3817
Published on ডিসেম্বর 13, 2018পঁচিশে মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদাররা শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে রক্তের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে যে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর গণহত্যা শুরু করেছিল, মৃত্যু-ধ্বংস-আগুন-আর্তনাদের বীভত্স খেলায় মত্ত হয়ে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, নয় মাস পর তার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ষোলই ডিসেম্বর। লন্ডনের নিউ টাইমস পত্রিকায় সেই সময় বলা হয়েছিল, রক্তই যদি কোনো দেশের স্বাধীনতা অর্জনের অধিকারের মূল্য বলে বিবেচিত হয়, তবে বাংলাদেশ অনেক বেশি দাম দিয়েছে। সেই দামের বিনিময়েই আমাদের মহান বিজয়। দীর্ঘ ২৪ বছর পর বাঙালির মুখে আনন্দোচ্ছ্বাসের জলতরঙ্গ বয়ে গিয়েছিল এই দিনটিতে। ঐ দিনের চারটা একত্রিশ মিনিটে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রেসকোর্স ময়দানে আত্মসর্মপণ করে সেই ক্ষণটি বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণ। এক অভূতপূর্ব সুখৈশ্বর্যময় মুহূর্ত। ঐদিন একদিকে বাঙালি পাকিস্তানি স্বৈরাচারদের রাহুগ্রাস থেকে, রুদ্ধবাক অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে খুঁজে পেয়েছিল নব প্রাণের আবেশ, অন্যদিকে বিশ্বের মানচিত্রে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে দীর্ঘ নয় মাসের জঠর-যন্ত্রণা শেষে জায়গা করে নিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ নামের এক নৈসর্গিক ভূখণ্ড তথা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। লাখো শহিদের লাল টুকটকে তাজা রক্তের সঙ্গে গ্রাম-বাংলার সবুজ প্রকৃতি নব সূর্য কিরণে মাখামাখি হয়ে মিলেমিশে লাল-সবুজের কেতন হয়ে, মহানন্দে বাঙালিকে নতুন রঙিন স্বপ্নের ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন। আর অসঙ্গতি ভরা পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির পৃথিবীর মানচিত্রে অধিষ্ঠানের মাধ্যমে দূর হয়েছিল ইতিহাসের সেরা এক অসঙ্গতি।
অপারেশন সার্চ লাইট নাম দিয়ে বাঙালির অস্তিত্বকে চিরতরে পৃথিবী থেকে ধূলিসাত্ করে দিতে নির্মম, অমানবিক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল যারা সেই পাকিস্তানি সৈন্যরা ঐ দিন রেসকোর্স ময়দানে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। যে জয় বাংলা ধ্বনিকে তারা ঘৃণা করত, লাখ লাখ মানুষের বিজয়ী মুখের সেই ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তাদের হূদয়কে বিদীর্ণ করে চলছিল। এ এক অভাবনীয় দৃশ্য। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি যখন মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করে নিজের রিভলবার জমা দেয়, তখন এদেশের লাখো শহিদের আত্মাও যেন বলে উঠেছিল, ‘জয় বাংলা’। বর্বরতার পদাবনত অবস্থান দেখে স্বজনহারাদের চোখেও ঠাঁই নেয় শোকের পরিবর্তে আনন্দাশ্রু। ঐ মুহূর্তটি বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরবের সন্ধিক্ষণ। ঐ মুহূর্ত থেকে বাঙালি বুঝেছিল তাদের আর পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুর গুলির আঘাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হবে না; পালিয়ে বেড়াতে হবে না একটুখানি নিরাপদ ঠাঁই পাওয়ার আশায়; বাতাসে লাশের গন্ধ সহ্য করতে হবে না ; ড্রেনে মুখ থুবড়ে থাকবে না কোনো ধর্ষিতা বোনের বীভত্স দেহ; ডোবায় ভেসে উঠবে না ফুলে-ফেঁপে থাকা থরে থরে লাশ, একটার ওপর আরেকটা লাশ; শকুনের চিরে খাওয়া পচা-গলা ক্ষতবিক্ষত লাশ।
পাকিস্তানিরা সূচনালগ্ন থেকেই এদেশের মানুষকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সকলক্ষেত্রে এমনভাবে দাবিয়ে রেখেছিল যেন তারা বাঙালিকে দাসে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। বাঙালির মাঝে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে যে ঐকতান সেটাকে তারা ভয় পেত। এজন্য তারা বাঙালির ওপর এক অস্বাভাবিক দুঃসহ জীবনধারা চাপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অত্যাচারের কঠোর আবরণ বিদীর্ণ করে জ্বলে উঠেছিল বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের মিঁয়াওয়ালি কারাগারের অন্ধকারের প্রকোষ্ঠে বন্দি থাকলেও তাঁর বিদ্রোহের, সংগ্রামের বাণী ও সুর প্রতিনিয়ত অনুরণিত হয়েছিল দেশমাতৃকার মুক্তির জন্যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রতিটি সূর্য-সন্তানের মনে। তাঁর আদর্শ ও চেতনাকে বুকে ধারণ করে দেশ মাতৃকাকে পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্ত করতে বাঙালি শতগুণ বেগে জ্বলে ওঠে। অবহেলিত-অপমানিত, নির্যাতিত-বঞ্চিত বাঙালি দ্রোহের অনির্বাণ শিখায় জ্বলে উঠে বজ্র শপথে থ্রিনটথ্রি রাইফেল হাতে নিজপ্রাণ তুচ্ছ করে বীরবিক্রমে লড়াই করে, লাখো শহীদের প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে নিয়ে এসেছিল ষোলই ডিসেম্বরের গৌরবোজ্জ্বল মহান বিজয়। আর এই মহান বীররাই হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
ডিসেম্বরের শুরু থেকেই বাঙালির বিজয় ডঙ্কা বাজতে শুরু করেছিল। যখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, তখন পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। আর সেই সুযোগে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরিভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। পাকিস্তানিদের প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র থাকলেও মনোবল ছিল দুর্বল। অসত্যের ওপর ভর করে আর কতক্ষণই-বা লড়াই করা যায়! মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পর্যুদস্ত ও হতোদ্যম হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। ষোলই ডিসেম্বর সকালে মেজর জেনারেল নাগরা নিয়াজিকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে নিয়াজি রাজি হয়ে যান। লেজ গুটিয়ে পালানোর কোনো উপায়ই যখন খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন নাগরার এই আহবান তার কাছে ছিল চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। জীবন বাঁচাতে নিয়াজি তিরানব্বই হাজার সৈন্যসমেত চারটা একত্রিশ মিনিটে লাখো বাঙালির উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণ দলিলে যখন স্বাক্ষর করেছিলেন, তখন কেবল রেসকোর্স ময়দানই নয়, পুরো ধরণী জুড়েই যেন শুরু হয়েছিল হর্ষধ্বনি। ঐ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহত্ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান যার মধ্য দিয়ে এক স্বাভাবিক সত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত, মানস ও জাতিগত অস্তিত্বকে অস্বীকার করে কেবল ধর্মকে পুঁজি করে কোনো দুটি পৃথক অঞ্চলের একত্রীকরণ ঠিক হতে পারে না, সেই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হলো দুইশ ছেষট্টি দিনের সেই ভয়াল যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে। এই যুদ্ধ বাঙালি জাতির হূদয়ে একদিকে সর্বস্ব হারানোর বেদনায় সকরুণ সুর তোলে, আবার ত্যাগ ও মহিমায় সমুজ্জ্বল করে বাঙালিকে গৌরবান্বিত করে তোলে।
এই যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজন্ম লালিত স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, অসামপ্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়েছিল। আর পুরোদমে সেটার বাস্তবায়ন করছেন তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সর্বত্রই উন্নয়নের ছোঁয়া। তিনি এদেশের মাটিতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচারকার্য সুসম্পন্ন করেছেন। এজন্য তাঁকে দেশি-বিদেশি নানা প্রতিবন্ধকতা, নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়েছে। বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি আর যুদ্ধপরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী দল বা দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করে এই বিচারকে বানচাল করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি। আজ দেশ কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জাতির পিতার আদর্শকে বুকে ধারণ করে ঐতিহ্যগতভাবে লড়াকু বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাত্ করে দিয়ে এই দেশকে ধাপে ধাপে সমৃদ্ধির সোপানে তুলে নিয়ে যাবে উন্নত বিশ্বের কাতারে—এটাই আজ সর্বজনীন প্রত্যাশা।