কষ্টের সময়টাকে মুছে দিছে শেখের মাইয়াঃ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আশরাফুল করিম

7390

Published on মার্চ 13, 2018
  • Details Image

লেখাটি যখন লিখছিলাম তখনই এলো খবরটি। বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফুল করিম বেঁচে নেই। বুকের ভেতরটা ধুপ করে ওঠে। দিন কয়েক আগেও মুঠোফোনে কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। গেল ডিসেম্বরে গিয়েছিলাম তাঁর বাড়িতে। শুনেছি মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ নিয়ে বুকেজমা কষ্টের কথা। প্রকাশিত এ লেখাটি তিনি দেখে যেতে পারলেন না! দেশের স্বাধীনতাটা শুধু ভোগ করলাম আমরা। আশরাফুলের মতো পা হারানো যোদ্ধার জন্য তেমন কিছুই করতে পারলাম না। নানা প্রশ্ন ভিড় করে মনে।

একেকজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গল্পই স্বাধীনতার একেকটি ইতিহাস। বীর যোদ্ধা আশরাফুল করিম তাঁর জীবনের শেষ কথাগুলো বলে গেছেন আমাদের কাছে। মুক্তিযুদ্ধ ও তাঁর সেই জীবন ইতিহাস প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার দায়িত্বটা তাই আমাদেরকেই নিতে হবে।

দুই নদীর মিলনস্থলেই গ্রামটি। নাম গৌরিপুর। পূর্বদিক থেকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র আর উত্তর দিক থেকে মেঘনা এসে মিশেছে এখানেই। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা থেকে দশ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গ্রামটি। এ গ্রামেই জন্ম আশরাফুল করিমের। বাবা মোস্তাফা মিয়া ও মা নুর জাহান বেগমের সপ্তম সন্তান তিনি। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি গৌরিপুর প্রাইমারি স্কুলে। পরে তিনি ভর্তি হন ভৈরব কেবি হাই স্কুলে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ওই স্কুলের প্রবেশিকা বা এসএসসি পরিক্ষার্থী।

নদীর বুকে নানা রঙের পালতোলা নৌকার দৃশ্য আর বড় বড় লঞ্চ চলার শব্দেই বিভোর থাকত আশরাফুলের শিশুমন। তাঁর ভাষায়- “আগে নদীতে সাঁতরাইতাম। নদীতে ডুবাইতাম। নদীতে তখন বিশাল বিশাল ঢেউ ছিল। সেখানেই গোসল করতাম। ভয় করতো না। বৈশাখ মাসে একটা দৃশ্য হইত। ভাটি অঞ্চলে ধান কাটার জন্য এই নদী দিয়া শত শত নৌকা ছুটতো পাল তুইলা। ওই দৃশ্যটা ছিল খুব মনোরম।”

“তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। হানিফ, আমি আর জর্জ মিয়া গোসল করতে গেছি। ওরা কয়- ‘নদী সাঁতরাইয়া পাড় হইতে পারবি? পারমু না কেন? বইলাই সবাই ঝাপ দিছি। মেঘনা তখন উত্তাল আর অনেক বড়। সেটাই সাঁতরাইয়া পাড় হইছি। নদীর পাড়ে দাড়াইয়া শত শত লোক দেখছে আমাগো কাণ্ড। সবাই বলছে- ‘এতো সাহস তোদের’। শুনে ভালই লাগছে। মনে হইছে সব কিছুই করতে পারমু।”

শিক্ষকরা তখন ছিল অন্যরকম। বাড়ির কাজগুলো সঠিকভাবে বুঝে নিত। জামা পরিষ্কার কিনা, দাঁত মেজেছে কিনা, আদব-কায়দা, নৈতিকতা সবই শেখাতো। আশরাফুল মনে করেন সেই শিক্ষক এখন নেই। তাঁর ভাষায়- ‘এখন তো শিক্ষাটা কর্মাশিয়াল হয়ে গেছে। এ-প্লাসের যুগ। কাগজের সনদই সব। নৈতিকতা শিক্ষার কোন প্রতিফলন তো দেখি না।”

১৯৬৯ সাল। দেশে চলছে আন্দোলন। ভৈরবে ছাত্র নেতা ছিলেন ফয়সুল আহমেদ, মোহাম্মদ আলী রুস্তম, রফিক, আক্কাস প্রমুখ। তারা স্কুলে স্কুলে যেতেন। দেশ নিয়ে নানা বৈষম্যের কথা তুলে ধরতেন। কী সেই বৈষম্য?

আশরাফুল বলেন- “আমাদের পাট ও চামড়ায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হলেও সেটা দিয়ে উন্নয়ন হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন খরচ ছিল তিন হাজার কোটি টাকা। অথচ সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন খরচ ছিল ডাবল। অর্থ্যাৎ ছয় হাজার কোটি। বাঙালি হলে সরকারি চাকরিতে বেশি দূর এগোতে পারত না। কাগজের দাম ছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেক বেশি। চালের দাম পূর্ব পাকিস্তানে যখন ৫০ টাকা তখন পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ২৫টাকা। গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল না তখন। ভাষা আন্দোলনে রক্ত না দিলে তো বাংলা ভাষায় মা বলাটাও হারিয়ে যেত।”

আশরাফুল ক্লাস সেভেনে থাকতেই প্রথম দেখেন বঙ্গবন্ধুকে। ভৈরব রেলওয়ে মাঠে এসেছিলেন তিনি। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, আলাউদ্দিন হাজী, এবি সিদ্দিকও সঙ্গে ছিলেন। তাঁর ভাষায়, “কী অদ্ভুত তাঁর কণ্ঠ! তন্ময় হয়ে দেখেছি বঙ্গবন্ধুরে। বাঙালির মুক্তির জন্য কথা বললেন তিনি। তাঁর চেহারাটা ওই দিনই মনে গেঁথে গেছে।”

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটির রেকর্ড আশরাফুলরা শোনেন ভৈরবে। ওই ভাষণই তাঁদের আবেগতাড়িত করে। তিনি বলেন- “বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই দুই-তিন কথার মধ্যেই তো আমরা স্বাধীনতার ঘোষণা পাই। এরপরই শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। গ্রামে ও ভৈরবে আমরা লাঠি মিছিল বের করেছি। নেছার উদ্দিন চুন্নু, গোলাপসহ কয়েকজন এর নেতৃত্ব দিতেন।”

“২৫ মার্চ ১৯৭১। রাতে ঢাকায় আর্মি নেমে গণহত্যা চালায়। সে খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। ঢাকা থেকে তখন পালিয়ে আসে হাজার হাজার লোক। সবার গন্তব্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্ত। আশরাফুলরা আগতদের খাবার ও পানির ব্যবস্থা করে দিতেন। নৌকা নিয়ে নদী পাড়ও করে দিতেন দলবেঁধে।”

আপনাদের ওখানে আর্মি আসে কখন?

তিনি বলেন, “নাসিম সাহেব (সাবেক সেনা প্রধান) একটা ট্রুপ নিয়া ভৈরবে এসে লালপুর পর্যন্ত উনার রেজিমেন্ট মোতায়েন করেন। তখন উনারা গ্রামের যুবকদের পিটি-প্যারড করিয়ে তৈরি থাকতে বলেন। আমারও তৈরি ছিলাম। কোন কোন সময় খবর আসত- ‘আর্মি আসতাছে’। সারা গ্রামের লোক তখন লাঠিসোটা, দা, বল্লম, সুরকি নিয়া দৌলতকান্দি রেলস্টেশনের দিকে রওনা দিত। পাকিস্তানি সেনাদের স্টেনগান আর মেশিনগানের কাছে ওটা যে কিছুই না- এ বোধ তখন ছিল না। বাঙালির মনে ছিল স্বাধীনতার তীব্র আকাঙক্ষা।”

“সম্ভবত ১২ এপ্রিল ১৯৭১। পাকিস্তানি সেনার ভৈরব আক্রমণ করে- তিনদিক থেকে। নৌপথে, আকাশ পথে ও স্থলপথে। ওদের আক্রমণে টিকতে না পেরে ভৈরব থেকে নাসিম সাহেব তার ট্রুপ নিয়ে চলে যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে।”

আপনারা তখন কী করলেন?

“এপ্রিলের শেষ দিকের কথা। চারদিকে তখন পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার চলছে। আমরা ক্ষুব্ধ। কি করব, কোথায় যাব। জানি না। তখন সোহরাব ভাই বলল- ‘ল ওই পাড় চলে যাই।’ আমরা পাঁচজন এ কে নেসার উদ্দিন চুন্নু, আমি, সোহরাব ভাই, মঞ্জিল, কুদ্দুস সিদ্ধান্ত নেই ইন্ডিয়ায় যাওয়ার।”

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অষ্টগ্রাম হয়ে মুকুন্দুপুর রেলস্টেশন দিয়ে তারা ইন্ডিয়াতে ঢুকে। অতঃপর ট্রাকে করে চলে আসেন আগরতলায়, জয়বাংলা হাউজে। সেখান থেকে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রথমে কংগ্রেস ভবনে এবং পরে জয়নগর স্কুলে। কয়েকদিন কাটানোর পর তারা চলে আসেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। সেখানেই চলে পিটি-প্যারেড।

এরপর কী হলো, সে ইতিহাস শুনি আশরাফুলের জবানিতে।

তাঁর ভাষায়- “মে মাসের কথা। ট্রেনিং নাই তাই ঘুরে বেড়াই। আগড়তলা শহরে গিয়ে পাই ভৈরবের তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি আলাউদ্দিন হাজী (আলু হাজী) এবং সিদ্দিকুর রহমান সিদ্দিক ও সায়েদুল্লাহ ভাইকে। উনারা জিপে করে সোহরাব ভাই, রুস্তম আর মুকুলসহ আমাদের নিয়ে যায় তিন নম্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টার মনতলাতে। ইব্রাহীম সাহেব ও কোয়াটার মাস্টার শফিউল্লাহ ছিলেন সেখানে। ওখানে তারা আমাদের ট্রেনিং দেন আটাশ দিন। আমরা চারজন ছাড়াও তাজুল ইসলাম নামে একজন আর কিশোরগঞ্জের তিনজন ছিলেন। থ্রি নট থ্রি, এসএমজি, থার্টি সিক্স হ্যান্ড গ্রেনেড, ব্রিটিশ এলএমজি চালানো শিখি সেখানে। ট্রেনিং শেষে কোরআন শপথ হয় সেক্টর কমান্ডারের টিলায়। মেজর কে এম সফিউল্লাহর উপস্থিতিতে ক্যাপ্টেন নূরুজ্জামান সাহেব আমাদের শপথ করান। অতঃপর ২টি স্টেনগান ও ৪টা করে হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভেতরে।”

আশরাফুল করিম মুক্তিযুদ্ধ করেন তিন নম্বর সেক্টরে। গেরিলা ছিলেন। নির্দেশ ছিলো- ‘মারো কিন্তু নিজে সেভ থাকো’। একেক সময় একেকজন তাঁদের কমান্ড করতেন। বেশির ভাগ সময় কাশেম ভূঁইয়ার অধীনে যুদ্ধ করেছেন। এছাড়া ভৈরবের পাওয়ার হাইজ ও টিএনটি অফিস অপারেশনের নেতৃত্ব দেন ফকরুল ইসলাম আক্কাস। আবার রামনগরের ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার নেতৃত্বে ছিলেন সায়েদুল্লাহ। সোহরাব ছিলেন ট্রুপ কমান্ডার। গৌরিপুরে পাকিস্তানিদের লঞ্চ অপারেশনও করেন তারা।

দৌলতকান্দির বেল তলীতে নারীদের তুলে আনতে গেলে নয় রাজাকারকে হাতেনাতে ধরেন তারা। অতঃপর কী ঘটল?

আশরাফুল বলেন- “ওরা ব্রিজ পাহারা দিত। মানুষদের ওপর অত্যাচার করত। যুবতীদের তুলে আনত। আব্দুল হক নামে এক মুক্তিযোদ্ধা ওইদিনের খবরটা দেন। রেকি করে আসে সোহরাব ভাইসহ দুইজন। দিনটি ছিল শুক্রবার। দুপুর বেলা। কাভারিং ফায়ারের জন্য তৈরি ছিল আক্তার, গোলাপ, দানেশ, গিয়াসুদ্দিন ও আব্দুল হক। গুলি করতেই রাজাকাররা মাটিতে পড়ে যায়। আমরা অস্ত্রগুলো তুলে আনি। তখনও মরে নাই ওরা। পরে এলাকার মানুষ মাটির বদনা দিয়ে তাদের পিটিয়ে মারে। একাত্তরে রাজাকারদের অত্যাচারে ক্ষুব্ধ ছিল সাধারণ মানুষ।”

ডিসেম্বর ১৯৭১। প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। ভৈরবকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী। পাকিস্তানিরা তখন শেলিং করতে থাকে। দৌলতকান্দির জামালের বাড়ির কাছে ছিলেন আশরাফুল। হঠাৎ শেলের স্প্রিন্টার এসে লাগে তাঁর ডান পায়ের হাঁটুর নিচে। কেটে রক্তাক্ত হয় পা-টি। সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যান তিনি। কিন্তু তখনও জানেন না কয়েকদিন পর কী অপেক্ষা করছে!

দশ ডিসেম্বরের পর ভৈরবে ঢুকতে থাকে মুক্তিযোদ্ধারা। রাজকাছারিতে একটা ক্যাম্প করা হয় সায়েদুল্লাহর নেতৃত্বে। সেখানেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আশরাফুল করিম। এরপরই এগিয়ে আসে রক্তাক্ত একটি দিন। কি ঘটেছিল ওই দিনটিতে? খানিক নিরবতা। অতঃপর তিনি বলেন-

“১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। সন্ধ্যার পর ভাবলাম বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। চর এলাকায় নৌকা যেখানে ভিড়বে, মানুষের চলাচল যেখানে বেশি- সে স্থানগুলোতে পাকিস্তানি সেনারা পুতে রাখে মাইন। সে খবর আমাদের কাছে ছিল না।

নৌকা নিয়ে আমি গৌরিপুর নৌকাঘাটে নেমে পাড়ের দিকে এগোচ্ছি। হঠাৎ ‘ধুম’ করে একটা বিকট শব্দ হলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি উড়ে গিয়ে পড়েছি কয়েক ফুট দূরে। জ্ঞান তখনও ছিল। দেখলাম বাঁ পা ছিড়ে গেছে। হাঁটুর নিচে গাছের শেকড়ের মতো রগগুলো ঝুলছে। খানিক পরেই তা দিয়ে তীরের বেগে রক্ত বেরুতে থাকে। সামনে মনে হলো তারার মতো কিছু একটা ঘুরছে। এরপরই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।”

“গ্রামের লোকেরা আমাকে ভৈরব বাজারে ডাক্তার সামাদের ওখানে নিয়ে যায়। চিকিৎসা চলে দুই-তিনদিন। ষোল ডিসেম্বরের পর আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে। সেখানেই হাঁটুর নিচে ৬ ইঞ্চি পর্যন্ত রেখে বাঁ পা কেটে ফেলা হয়। এখন কৃত্রিম পা-ই ভরসা। মাঝেমধ্যে পায়ের কাটা জায়গায় ঘা হয়ে যায়। ব্যথা করে খুব। শরীরের ভারে অন্য পা-টাও চিকন হয়ে যাচ্ছে। বিস্ফোরণের ভয়টা মনে গেঁথে গেছে। ফ্লোরে একটা চামচ পড়লে এখনও ভয়ে লাফিয়ে উঠি। শরীরটাও কেপে ওঠে তখন। মৃত্যু পর্যন্ত কষ্টটা থাকবে ভাই। তবুও দেশটাতো স্বাধীন। ওটা ভাবলেই পরম শান্তি।”

যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?

মুচকি হেসে এই বীর বলেন- “দেশ তো পেয়েছি। পতাকা পেয়েছি। মানুষ তো এখন মন খুলে তার ভাষায় কথা বলতে পারে। পাকিস্তান পিরিয়ডে যে অবস্থা দেখেছি তা থেকে অনেক এগিয়েছি আমরা। আক্ষেপ নাই কোন। আমি জীবিত থেকে স্বাধীন দেশটা দেখে যেতে পারছি এটাই অনেক বড় পাওয়া।”

বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের মূল্যায়ন করতে গিয়ে এই বীর যোদ্ধা অকপটে বলেন- “বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। চর্তুদিকে তখন হাহাকার আর অভাব-অনটন। পরাজিত শক্রুদের ষড়যন্ত্রও ছিল। তার মধ্যেই তিনি চেষ্টা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম মূল্যায়ন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমাদের জন্য ট্রাস্ট করে দিয়েছেন। তার সময় থেকেই ৭৫ টাকা ভাতা শুরু হয়। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যের ঘাটতি দেখা দেয়। যুদ্ধটা করার ক্ষেত্রে তারা যেমন ঐক্যবদ্ধ ছিলেন দেশ গড়ার ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। সবাই স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত ছিল। ফলে সে সুযোগটা নেয় স্বাধীনতাবিরোধী ও স্বার্থবাদী চক্র।”

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে ন্যাক্কারজনক অভিহিত করে মুক্তিযোদ্ধা আশরাফুল বলেন- “বঙ্গবন্ধু নেই, এটা শোনার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যা করা হয়েছিল পনের আগস্ট।”

“এরপর ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। সে সময় দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ বন্ধ করে দেওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী বানানো হয় একজন রাজাকারকে। পরবর্তীতে জিয়ার দলের হাত ধরেই মন্ত্রী হন জামায়াতের আলী আহসান মুজাহিদ ও মতিউর রহমান নিজামী।”

রাজাকারের গাড়িতে যখন স্বাধীন দেশের পতাকা, তখন মুক্তিযোদ্ধাদের কেমন লাগতো?

আশরাফুলের উত্তর- “ভীষণ কষ্ট লাগছে। ভাবতাম, হায়রে দেশ! এই দেশের জন্য কি রক্ত দিলাম, অঙ্গ হারালাম। নিরব থেকেছি। তখন রাজাকারদের মূল্যায়ন ছিল বেশি। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ইয়ারকি আর তাচ্ছিল্য করা হতো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে সেই কষ্টের সময়টাকে মুছে দিছে শেখের মাইয়া। ইতিহাসে সে কথাও লেখা থাকবে।”

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রাজাকারদের ফাঁসি হওয়া প্রসঙ্গে দৃঢ়কণ্ঠে এই সূর্যসন্তান বলেন, “যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের আত্মা যেমন শান্তি পেয়েছে। আমরা যারা বেঁচে আছি আমাদের বুক থেকেও একটা জগদ্দল পাথর নেমে গেছে। সত্যিকারের বীরের দেশে বীররাই টিকে থাকে। কারণ ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না ভাই।”

স্বাধীনতা লাভের পূর্ববর্তী সময়ের রাজনীতির সঙ্গে বর্তমানকে মূল্যায়ন করেন এ বীর যোদ্ধা। বলেন, “তখন রাজনীতি ছিল শুধুই দেশের জন্য, মানুষের জন্য। যারা নেতৃত্ব দিত তারা ছিলেন নিবেদিত ও ত্যাগী। এখন নেতৃত্ব মানেই ব্যবসা। নেতৃত্ব মানেই টাকা-পয়সা। এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতিকেও প্রশয় দেওয়া যাবে না।”

বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও সচেতনভাবেই সে পরিচয় এড়িয়ে যান মুক্তিযোদ্ধা আশরাফুল করিম। কিন্তু ঘরে টাঙানো তাঁর সঙ্গে একটি ছবিতে চোখ আটকে যেতেই মুচকি হেসে তিনি শুধু বললেন, “সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি আমার ভাতিজা হন। আমাদের বংশের গর্ব। তাঁর কোন লোভ নেই। খুবই সাধারণ জীবনযাপন করেন তিনি। তাঁর পরিচয় দিয়ে সুবিধা লাভের কথা স্বপ্নেও ভাবি না। তাহলে তো আমিও স্বার্থবাদীর দলে চলে গেলাম।”

স্বাধীন দেশে নতুন প্রজন্ম যখন সফলতার সঙ্গে সারা পৃথিবীতে দেশের নামকে তুলে ধরে- তখন গর্ব হয় এই যোদ্ধার। খারাপ লাগে কখন?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, “যখন দেখি যুব সমাজ নেশাগ্রস্ত। তারা হত্যা, খুন আর ধর্ষণে জড়াচ্ছে। তখন প্রচণ্ড কষ্ট লাগে।”

কী করলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে?

এই যোদ্ধার উত্তর, “দেশটাকে মাদক মুক্ত করতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। আর শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে ঢেলে সাজাতে হবে। রাজনৈতিক দলের মধ্যে জবাবদিহিতা বাড়ানোসহ যুদ্ধাপরাধীর সন্তান ও দালালদের দল থেকে বিতাড়িত করতে হবে।”

কয়েক বছর আগে শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তরুণ প্রজন্মের জেগে ওঠাকে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ বলে অভিহিত করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। প্রজন্মের হাত ধরেই দেশটা একদিন সোনার বাংলা হবে- এমনটাই বিশ্বাস তাঁর। চোখে মুখে আশার আলো ছড়িয়ে পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আশরাফুল করিম বলেন, “তোমরা মানুষের মতো মানুষ হও। মানবিক মূল্যবোধ নিজের মধ্যে সৃষ্টি করো। দেশকে আর মানুষকে ভালবেসো। মনে রেখ, দেশের মুক্তিতেই সবার মুক্তি।”

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম : যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আশরাফুল করিম ।

ট্রেনিং : তিন নম্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টার মনতলাতে আটাশ দিনের ট্রেনিং নেন।

যুদ্ধ করেন : তিন নম্বর সেক্টরের ভৈরব, রামনগর ও গৌরিপুরের বিভিন্ন এলাকায়।

যুদ্ধাহত : ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। সন্ধ্যার পর। গৌরিপুর নৌকাঘাটে পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইনের আঘাতে তাঁর বাঁ পা হাঁটুর নিচ থেকে উড়ে যায়।

সাক্ষাৎকার গ্রহনেঃ সালেক খোকন

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন

সৌজন্যেঃ বিডিনিউজ২৪.কম

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত