1002
Published on মার্চ 7, 2022এম নজরুল ইসলামঃ
একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়েলক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছেভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে-কখন আসবে কবি?কখন আসবে কবি?কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় এভাবেই উঠে এসেছে শেষ ফাল্গুনের এক দৃপ্ত বিকেলের কথা। পাতাঝরার দিনে বাঙালী জাতির মনের একান্ত স্বপ্ন তুলে ধরেছিলেন তিনি। ১৯ মিনিটের অসাধারণ ও বহুমাত্রিক ছন্দময় এক কাব্যিক সেই ভাষণটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। এ ভাষণকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে’ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে এটাই প্রথম কোন বাংলাদেশী দলিল, যা আনুষ্ঠানিক ও স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হবে। এছাড়া বিশ্বের ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে ঐতিহাসিক এই ভাষণটি।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণ নয়, যেন রচিত হয়েছিল এক অমর মহাকাব্য। কি নেই এই ভাষণে! বাঙালী জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার ধারাবাহিক করুণ ইতিহাস আছে। লন্ডনপ্রবাসী আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘মহাকাব্যের সামগ্রিকতা ধরা পড়েছে এই ভাষণে। আর এই ভাষণদাতাও মহাকবি হিসেবে স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে রাজনৈতিক দিকের মতো একটি দার্শনিক দিক স্পষ্ট। তিনি বাঙালী জাতিকে তো বটেই, সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য একটি দিকদর্শন রেখে গেছেন। এই দর্শনটি হলো, সব পীড়ন থেকে মুক্তির দর্শন। অহিংস অসহযোগ আন্দোলন থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে উত্তরণের দর্শন।’ আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী আরও লিখছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের দ্বারা মন্ত্রমুগ্ধ সারা জাতিকে তাঁর পেছনে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তারপর ধ্বংসের দিকে নয়, তাদের পৌঁছে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার নতুন ঊষার স্বর্ণতোরণে।’ প্রয়াত ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খানের ভাষায়, ‘...তা বর্ণনা করার সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া আছে আবেগ, রক্ত ঝরানোর নির্মম স্মৃতি এবং তার সঙ্গে গণতান্ত্রিক আশা-প্রত্যাশার ন্যায্যতা, আছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ এবং যুক্তির জোরালো উপস্থিতি। এসব মিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মানবিক বোধের শ্রেষ্ঠত্ব, গণতান্ত্রিক চেতনার উজ্জ্বলতা এবং নিপীড়িত মানুষের স্বাধিকার অর্জন ও আর্থ-সামাজিক মুক্তির এক অনন্য দলিল হয়ে উঠেছে। এসব গুণের জন্য শুধু বাঙালী নয়, গোটা বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশ পরিস্থিতির প্রকৃত সত্য অনুধাবনে সহানুভূতিশীল করেছে।’ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিশ্বজিৎ ঘোষের ভাষায়- ‘একটি ভাষণ গোটা জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে স্বাধীনতার স্বপ্নে, মুক্তির সংগ্রামে। একটি ভাষণ বাঙালীর ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালীর অন্তরে পৌঁছে দিল স্বাধীনতার বার্তা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এ সূত্রেই অনন্য, অতুলনীয় ও ঐতিহাসিক। ভাষণটি ছিল একটি জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের মৌন শক্তি ও রাজনৈতিক দর্শন। অন্যদিকে তা জাগ্রত করেছিল গোটা জাতিসত্তাকে- বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সব নৃগোষ্ঠীর মানুষকে।’
তিনি বললেন, ‘কি অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলব, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস, মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস।
বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে দশ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছিল। ১৯৬৬ সালে ৬ দফার আন্দোলনে, ৭ জুনে আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ... পঁচিশ তারিখে এ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি দশ তারিখে বলে দিয়েছি যে, ওই শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে, পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। এ্যাসেম্বলি কল করেছেন আমার দাবি মানতে হবে প্রথম। সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখব আমরা এ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে এ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। আমি, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই।’
‘ভাষণটির গঠনে কৌশলময়তা আছে, কূটনৈতিক প্রজ্ঞা, ইতিহাস থেকে নেয়া শিক্ষা, সময়জ্ঞান ও শব্দচয়নের মুনশিয়ানা’ উল্লেখ করে শামসুজ্জামান খান লিখছেন, বাংলার মানুষকে একাত্ম করার জন্য এবং নিজ ক্যারিশমা অনুযায়ী তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অভিভাবক হিসেবে নিজ কাঁধে নেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু ‘আমার’ শব্দটি বারংবার ব্যবহার করেছেন। উদাহরণ ‘ভাইয়েরা আমার’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে’, ‘আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে’, ‘আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি... আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার দেশের গরিব, দুঃখী, নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে-তাঁর বুকের ওপর হচ্ছে গুলি’, ‘আমার গরিবের ওপর’, ‘আমার বাংলার মানুষের’, ‘আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে’, ‘আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে,’ ‘আমার মানুষ কষ্ট না করে’, ‘আমার লোককে হত্যা করা হয়’ ইত্যাদি।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের নির্দেশনার তাৎপর্য ছিল প্রধানত দেশব্যাপী, যাতে বাঙালীরা সঠিক নেতৃত্বের অধীনে সুসংগঠিত হয় এবং সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। যুদ্ধোন্মুখ সাধারণ মানুষ এবং অস্ত্রধারী বাঙালী সেনা, ইপিআর, পুলিশ ও অন্যদের শত্রু যেন অতর্কিত হামলা করে পর্যুদস্ত করতে না পারে। এর প্রতিফলন মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আমরা দেখেছি। ২৬ মার্চের আগে কিছু বাঙালী সেনা ইউনিট বিদ্রোহ করে পাকিস্তানী পক্ষ ত্যাগ করেছিল। এসব সেনা ইউনিটসহ পুলিশ, ইপিআর এবং সারাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে একটা শক্ত প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। আজ ৭ মার্চ স্মরণ করি সেই গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপানো কবিকে, যিনি শুনিয়েছিলেন তাঁর অমর মহাকাব্য ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি, অস্ট্রিয়া প্রবাসী, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী
সৌজন্যেঃ দৈণিক জনকণ্ঠ