6126
Published on মার্চ 11, 2018৭ই মার্চ বাঙালি জাতির এক অবিস্মরণীয় দিন। আমাদের ৬ ও ১১ দফার স্বায়ত্ত শাসনের সংগ্রামকে বেগবান করে ৭ই মার্চের ভাষণ এটাকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত করে। ৭ই মার্চের ভাষণে আমাদের কাছে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন বাংলাদেশ স্বাধীন করার ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না।’ বস্তুত তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু আমাদের বাংলাদেশ স্বাধীন করার দিকনির্দেশনা ও পন্থা বলে দেন।
আসলে ১৯৭১ সালের ১লা মার্চে দুপুর ১টার দিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন অনির্দিষ্টকালের জন্য সংসদ মুলতবি করা হয়েছে। এটি শুনে আমরা যারা কাজকর্মে নিয়োজিত ছিলাম তারা তা তাৎক্ষণিক ফেলে দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় নেমে পড়ি এবং বাংলাদেশ স্বাধীন করার স্লোগান তুলি। কাজ ফেলে দিয়ে মতিঝিলের পূর্বাণী হোটেলে জড়ো হই এ জন্য যে ওখানে বঙ্গবন্ধু আসবেন এবং তার কাছ থেকে জানব কী করতে হবে। আমরা তখন অনেক স্লোগান তুলি যেমন- ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। তখন পুরো ঢাকা শহর উত্তাল শোভাযাত্রা, মিছিল ও স্লোগান স্লোগান। প্রত্যেকের মুখেই একই জোয়ার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। ২ মার্চ আমাদের সামনেই স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সারাটি সপ্তাহই চলল শোভাযাত্রা, মিছিল ও স্লোগান স্লোগান। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দুপুরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রদানের কথা থাকলেও আমরা সকাল থেকে জড়ো হয়েছিলাম।
আমাদের প্রত্যেকের প্রত্যাশা আজকেই পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। আমরা মাঠে জড়ো হওয়ার পর দেখলাম মাথার ওপর দিয়ে বিমান ও হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছে। সবাই ভাবছিলাম, স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাশ ফায়ার করা হবে। ভয়ও ছিল, তবে সবাই ভয় জয় করে ছিল। শুধু আমরা নই, লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয়েছিল সেদিনের সমাবেশে। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর বঙ্গবন্ধু আসলেন এবং সোজা স্টেজে চলে গেলেন। সেখানে অকুতোভয়ে তিনি যে বক্তব্য দিলেন তা আমাদের হৃদয়ের মধ্যে আঘাত করে। তিনি ভাষণ শুরুই করলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন’। জনগণের প্রতি তার কত বড় আস্থা এটি তার ৭ই মার্চের ভাষণ শুনলেই বোঝা যাবে। বঙ্গবন্ধু যখন বললেন, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, আমরা তখন বুঝে গেছি আমাদের কী কী করতে হবে। তবে তিনি আমাদের সতর্ক করেন- তোমরা সাবধানে থেকো, তোমাদের মধ্যে শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুঠতরাজ করবে’।
৭ মার্চের বক্তৃতার প্রতিটি শব্দ ছিল এক একটি বাণী, দিকনির্দেশক। প্রায় ১৯ মিনিটের ছোট একটি বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু সব বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন, দিয়েছেন দিকনির্দেশনা। কী কী করতে হবে- বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি তাদের দেখভালের দায়িত্বও স্মরণ করিয়ে দেন। কয় ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, তাদের কী করতে হবে, মিল মালিকদের শ্রমিকের প্রতি কী করতে হবে তা সবই তিনি তার ১০৭৫ শব্দের ভাষণে তুলে ধরেন। তোমরা কী কী করবা, তার সবাই তিনি উল্লেখ করেছেন ভাষণে। এটি ছিল এক অপূর্ব গাইডলাইন ও নির্দেশনা।
বক্তৃতার শুরুতেই তিনি বাঙালির নির্যাতন, বঞ্চনা, আমরা কীভাবে শোষিত হচ্ছি প্রভৃতির বর্ণনা দিলেন। আমরা যা চাই, পাকিস্তানের শাসকরা তার উল্টোটি করে। অর্থনৈতিক বলেন, সামাজিক বলেন বা রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা বঞ্চনার শিকার। অল্প কথায় তিনি পুরো ২৩ বছরের ইতিহাস তুলে ধরেন। এরপর তিনি বললেন তিনি কী কী করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নির্বাচিত নেতা হওয়া সত্ত্বেও উনারা আমার কথা রাখলেন না, আমার কথা শুনলেন না, কথা শুনলেন ভুট্টো সাহেবের। দেশের মানুষ শাসনতন্ত্র তৈরি করার জন্য, সরকার গঠনের জন্য আমাদের ম্যান্ডেট দিয়েছে কিন্তু তিনি আমাদের কথা রাখলেন না। এগুলো বলার পর তিনি প্রোগ্রাম দিলেন। তিনি চারটি শর্ত দিলেন। এগুলো মানা হলে আমি বিবেচনা করব আমরা সংসদে যাব কিনা। চারটি শর্ত হলো- এক. সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। দুই. সমস্ত সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। তিন. জনগনের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। চার. যেভাবে জনগণকে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর্মিদের বললেন, তোমরা আমাদের ভাই, তোমাদের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা নেই। কিন্তু তোমরা যদি আমার একটি লোককে হত্যা করো, তাহলে বাঙালিরা জানে কী করতে হবে। আমরা রক্ত দিয়েছি, আরো রক্ত দিব। আমরা পলিমাটির মতো নরম আবার যখন শক্ত হই তখন কঠিন শক্ত হতে পারি। সবকিছু বলার পর তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। কোনো লিখিত বক্তব্য তিনি পাঠ করেননি। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিত যা মনে হয়েছে এবং এতদিন তিনি যা ভেবেছেন, লালিত করেছেন, তাই বলেছেন তার ৭ই মার্চের ভাষণে। এখানে তিনি দুটি বিষয় বড় করে তুললেন। একটি হলো স্বাধীনতার সংগ্রাম আর আরেকটি হলো মুক্তির সংগ্রাম। মুক্তি বলতে তিনি অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির কথা বুঝিয়েছেন। আর স্বাধীনতা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ভাষণটি ছিল ঐতিহাসিক। বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীনতার কথা বলেননি, তিনি মুক্তির কথাও বলেছেন। এ ভাষণ শোনার পর আমাদের আর নতুন করে কিছু শোনার প্রয়োজন বোধ হয়নি। আর কোনো ঘোষকেরও প্রয়োজন পড়ে না। কারণ বক্তব্যটি স্পষ্ট। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তেলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, আরো রক্ত দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ’। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে সুঝে কাজ করবেন।
বঙ্গবন্ধু শর্ত দেয়ার পর পাকিস্তানি শাসকরা ঢাকায় আসলেন আলোচনার জন্য। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুর এত বুদ্ধি কেমন করে হলো। তিনি যদি শুধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন, তাহলে তাকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে মেরে ফেলত শত্রু হিসেবে এবং বিশ্ববাসীর কাছে তিনি চিত্রিত হতেন বিছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে যার জন্য বিশ্ববাসীর কোনো সমর্থন থাকত না (নাইজেরিয়ার বায়াফ্র নেতার আন্দোলন অঙ্কুরেই এ কারণে ভেস্তে যায়) বরং আমাদের ওপর অত্যাচার আরো বাড়ত। একবারে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে বঙ্গবন্ধু ৪টি শর্ত দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। এ শর্তগুলো পূরণ করা খুবই কঠিন ছিল সামরিক সরকারের জন্য।
সম্প্রতি আমি বঙ্গবন্ধুর ১০০টি ভাষণ সংগ্রহ করেছি। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও বুদ্ধিদীপ্ত বলিষ্ঠ ভাষণ হচ্ছে ৭ই মার্চের ভাষণ। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর জীবনের সর্বোত্তম বক্তৃতা ছিল ৭ই মার্চের ভাষণ। বিশ্বে অনেক বড় বড় বক্তৃতা আছে কিন্তু যেগুলো অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক সেগুলো সাধারণত ছোট ছোট এবং স্বল্প সময়ে দেয়া। আব্রাহাম লিংকনের বিখ্যাত বক্তৃতা মাত্র ২ মিনিটের। ১৯ মিনিটের এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু ১৫/২০টি বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। এ ভাষণে তিনি বাংলাদেশের- ১. বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। ২. বিভিন্ন জেলায় কীভাবে লোক মারা হচ্ছে ৩. তিনি ন্যায্য প্রস্তাব নিয়ে আসলে তা গ্রহণ করবেন ৪. ইয়াহিয়া খানের কসাইখানা ৫. শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন, কলকারখানা বন্ধ ৬. বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য যে অস্ত্র কিনেছি তা দিয়ে আমাদের গুলি করা হচ্ছে ৭. বাঙালিরা সংখ্যগুরু ৮. ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র ৯. দেখে যান কীভাবে মায়ের কোল খালি করা হচ্ছে ১০. চারটি শর্ত প্রদান ১১. কোর্ট-কাচারি বন্ধ ১২. বেতন নিয়ে আসবেন ১৩. ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল ১৪. সেনাসদস্য ব্যারাকে থাকো ১৫. আহতদের সাহায্য করো ১৬. আত্মকলহ বন্ধ ১৭. রেড়িও টেলিভিশন ১৮. পয়সা চালান বন্ধ ১৯. বুঝে শুনে কাজ করবেন এবং ২০. মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতা সংগ্রাম কোনো বিষয়ই তার দৃষ্টির অগোচরে থাকেনি। তিনি কী কী করেছেন তাও তুলে ধরেছেন। তার দাবিগুলো ছিল সময়োপযোগী, জনগণের মনের কথা। কোনো বাড়ন্ত বক্তব্য ছিল না। কী কী করতে হবে, কী কী করতে হবে না, তাও তিনি তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন। শাসকরা আমাদের কথা না শুনলে তোমরা কাজ করবা না, পৃথিবীতে শুধুমাত্র বাংলাদেশে সবচেয়ে সফল অসহযোগ আন্দোলন হয় যেখানে শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ জনতা তাতে শরিক হয়। আবার সরকারকে বলেছেন, যারা অফিসে যাবে না তাদের বেতন দেবেন। মালিকদের বললেন শ্রমিকদের পাওনা অর্থ তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেবেন। প্রশ্ন হলো, এতসব বিষয় কখন তিনি চিন্তা করলেন। এখন আমরা জানতে পারছি, বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বলে দিয়েছিলেন ‘তোমার মনে যা আসে, তাই বলো’।
৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের একটি দেশ দিয়েছে, দিয়েছে আত্মমর্যাদা। ৭ই মার্চ আমরা বহু বছর থেকে প্রতি বছরই পালন করি। এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, বাংলাদেশের দুটি ঘটনাকে ইউনেস্কো সম্মান জানিয়েছে। একটি হলো- ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের মাতৃভাষা বা জাতীয় শহীদ দিবস এবং অন্যটি ৭ই মার্চের ভাষণ। এর অর্থ হচ্ছে বাঙালিরা আজ যা চিন্তা করে বহির্বিশ্ব তা আগামীতে গ্রহণ করে। সাম্প্রতিককালে আমরা জাতিসংঘে দুটি প্রস্তাব এনেছি। একটি হচ্ছে- ‘শান্তির সংস্কৃতি’ এবং অন্যটি হচ্ছে ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’ বিষয়ক এবং এ দুটি বিশ্ববাসী চরিতার্থ করলে বিশ্বজুড়ে ঠিকসই শান্তি ও প্রগতি অর্জিত হবে। ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের হৃদয়কে শক্ত, সবল করে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছে। যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের মধ্যে হতাশা বা নিরাশা আসলে এই বক্তৃতা শুনলেই আবার আমরা চাঙা হয়ে উঠতাম। এই বক্তৃতার আলাদা ক্ষমতা আছে, শক্তি আছে, প্রেরণা আছে।
আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা করেছি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের কয়েকটি রোডম্যাপ দিয়েছেন। ২০২১ সালে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হবো, একটি ভিশন দিয়েছেন। আরেকটি ভিশন হলো ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন। আরো একটি ভিশন দিয়েছেন যে, ২০৪১ সালে আমরা একটি উন্নত-সমৃদ্ধিশালী-অসাম্প্রদায়িক-স্থিতিশীল অর্থনীতির দেশ হবো। এগুলো খুব সহজ কাজ নয়। এসব ভিশন অর্জনে আমাদের কতগুলো প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। একটি হচ্ছে, দুর্বল অবকাঠামো। দ্বিতীয় হলো, প্রশিক্ষিত উন্নত দক্ষ জনবলের অভাব। আরেকটি হলো, আমলাতন্ত্র। এই তিনটি ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্যোগ নিতে হবে। অবকাঠামোকে আমি দুই ভাগে ভাগ করি। একটি হলো, নদী-নালা-রাস্তাঘাট-বিদ্যুৎ-গ্যাস-ডিজিটালাইজেশন প্রভৃতি। এগুলো দৃশ্যমান অবকাঠামো। এগুলোর সঙ্গে অর্থের যোগ রয়েছে। অর্থ থাকলে এসব অবকাঠামো নির্মাণ সম্ভব। বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব প্রকল্প ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল দরকার। নইলে আমরা হোঁচট খাব। অদৃশ্যমান অবকাঠামোর উন্নতি না হলে দৃশ্যমান অবকাঠামো দিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষা অর্জিত হবে না। আইন-কানুন-রীতি-নীতি-প্রসেস-প্রসিডিওর ইত্যাদি হচ্ছে অদৃশ্য অবকাঠামো। অদৃশ্য অবকাঠামোর উৎকর্ষ অবশ্যই সাধন করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের ডুইং বিজনেস সূচকে আমরা অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশে কোনো ব্যবসা শুরু করতে গেলে ১৭৬ দিন সময় লাগে যেখানে মালয়েশিয়ায় লাগে ১৯ দিন। বিনিয়োগ করতে গেলে হয়রানির শেষ নেই। সরকারি অফিসের সেবার মানও নি¤œমুখী। সেবা গ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারী উভয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সম্ভব। এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন না এলে আমাদের লক্ষ্যগুলো সব ভেস্তে যাবে। আমাদের উন্নত গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো মানবসম্পদ। আমাদের মোট জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ ২৫ বছরের নিচে। এই জনসংখ্যাকে যদি আমরা কাজে লাগাতে চাই, তবে উন্নত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। আমাদের চিন্তাধারায় পরিবর্তন দরকার, প্রয়োজন যুগোপযোগী শিক্ষার, প্রয়োজন যথাযথ প্রযুক্তির। প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করতে হবে। আমাদের মন-মানসিকতায় ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই মানসম্পন্ন সেবা দেয়া হয়। সরকারি অফিসের অনেক অফিসার ও কর্মচারী জনগণের সেবক হয়ে কাজ করেন না। বিদেশের অফিসে ফোন বাজলে সঙ্গে সঙ্গে তা কেউ না কেউ রিসিভ করে। প্রয়োজনীয় কারো ম্যাসেজ থাকলে সেটি রেখে দেয়া হয়। আর আমাদের এখানে ফোন বাজলেও কেউ রিসিভ করে না। ব্রিটিশ আমলে আমাদের বেশিরভাগ আইন তৈরি হয়েছে। সেগুলোর অধিকাংশই বর্তমান সময়ের উপযোগী নয়। এগুলোর আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে জেলা সরকার প্রবর্তনের মাধ্যমে সরকারি সেবার মান পরিবর্তনের কর্মসূচি শুরু করেছিলেন। জেলায় জেলায় নির্বাচিত জেলা সরকার গঠিত হয়। এটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। এর সুফল না ফলায় কোনো লোক বোঝেওনি। জেলায় জেলায় নির্বাচিত জেলা সরকার খুবই প্রয়োজন। আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি পরিবর্তন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে না গেলে কিছুই হয় না। এমন প্রবণতা উন্নয়নের প্রতিবন্ধক। ছোটখাটো বিষয় কেন প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে হবে। সব কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়নের সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আমি গবেষণা করে দেখেছি যে, গণতান্ত্রিক সরকারের সময় দেশের উন্নয়ন হয়েছে সর্বোচ্চ। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গঠন করতে পারলে আমাদের উন্নয়ন আরো বেগবান হবে।
লেখকঃ ইমেরিটাস অধ্যাপক, জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ
সৌজন্যেঃ ভোরের কাগজ