এক এগারো আন্দোলনের নেপথ্যের নায়ক শেখ রেহানা

1111

Published on জুন 11, 2022
  • Details Image

মিজানুর হক খান:

বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবচেয়ে দুঃখী মানুষটির নাম শেখ রেহানা । ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সময় বড় বোন শেখ হাসিনা , শেখ রেহানাকে জার্মানিতে নিয়ে আসার কারনে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন । শেখ হাসিনার উসিলায় মহান আল্লাহতালা শেখ হাসিনার জন্য শেখ রেহানাকে বাঁচিয়ে রেখে ছিলেন। বাবা-মা,ভাই সবাইকে হারিয়ে দুই বোন যেন দুই শরীরে একই আত্মা।

শেখ হাসিনার পাশে ছায়ার মত থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রতিটি মুহর্ত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন সুযোগ্য মায়ের যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে। যেমনটি করতেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। পর্দার অন্তরালে থেকেই বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিলেন সংগ্রামী জীবনের সাহস ও অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে একজন নীরব দক্ষ সংগঠক হিসেবে যিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয় সমআসনে অধিষ্ঠিত করেছেন । ঠিক একই ভাবে পর্দার অন্তরালে থেকেই একজন নীরব দক্ষ সংগঠক হিসেবে যিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক ও একজন বিশ্বনেতা হিসাবে অধিষ্ঠিত করেছেন যিনি তিনি হলেন শেখ রেহানা।

বাংলাদেশে আফগানিস্তানের হামিদ কারজাই মতো একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ১১ই জানুয়ারি ২০০৭ সালে বিএনপির পুতুল নাচের সরকারের অবসান ঘটিয়ে সেনাসমর্থিত পশ্চিমা শক্তিসমূহের আজ্ঞাবহ এক এগারো তত্ত্বাবধায়ক সরকার সৃষ্টি হয়েছিল। বিএনপির সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক প্রধান বিচারপতি কে.এম. হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে গিয়ে তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।

২০০৬ সালের ২৭শে অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন তীব্র আন্দোলনের মুখে কে.এম. হাসান প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন ।বিএনপি অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের নীল নকশার নির্বাচন বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্যে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল থাকার পরও অসাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কবর রচনা করে ২৮শে অক্টোবর ডঃ ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন।

ডাঃ ইয়াজউদ্দিন আহমেদ একাধারে রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ায় সাংবিধানিক সংকট দেখা দেয়। বিরোধী দলের আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রথম দিকে আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ৬৮জন নেতাকর্মী নিহত হয়। এমতাবস্থায় মহাজোট সরকার নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ৮ই জানুয়ারি থেকে বঙ্গভবন অবরোধ শুরু হয় ১০ই জানুয়ারি সারাদেশ থেকে বঙ্গভবন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন বিক্ষোভ অচল হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। ১১ই জানুয়ারি নানা নাটকীয় ঘটনা টানটান উত্তেজনার মধ্যে তিন বাহিনীর প্রধান বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগের বাধ্য করেন বাতিল হয় ২২শে জানুয়ারির নির্বাচন ।এভাবেই অবসান হয় বিএনপির ষড়যন্ত্রের নীলনকশা নির্বাচন । ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির দিনটিকে ওয়ান ইলেভেন নামে আখ্যায়িত করা হয় ।যুক্তরাষ্ট্রের নাইন ইলেভেন এর সাথে মিল রেখে এক এগারোর নামকরণ করা হয় ওয়ান ইলেভেন ।দেশব্যাপী রাজনৈতিক গোলযোগ ও চরম বিশৃঙ্খলা এক এগারো এই পটপরিবর্তনকে মানুষ স্বাগত জানিয়েছিল, কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচিত হতে খুব বেশিদিন সময় লাগেনি ।

তথাকথিত সুশীল সমাজ মাইনাস টু ফর্মুলার আওয়াজ তোলে ।ষড়যন্ত্র প্রকৃত মোটিভ আড়াল করতে এর নাম দেওয়া হয়েছিল মাইনাস টু থিওরি যেটি প্রকৃতি অর্থ ছিল মাইনাস শেখ হাসিনা থিউরি। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রম ক্রমশই পরিনিত হয় সেমি মার্শাল ল-তে,একে একে গ্রেফতার হন শীর্ষ রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা । সংস্কারের নামে গ্রেফতার,প্রলোভন ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে গোয়েন্দা বাহিনীর সাহায্যে একাধিক রাজনৈতিক দল গঠন করে । প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ২০০৭ সালের ১১ জুন স্বনামে দুই নেত্রীকে যেতে হবে শীর্ষক প্রতিবেদন লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেন । দেশ-বিদেশে মানুষের মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে যে কোন সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।

২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোর রাতে শ্রী অনিল দাস গুপ্ত (তৎকালীন সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি) আমাকে টেলিফোন করেন । টেলিফোন রিসিভ করতেই তিনি কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বললেন -মিজান, নেত্রীকে ওরা গ্রেপ্তার করেছে, নেত্রীকে ওরা মেরে ফেলবে। আমি দাদার সাথে (শ্রী অনিল দাস গুপ্ত) কোন কথা বলতে পারছিলাম না শুধু বুক ফেটে কান্না আসছিল। ভাবছিলাম ওরা কি সত্যি নেত্রীকে মেরে ফেলবে। দাদা আমাকে বলল মিজান আমাদের নেত্রীকে মুক্তি করতে হবে প্রবাসে প্রতিটি দেশে আমাদের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দাদা আমাকে বললেন পুলিশের কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারো বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করো । সকালেই পুলিশ অফিসে গেলাম, ১৭ই জুলাই সকাল দশটায় প্রতিবাদ সমাবেশের পারমিশন পেলাম ।বার্লিন আওয়ামী লীগের আয়োজনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ ও স্মারকলিপি পেশ করা হয় । জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর থেকে এই সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন জার্মান আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা জনাব আনোয়ারুল কবীর ও তৎকালীন জার্মান আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক বি.এম.ফরিদ আহমেদ বার্লিন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাঙালিরা এই সমাবেশে অংশগ্রহণ এবং প্রতিবাদ করেন ।

দেশ যখন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল তখন যুক্তরাজ্য থেকে আলোকবর্তিকা হয় বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষায় ও শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা আমাদের সকলের প্রিয় ছোট আপা শেখ রেহানা । ইউরোপের প্রত্যেকটি দেশে শেখ রেহানার নির্দেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল । ছোট আপা একদিন আমাকে বললেন শুধু বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ না করে প্রত্যেকটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যেন আমরা প্রতিবাদ সমাবেশ করার চেষ্টা করি । ১৩ ই আগস্ট জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে ।কবি দাউদ হায়দার দৈনিক জনকন্ঠ প্রথম পাতায় নিউজ করেন।তিনি লেখেন- এবার আর বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ নয় কিংবা বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া নয় সরাসরি জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তরের চত্বরে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে বার্লিন আওয়ামী লীগ শাখার উদ্যোগে বিক্ষোভ আয়োজন। জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তর এই প্রতিবাদ সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে বিষয়টি অনেকের কাছে রীতিমতো বিস্ময়ের কেননা কোন দেশের ঘরোয়া রাজনীতির ব্যাপারে এর আগে পররাষ্ট্র দপ্তরের সামনে কোন প্রতিবাদ সমাবেশের অনুমতি দেয়নি ।

ঐদিন দুপুর ১২ টায় বার্লিন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তরের সামনে জননেত্রী শেখ হাসিনার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। সেই জমায়েতে জার্মানির সবরাজ্য থেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও প্রবাসী বাঙালিরা এই সমাবেশে সামিল হন। তাদের কথা হচ্ছে বিপদটা কেবল শেখ হাসিনার জন্য নয় বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিপদজনক। বিষয়টি নিয়ে জার্মান ভাষায় যে স্মারকলিপি লেখা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে শেখ হাসিনা ষড়যন্ত্রের শিকার তাকে ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করেছে। সেই স্মারকলিপিতে আরো লেখা হয়েছিল, বাংলাদেশ ও দেশটির জনগকে বাঁচাতে হত্যা ষড়যন্ত্র মৌলবাদী রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। এবং গণতন্ত্রকে বাঁচাতে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে । উল্লেখ্য এই প্রতিবাদ সমাবেশক সংহতি জানিয়ে জার্মানির কয়েকটি রাজনৈতিক দল সমাবেশে শরীক হয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর এটাই ছিল একমাত্র আন্দোলন যেখানে জার্মানির বিভিন্ন দল সমর্থন করেছিল। ডিসেম্বর মাসে ডয়চে ভেলে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি ও প্রবাসের শেখ হাসিনার নিঃশর্ত মুক্তির আন্দোলন শিরোনামে টেলিফোনে একটি সংলাপের আয়োজন করে। এই সংলাপে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অংশ গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, লন্ডন থেকে মোহাম্মদ সুলতান শরীফ, ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে শ্রী অনিল দাস গুপ্ত এবং বার্লিন থেকে আমি মিজানুর হক খান অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমার মত একজন সাধারন কর্মী বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাথে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় জননেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তি চাইতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিল।

এক এগারো সময় প্রবাসী বাঙালিরা প্রমাণ করেছে তারা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে কতটা ভালবাসে। নেতা-নেত্রী জেলে গেলেই আন্দোলন হয় না, আন্দোলন করতে হলে মানুষের ভালোবাসা পেতে হয়। জনগণ যদি ভালোবেসে আন্দোলন করে তবে কোন সরকারের ক্ষমতা নেই সেই আন্দোলনকে দমন করতে পারে। যার উদাহরণ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এক এগারোর মিথ্যা মামলা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাংবিধানিক ও সেনাবাহিনীর নিয়ম ভঙ্গ করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ভূলুণ্ঠিত করে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে ভাংঙ্গন ধরনের চেষ্টা করেছিল।

ঠিক তখনই প্রাজ্ঞ শেখ রেহানা, লন্ডনে বসবাসরত সৈয়দ আশরাফকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন। সৈয়দ আশরাফ বিশ্বাস ও আস্হার সাথে এক এগারোর দুঃসময়ে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন । সেই সময় শেখ রেহানা গভীর মমত্ব ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আওয়ামী লীগকে ভাঙ্গনের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন । শেখ রেহানার দূরদর্শিতা ও দুঃসাহসী নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ১১ই জুন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল, মুক্তি পেয়েছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্র।

লেখকঃ সাবেক সভাপতি বার্লিন আওয়ামী লীগ

সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত