনে আইয়ুব খান ঢাকায় মুসলিম লীগ নেতাদের সম্মেলনে গৃহযুদ্ধের হুমকি দেন।
এটা যে কথার কথা ছিল না, অচিরেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের প্রায় সকল কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে তাকে ফাঁসিতে হত্যার সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি রেখে চলতে থাকে প্রহসনের বিচার। এ মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ও বন্দিশালার রুমমেট মেজর শামসুল আলম এ লেখকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকে একদিনের জন্যও হতাশ-হতোদ্যম হতে দেখিনি। রুমে কিংবা আদালতে যাওয়ার পথে এবং আদালতের ভেতরে তিনি ছিলেন ছিলেন নির্ভয়। সকলকে উৎসাহ দিতেন। ধন ধান্য পুষ্পে ভরা... গানে কণ্ঠ মেলাতেন। বলতেন ছাত্র-জনতার আন্দোলন গড়ে উঠবে এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং সকলকে তারা মুক্ত করবেই।
বাস্তবে এটাই ঘটেছিল। জনগণ ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্র“য়ারি তাকে মুক্ত করে বঙ্গবন্ধু হিসেবে বরণ করে নেয়। মামলা চলাকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট লাহোরে রাজনৈতিক নেতাদের গোলটেবিল বৈঠক ডেকেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে এ বৈঠকে অংশগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু তিনি নিঃশর্তভাবে মামলা প্রত্যাহার ও সকল বন্দির মুক্তির দাবিতে অটল ছিলেন এবং তা আদায় করে ছাড়েন।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি অটল- ছয় দফার প্রশ্নে আপস নেই। ১৯৭১ সালে তিনি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করানোর সময় রেস কোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষকে স্বাক্ষী রেখে বলেন, ‘যদি কেউ ৬-দফার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাকে জ্যান্ত কবর দেবেন।’
এই অদম্য মনোভাব নিয়েই তিনি ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার মুখোমুখি হন। ইয়াহিয়া খান-টিক্কা খানের হুমকি উপেক্ষা করে পরিচালনা করেন বিকল্প সরকার। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ধ্বনিত হয় তাঁর অবিস্মরণীয় আহ্বান- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ সমাবেশেই তাঁর অবিনাশী উচ্চারণ- সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।
বাস্তবেই সেটা পারেনি। ২৫ মার্চ মধ্য রাতে স্বাধীনতা ঘোষণার পর তাকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় ‘শত্র“ রাষ্ট্র’ পাকিস্তানে। এ সময় তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা যেমন চলে, তেমনি ‘আপস প্রস্তাব’ দেওয়াও অসম্ভব নয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য খোন্দকার মোস্তাক আহমদের ষড়যন্ত্রের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ছিল, পাকিস্তানও ছিল। স্বাধীনতার দাবি পরিত্যাগ করার চাপ ছিল, কূটকৌশল ছিল। কিন্তু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন ভূখণ্ডের মহত্তম আকাক্সক্ষা পূরণে নিবেদিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বরাবরের মতোই ছিলেন সংকল্পবদ্ধ। তাঁর নামেই পরিচালিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিনাশর্তে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে- নিঃসঙ্গ বন্দি জীবনে এ সব জানার সুযোগ তাঁর ছিল না। কিন্তু ১৯৭২ সালের জানুয়ারি প্রথম সপ্তাহে মুক্তির বিষয়ে পাকিস্তানের শাসকরা সঙ্গে যখন তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসে, সব কিছু যেন ছবির মতো ভেসে থাকে চোখের সামনে। স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি ফিরে আসেন ১০ জানুয়ারি, লাখ লাখ মানুষের সংবর্ধনায় সিক্ত হয়ে।
তাঁর শক্তির উৎস কী- এ প্রশ্নে বার বার বলেছেন, জনগণের ভালবাসা। এই ভালবাসার ওপরেই গভীর আস্থা রেখে তিনি ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দিকটি উপেক্ষা করেন। ঘাতকরা যখন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটি ঘিরে ফেলে তাকে হত্যার জন্য ভয়ঙ্কর স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্র তাক করে, তখনও তিনি নির্ভিক, দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর রহমান খান ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মোহনী নেতৃত্ব ও স্বাধীনতা সংগ্রাম’ গ্রন্থে লিখেছেন, উদ্যত ঘাতকদের বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘যদি বাঙালিরা তাদের জাতির পিতাকে হত্যা করতে চায়, তিনি জীবন দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। কিন্তু এর পরিণতি বাঙালিদের জন্য শুভ হবে না। তাদের জীবন কখনোই আগের মতো হবে না এবং তাঁকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রকেও তারা হত্যা করবে এবং মানবিকতা বিদায় নেবে।’ [পৃষ্ঠা ২৬১]
কী অমোঘ সত্য ধ্বনিত হয়েছিল জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠে!
কিন্তু আবারও তিনি ফিরে আসেন। বাংলাদেশের আত্মপ্রত্যয়ী জনগণ গণতন্ত্রের জন্য, একাত্তরের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আত্মদান করে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন সোনার বাংলা কায়েমের জন্য রাজপথে নামে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন ও দণ্ড কার্যকর করে।
বঙ্গবন্ধুকে যেমন দমিয়ে রাখা যায় নি, তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের জনগণকেও যে দমিয়ে রাখা যায় না! বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন ‘পিছিয়ে থাকা’ বাংলাদেশ উন্নয়নের সিঁড়িতে দৃঢ়সংকল্পে উঠে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুখী-সমৃদ্ধ-গর্বিত স্বদেশভূমি গঠনে আত্মনিয়োগ করে তখনও তিনি ফিরে আসেন। এমন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্যই ছিল তিনি নিবেদিত ছিলেন!
অজয় দাশগুপ্ত : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক। ১৯৭৫ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু গঠিত জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।