2405
Published on ডিসেম্বর 7, 2019‘১৯৭১ সালের মার্চ মাস। আমি ইপিআরের সৈনিক। ট্রেনিংয়ের জন্য যশোর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে অবস্থান করছি। ২২ মার্চ যশোর ছাত্রলীগ অফিসে গিয়ে একটি বাংলাদেশি পতাকা সংগ্রহ করি। রাতে আমার গার্ড কমান্ডার কাজী তৈয়বুর রহমানকে পতাকা আনার কথা বলি। তিনি রেখে দিতে বলেন। পরদিন সকালে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসে যশোর ইপিআর হেডকোয়ার্টারের সামনে অবস্থান নেন। আমি আমার গার্ড কমান্ডারকে জানাই, পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে এখানে বাংলাদেশি পতাকা তুলব। তিনি অভয় দেন। আমি পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশি পতাকা তুলি। ওই সময় ওখানে আরো উপস্থিত ছিলেন আমাদের গার্ড কমান্ডার কাজী তৈয়বুর রহমান, নায়েক বোরহান উদ্দিন, সিপাহি আব্দুল হাই, সিপাহি আব্দুল মোতালেব, সিপাহি ফারুক লস্কর, সিপাহি লিয়াকত আলী ও সিপাহি মোস্তফা। বাংলাদেশি পতাকা তোলার কারণে আমার ওপর ক্ষুব্ধ হন আমাদের অবাঙালি অফিসার সেক্টর কমান্ডার আসলাম। আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।’
মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করে কথাগুলো বলছিলেন চুয়াডাঙ্গার মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার মেজর (অব.) খন্দকার সাইদুর রহমান বীরপ্রতীক। বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৪ বছর। গত সোমবার চুয়াডাঙ্গার জাফরপুরের বিডিআর হেডকোয়ার্টারের সামনে অবস্থিত নিজের বাড়িতে বসে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমান বলেন, ‘১৯৬৯ সালের ২৭ মার্চ সৈনিক হিসেবে আমি চুয়াডাঙ্গায় তৎকালীন ইপিআরে যোগ দিই। পাকিস্তানি অফিসাররা আমাদের ট্রেনিং দিতেন। ট্রেনিং চলাকালে আমাদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। অনেকেই ভয়ে ট্রেনিং ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৯৭০ সালে যশোর-৬ ইপিআর সেক্টরে ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে থাকতেই আমরা জানতে পারি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আন্দোলন হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর আমরা উদ্বুদ্ধ হই। ভেতরে ভেতরে আমরা প্রস্তুত হই, দেশ স্বাধীন করতে হবে।’
অকুতোভয় সাইদুর বলেন, ‘২৫ মার্চ সকালে যশোরে পাকিস্তানি সৈনিকরা কয়েকজন তরুণীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি সহ্য করতে না পেরে তাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করি। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈনিক আহত হয়। গুলি করার অপরাধে হানাদার বাহিনী আমাকে আটক করে রাখে। ৩০ মার্চ বাঙালি ইপিআর সদস্যরা আমাকে উদ্ধার করেন। ওই দিনই প্রথম আমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করি। যশোরের চাঁচড়া মোড়ে আমরা পাকিস্তানি সৈনিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করি। অ্যান্টি ট্যাংক কামান দিয়ে যশোরের ওই যুদ্ধে আমরা পাকিদের পাঁচটি গাড়ি উড়িয়ে দিই। এতে প্রায় ২০ জন পাকি সেনা নিহত হয়।’
সাইদুর বলেন, ‘যশোরে যুদ্ধের পাঁচ দিন পর পাকিস্তানি বাহিনী যশোর শহর তাদের দখলে নেয়। আমরা যশোর ছেড়ে নড়াইলের দিকে চলে যাই। পরে ওখান থেকে ফরিদপুরের দিকে যাওয়ার সময় কামারখালীর কাছে আমাদের ওপর পাকিস্তানি হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ চলাকালীন জামালপুরের ধনিয়া কামালপুরের এক যুদ্ধে আমার পেটে গুলি লাগে। ৩১ জুলাই যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে আমি ১০-১২ জন হানাদারকে গুলি করে হত্যা করি। আমি গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হলে আমাকে চিকিৎসার জন্য ভারতের গুয়াহাটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসায় এক মাস পর সুস্থ হয়ে আমি ফিরে আসি মেঘালয়ে। সেখান থেকে সিলেট অঞ্চলে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নিই।’
সিলেটের কানাইঘাটের একটি যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে সাইদুর বলেন, ‘১১ নভেম্বর হানাদার বাহিনীর সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে আমরা হানাদার বাহিনীর ৩০-৪০ জনকে হত্যা করি।’
খন্দকার সাইদুর রহমানের বাড়ি চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার ঘোষবিলা গ্রামে। বাবার নাম খন্দকার আব্দুল মজিদ। পাঁচ বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। সাইদুর রহমানের স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। আলমডাঙ্গার ঘোষবিলা ছাড়াও চুয়াডাঙ্গার বিজিবি প্রধান কার্যালয়ের বিপরীতে বিজিবির পক্ষ থেকে জমি ও বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। তিনি চুয়াডাঙ্গা শহরে বিজিবি অফিসের সামনের বাড়িতে বসবাস করেন।
সাইদুর বলেন, ‘তৎকালীন ইপিআরে সৈনিক হিসেবে চাকরিজীবন শুরু হলেও পরে আমি সুবেদার মেজর হিসেবে পদোন্নতি পাই। মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভূমিকার জন্য আমি বীরপ্রতীক খেতাব পাই।’
সুবেদার মেজর খন্দকার সাইদুর রহমান ২০০৬ সালে চুয়াডাঙ্গায় থাকাকালে ১৮ বিডিআর ব্যাটালিয়ন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে আমন্ত্রিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন।
সৌজন্যেঃ দৈনিক কালেরকণ্ঠ