5829
Published on এপ্রিল 17, 2018১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ৬ সদস্যবিশিষ্ট যে সরকার গঠিত হয়, তা-ই ছিল প্রথম বাংলাদেশ সরকার, যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার (তখন মহকুমা) বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বিপুলসংখ্যক বিদেশী সাংবাদিকের উপস্থিতিতে ওই সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এ সরকারের অধীনে মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। এর প্রধান কার্যালয় ছিল কলকাতায়। একটি নিয়মিত সরকারের মতো এর ছিল বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, কেবিনেট সচিব ও অন্যান্য সচিব, স্থায়ী ও বেতনভুক্ত বেসামরিক-সামরিক সরকারী কর্মচারী। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক সেক্টরে একজন করে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। অন্য সরকারী কর্মচারীদের মতো তাঁরাও ছিলেন বেতনভুক্ত। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কমান্ডার-ইন-চিফ। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী ছিলেন প্রধান সেনাপতি। সরকার বাংলাদেশকে ১১টি সামরিক সেক্টরে বিভক্ত করার পাশাপাশি সমগ্র দেশকে কয়েকটি জোনে বিভক্ত করে রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বে মাঠ পর্যায়ে বেসামরিক প্রশাসন-ব্যবস্থা গড়ে তোলে। দেশের মুক্ত অঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের অনুশাসন পালিত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন এ সরকার গঠন অত্যন্ত জরুরী ছিল। অন্যথায়, মুক্তিযুদ্ধে দেখা দিত সমূহ বিপর্যয়। সরকার গঠনের ফলে একক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রথম বাংলাদেশ সরকার বা মুজিবনগর সরকারের বৈধ ভিত্তি ছিল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ ৬ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয় অর্জন করে (৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন ও ৭২.৫৭% প্রদত্ত ভোট)। পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল আরও নিরঙ্কুশ। জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলার জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি (৭টি মহিলা আসনসহ) লাভ করে। এর মধ্যে ১৬২টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে মাত্র ২টি হাতছাড়া হয়, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসন অর্জন করে। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদেও আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল অবিস্মরণীয়। ৩১০টি প্রাদেশিক পরিষদ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৮টি আসন ও প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৮৯ ভাগ লাভ করে। ’৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শুধু মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবেই আবির্ভূত হননি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তিনি স্বীকৃত হন বাঙালীদের একমাত্র মুখপাত্র বা ‘সোল স্পোকসম্যান’ হিসেবে। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মতো বঙ্গবন্ধুও যদি তাঁর দল নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ‘এলএফও’ (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) খড়গের কারণে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বিরত থাকতেন, তাহলে তা হতো আত্মঘাতী। ’৭০-এর নির্বাচনের গণম্যান্ডেট ব্যতীত বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের (১৯৭১) স্বাধীনতা ঘোষণা চিহ্নিত হতো টউও (Unilateral Declaration of Independence) বা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন (Secessionist Movement) হিসেবে, যে-পথ বঙ্গবন্ধু সর্বদা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরিহার করে তাঁর লক্ষ্যে এগিয়ে গেছেন। তাঁর সম্মুখে উদাহরণ ছিল কীভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বতন্ত্র সত্তার অধিকারী জনগোষ্ঠীর মুক্তিসংগ্রাম সঠিক রাজনৈতিক পন্থা ও নেতৃত্বের অভাবে বিপর্যস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। আফ্রিকার দেশ নাইজিরিয়ার বায়াফ্রার উদাহরণ তো ছিলই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কাছাকাছি সময়ে (১৯৬৭-১৯৭০) দেশটির দক্ষিণ অঞ্চল বায়াফ্রার এক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল ওজুকু নাইজিরিয়ার কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনটি রাষ্ট্র স্বীকৃতিও দেয়। কয়েক বছর তাদের সশস্ত্র যুদ্ধ চললেও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদের’ অভিযোগে আমেরিকা, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেনসহ বৃহৎ শক্তিগুলোর সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে বায়াফ্রার ওই স্বাধীনতা সংগ্রাম ধ্বংস হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্বে তাতে তিনি কি বলতে পারেন সে সম্বন্ধে দেশে-বিদেশে নানা জল্পনা-কল্পনা চলে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত একাধিক পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু ওইদিন তাঁর ভাষণে সরাসরি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন মর্মে খবর প্রকাশিত হয়। যেমন দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার প্রতিনিধি ডেভিড লোশাক ঢাকা থেকে ‘E. Pakistan UDI Expected’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন পাঠান, যা ৬ মার্চ পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, ‘Sheikh Mujibur Rahman is expected to declare Independence tomorrow'।
বঙ্গবন্ধুর জন্য ৭ মার্চ ছিল এক যুগ-সন্ধিক্ষণ। একদিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত জনগণের অদম্য আকাক্সক্ষা, অন্যদিকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার (ইউডিআই) মারাত্মক পরিণতি। তিনি তাঁর ১৮ মিনিটের সংক্ষিপ্ত ভাষণে পাকিস্তানের ২৩ বছরে বাঙালীদের ওপর পাকিস্তানীদের শাসন-শোষণ ও জাতি-নিপীড়নের বিবরণ তুলে ধরে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দান শেষে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা’ -বলিষ্ঠ কণ্ঠে এ-কথা উচ্চারণ করে তাঁর বক্তব্য শেষ করেন। এর পূর্বে একই ভাষণে তিনি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে মার্শাল ল’ উইথড্র ও জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিসহ ৪টি কঠিন শর্ত যুক্ত করে আলোচনার দরজা খোলা রাখার কৌশল অবলম্বন করেন। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, ’৭০-এর নির্বাচনে গণম্যান্ডেট লাভের মাধ্যমে তাঁর বৈধ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু এক তরফা সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার পথ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখেন, যদিও তাঁর ৭ মার্চের ভাষণকে কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবেই দেখা হয়। স্পষ্টত, বঙ্গবন্ধু কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেন। শুরু থেকেই তাঁর এ্যাপ্রোচ ছিল ‘মেজরিটি (বাঙালীরা) মাইনরিটি (পশ্চিম পাকিস্তানী) থেকে বিচ্ছিন্ন হবে কেন? বরং মাইনরিটিই ‘সিসিড’ করেছে বা আক্রমণকারী’ এটিই সবাই দেখুক।
২৫ মার্চ ১৯৭১ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লে একদিকে শুরু হয় মানব জাতির ইতিহাসে এক বর্বর গণহত্যা, যা ৯ মাস ধরে চলে, অপরদিকে সৃষ্টি হয় সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রতীক্ষিত ক্ষণ। পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। প্রাথমিক প্রতিরোধের একপর্যায়ে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা এক সভায় সমবেত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করেন এবং স্বাধীনতার সাংবিধানিক ঘোষণাপত্র গ্রহণ করেন (Constitutional Proclamation of Independence), যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ’৭২-এর সংবিধানের মূল ভিত্তি।