7924
Published on এপ্রিল 1, 2019অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খানঃ
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে অনেক আলোচনা পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ হয়েছে। এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু এই ভাষণের পর তৎকালীন বাঙালি জাতির ওপর কী প্রভাব পড়েছে বা মানুষ কীভাবে দ্রুত স্বাধীনতা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে গেছে, সেটি খুব আলোচনা হয়নি। তা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছানো জরুরি।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি ঢাকার পূর্বানীতে কর্মকৌশল নির্ণয় ও ৬ দফার আলোকে পাকিস্তানের খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নের বিষয়ে আলোচনায় মিলিত হয়। হঠাৎ ওইদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করলেন। তিনি বলেন, ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তান পিপলস পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল যোগ দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং বিদেশি শক্তি, বিশেষ করে ভারত রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তেজনাকর করতে সমূহ ইন্ধন জোগাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। ঢাকা ও সারাদেশে জনগণ ইয়াহিয়া খানের এ ঘোষণায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ মানুষ সেøাগান দিতে দিতে রাস্তায় নেমে পড়ে। মিছিলের পর মিছিল যায় হোটেল পূর্বানী অভিমুখে, যেখানে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দল বৈঠকরত ছিল। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের সঙ্গে হোটেল পূর্বানীতে মিলিত হন। অধিবেশন স্থগিত করাটাকে পাকিস্তানি শাসকচক্রের আরেকটি ষড়যন্ত্র বলে তিনি উল্লেখ করেন। দলমত নির্বিশেষে সর্বমহল থেকে প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে থাকে ইয়াহিয়া কর্তৃক জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায়। পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার ঘোষণাটি বিদ্যুৎস্পর্শের মতো মুহূর্তের মধ্যে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা গগনবিদারী স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় নেমে আসেন। প্রত্যেকের হাতে বাঁশ ও কাঠের লাঠি ছিল।
বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় হরতাল, ৩ মার্চ সারাদেশে ও ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। জনতার প্রতিবাদ, বিক্ষোভ মিছিল প্রতিহত করার জন্যই সামরিক সরকার ২ মার্চ থেকে সান্ধ্য আইন জারি করে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা কারফিউ অগ্রাহ্য করে শহরে প্রতিবাদ মিছিল বের করে। সামরিক জান্তা জনতার দিকে গুলি চালালে ৩ জন নিহত এবং কমপক্ষে ৬০ জন আহত হন। আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শান্তিপূর্ণ ও শৃঙ্খলার সঙ্গে হরতাল পালন এবং লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতির মতো অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে, এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের মূল ভাষণটি ২৩ মিনিটের হলেও ১৮-১৯ মিনিট রেকর্ড করা হয়েছিল। এ ভাষণের জন্য অনেক জ্ঞানী-গুণী নেতা, কেউ চিরকুট দিয়েছেন, কেউ বলে গেছেনÑ ‘নেতা, এটা করতে হবে, বলতে হবে।’ এ ভাষণে সব থেকে বড় অবদান বঙ্গমাতার। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘অনেকে অনেক কিছু বলে, লিখে দিয়েছে, একমাত্র তুমিই জানো কী বলতে হবে! তোমার মনে ঠিক যে কথাগুলো আসবে, তুমি তা-ই বলবে।’ বঙ্গবন্ধু কথা শুনে হাসলেন, তারপর মাঠের দিকে রওনা হলেন। তার দীর্ঘ ৩০ বছরের রাজনীতির আলোকে নিজের চিন্তা থেকে তিনি ৭ মার্চের ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ নিয়ে অনেক বিশ্বনেতা, অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ওই সময়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছে। ১৯৭১ সালের ওই সময়ই বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপির ভাষ্য ছিল, ‘৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ওইদিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ পেরিয়ে আরেকটি নতুন দিনের অভ্যুদয় ঘটল ৮ মার্চ ১৯৭১, সোমবার। দেশ পরিচালনার ভার সামগ্রিক বিবেচনায় এখন বঙ্গবন্ধুর হাতে। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ কোথাও নেই। এদিনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষিত কর্মসূচির একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ওই কর্মসূচি ঘোষণার ফলে প্রতীয়মান হয়, বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলায় এক সমান্তরাল সরকার পরিচালনা করেন। ৮ মার্চ থেকেই রেডিও, টেলিভিশন, দেশের সমুদয় প্রশাসন ও জীবনযাত্রা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে। এদিন কেবল সেনানিবাস ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখা যায়নি। সর্বত্রই ছিল সবুজ জমিনে লাল সূর্য, মাঝে সোনালি রঙের ভূমানচিত্র আঁকা বাংলাদেশের পতাকা। ঢাকা শহর থেকে সর্বত্র, গ্রামে, গঞ্জে, মহল্লায় নানাভাবে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয় কাঠের রাইফেল অথবা লাঠিসোটা নিয়ে। এদিন থেকে কার্যত দেশ স্বাধীনরূপ নেয়। অপর এক ঘটনায় পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী নবনিযুক্ত গভর্নর লে, জেনারেল টিক্কা খানকে শপথ গ্রহণ করাতে অস্বীকৃতি জানান।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা জনগণের জানমাল রক্ষায় তৎপর হন, যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। ওই সময় যাতে কোনোভাবে কোনো ধরনের হঠকারী বা উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়, এদিকে বঙ্গবন্ধু কঠোর নজর রেখেছিলেন। প্রশাসন যাতে সুষ্ঠুভাবে চলে, এ জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৩৫টি বিধি জারি করা হয়। শাসনকার্য পরিচালনার জন্য ১৫ মার্চ থেকে কার্যকর ওই নির্দেশাবলি জারির মধ্য দিয়ে আগে ঘোষিত সব নির্দেশ, আদেশ ও ব্যাখ্যা বাতিল বলে বিবেচিত হয়। এদিকে সামরিক শাসন, নির্যাতন-অত্যাচার, অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তার ‘হেলাল-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব, দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামছুদ্দীন ও ঢাকা বিশ্বাবদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী পাকিস্তান খেতাব বর্জন করেন।
বিস্ফোরণমুখ বাংলাদেশে ১৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়। রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল টান টান ও উত্তেজনাপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে হেয়ার রোডে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট ভবনে আলোচনার জন্য যান। অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোয় প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৩২ নম্বর বাসভবনে সবস্তরের মানুষের ঢল নামত। মনে হতো যেন সব পথ ৩২ নম্বরের সঙ্গে মিশে গেছে। ইতোমধ্যে ১৯ মার্চ ঢাকার জয়দেবপুরে ঘটে যায় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জয়দেবপুরে নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালালে বেশ কয়েকজন হতাহত হন। জয়দেবপুরে অবস্থিত ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়নের বাঙালি সৈনিক ও অফিসাররা মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে অস্ত্র সমর্পণে অস্বীকৃতি জানান।
২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আলোচনার অজুহাতে ২৫ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করেন। বাংলাদেশের কোথাও ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে পাকিস্তানের পতাকা ওড়েনি। জনসাধারণ সেদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিটি ঘরের শীর্ষে কালো পতাকার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলার মানচিত্র আঁকা নতুন পতাকাটিও ওড়ায়। সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বিদেশি দূতাবাস, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কোর্ট-কাচারি, হাইকোর্ট, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, যানবাহন, বাসগৃহÑ সর্বত্রই উত্তোলন করা হয় এ পতাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাসভবনেও স্বাধীন বাংলার পতাকা পতপত করে উড়ছিল। ওইদিন পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে পেছনে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাজানো হয়। স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। জয় বাংলা বাহিনী পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই একমাত্র ভাষণ যার মধ্য দিয়ে গোটা বাঙালি জাতি সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সন্দেহ-অবিশ্বাস ঝেড়ে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই হচ্ছে বিশ্বসেরা ভাষণ। এর আগে মানুষের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। কারণ সংসদ অধিবেশন বসার প্রস্তুতি চলছে প্রথমে ৩ মার্চ, পরে ২৫ মার্চ। অন্যদিকে আবার নানা ধরনের সমঝোতা বৈঠক চলছে। বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতির বঞ্চনার কথা বলেছেন, রাজনৈতিক ইতিহাসের কথা বলেছেন, বাঙালির মুক্তির সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির কথা বলেছেন, সর্বোপরি স্বাধীনতার কথা বলেছেন। বস্তুত এটিই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। ‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাটÑ যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি শব্দই গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। তারপরও উল্লেখিত বাক্যগুলোয় সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণে কী নেই যে, এটাকে স্বাধীনতার ঘোষণা বলা যাবে না। সব বিজ্ঞ বিশ্লেষকই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেছেন, ৭ মার্চের ভাষণই হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৭ মার্চ এবং ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক গুরুত্ব। বাঙালি জাতি যেন যুগ যুগ ধরে এ ভাষণের জন্য অপেক্ষা করেছে তাদের মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য। ইতোমধ্যে স্বাধীনতা ঘিরে অনেক সরকারি-বেসরকারি দিবস পালিত হয়। কিন্তু ৭ মার্চ সেভাবে কোনো দিবস হিসেবে পালিত হয় না। ইতিহাসের প্রয়োজনে, নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিক ইতিহাস প্রবাহিত করার জন্য ৭ মার্চকে সরকারিভাবে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা উচিত। সবাই বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার ঘোষণা। তবে ৭ মার্চ কেন ‘স্বাধীনতা ঘোষণা দিবস’ নয়? সংশ্লিষ্ট সব মহল বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখবেÑ এটিই হচ্ছে এ বছরের স্বাধীনতার মাসের প্রত্যাশা।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশঃ দৈনিক আমাদের সময়