সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে উত্তরণের দর্শন

43

Published on মার্চ 7, 2025
  • Details Image

এম. নজরুল ইসলাম:

⁨বাঙালি জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার ধারাবাহিক করুণ ইতিহাস তুলে ধরে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। কী নেই এই ভাষণে! ভাষণ নয়, যেন রচিত হয়েছিল এক অমর মহাকাব্য। কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কী করে আমাদের হলো’ কবিতায় তুলে ধরেছেন শেষ ফাল্গুনের এক দৃপ্ত বিকেলের কথা। ‘একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে/লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে,/কখন আসবে কবি? কখন আসবে কবি?’

পাতা ঝরার দিনে বাঙালি জাতির মনের একান্ত স্বপ্ন তুলে ধরেছিলেন তিনি।

অসাধারণ ও বহুমাত্রিক ছন্দোময় এক কাব্যিক সেই ভাষণটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে ইউনেসকোর স্বীকৃতি পেয়েছে। এ ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে’ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে এটাই প্রথম কোনো বাংলাদেশি দলিল, যা আনুষ্ঠানিক ও স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হবে। এ ছাড়া বিশ্বের ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে ঐতিহাসিক এই ভাষণটি।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে রাজনৈতিক দিকের মতো একটি দার্শনিক দিক স্পষ্ট। বাঙালি জাতি তো বটেই, সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য রেখে যাওয়া এই দর্শনটি হলো, সব পীড়ন থেকে মুক্তির দর্শন। অহিংস অসহযোগ আন্দোলন থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে উত্তরণের দর্শন।

প্রয়াত সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণের দ্বারা মন্ত্রমুগ্ধ সারা জাতিকে তাঁর পেছনে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।

তারপর ধ্বংসের দিকে নয়, তাদের পৌঁছে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার নতুন উষার স্বর্ণতোরণে।’ প্রয়াত ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খানের ভাষায়, ‘...তা বর্ণনা করার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া আছে আবেগ, রক্ত ঝরানোর নির্মম স্মৃতি এবং তার সঙ্গে গণতান্ত্রিক আশা-প্রত্যাশার ন্যায্যতা, আছে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ এবং যুক্তির জোরালো উপস্থিতি। এসব মিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মানবিক বোধের শ্রেষ্ঠত্ব, গণতান্ত্রিক চেতনার উজ্জ্বলতা এবং নিপীড়িত মানুষের স্বাধিকার অর্জন ও আর্থ-সামাজিক মুক্তির এক অনন্য দলিল হয়ে উঠেছে। এসব গুণের জন্য শুধু বাঙালি নয়, গোটা বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশ পরিস্থিতির প্রকৃত সত্য অনুধাবনে সহানুভূতিশীল করেছে।’ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিশ্বজিৎ ঘোষের ভাষায়, ‘একটি ভাষণ গোটা জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে স্বাধীনতার স্বপ্নে, মুক্তির সংগ্রামে।
একটি ভাষণ বাঙালির ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালির অন্তরে পৌঁছে দিল স্বাধীনতার বার্তা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এ সূত্রেই অনন্য, অতুলনীয় ও ঐতিহাসিক। ভাষণটি ছিল একটি জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের মৌন শক্তি ও রাজনৈতিক দর্শন। অন্যদিকে তা জাগ্রত করেছিল গোটা জাতিসত্তাকে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সব নৃগোষ্ঠীর মানুষকে।’
তিনি বললেন, ‘কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। ...কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস, মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস।

বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে দশ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছিল। ১৯৬৬ সালে ছয় দফার আন্দোলনে, ৭ জুনে আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।...পঁচিশ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি যে ওই শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে, পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে প্রথম। সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। আমি, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’

আজ ৭ মার্চ স্মরণ করি সেই গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপানো কবিকে, যিনি শুনিয়েছিলেন তাঁর অমর মহাকাব্য—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়াপ্রবাসী মানবাধিকারকর্মী, লেখক ও সাংবাদিক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত