935
Published on মার্চ 7, 2022আনিস আহমেদঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিস্ময়কর এক বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব। আবেগ ও যুক্তির সমন্বয়ে গঠিত এমন একজন তুখোড় রাজনীতিক, যিনি যথার্থই জানতেন কখন কীভাবে কোন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তার মধ্যে যেমন ছিল এক অসাধারণ আত্মবিশ্বাস, তেমনি ছিল অন্তর্নিহিত এক সারল্য। যে সারল্য অসময়ে তার সফল ও বর্ণাঢ্য জীবনের অকাল অবসান ঘটাল। কিন্তু ৫৫ বছরের এই জীবনে, সেই টুঙ্গিপাড়ার এক অজপাড়াগাঁ থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকা পর্যন্ত তার জীবনের যে বিস্তৃতি; তার প্রতিটি মুহূর্তকে তিনি সদর্থক ও সক্রিয় করে রেখেছিলেন। এমনকি কারাগারে বসেও তিনি লিখেছেন 'কারাগারের রোজনামচা' এবং 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী', যাতে রয়েছে অন্তর্গত এমন কিছু তথ্য, যা তার মৃত্যুর পরও বাংলাদেশের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য উপাদান হয়ে আছে। তার জীবনকাল এবং ভারতীয় উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ইতিহাস প্রায় সমান্তরালভাবে এগিয়েছে। কখনও তিনি এই ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছেন; কখনও ইতিহাসের সক্রিয় অংশ হয়েছেন। মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ হয়ে আওয়ামী লীগ পর্যন্ত তার যে বিবর্তন, তাও মুজিবের মধ্যকার এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।
পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরই যখন এটা পরিস্কার হয়ে গেল- আর যাই হোক পূর্ববাংলার মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত হবে না; ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে পূর্ববাংলাকে শোষণ করা হবে; তখনই শেখ মুজিব মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং ১৯৫৩ সালে দলটিকে সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক করার লক্ষ্যে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেন। লক্ষ্য করার বিষয়, পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র বছর কয়েকের মধ্যেই যখন মুজিব দেখলেন, এতে পূর্ববঙ্গের মানুষের কোনো উপকার হচ্ছে না বরং তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও পাকিস্তানি প্রশাসক তাদের ইচ্ছা চরিতার্থ করার চেষ্টা চালাচ্ছে, তখন পাকিস্তান আন্দোলনের অসারতা সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত হলেন। তার পরের ইতিহাস সবারই জানা। জেল-জুলুম, নিরাপস সংগ্রাম, ছয় দফা আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভ, গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত সংগ্রাম পর্যন্ত এই মহিরুহ ব্যক্তিত্বের জীবনের প্রায় সবটুকুই এখন সবাই জানেন। এই দীর্ঘ ইতিহাসের পথ ধরেই বঙ্গবন্ধু একটি জাতিকে জাতিরাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু অতএব বাঙালি জাতিকে একটি সত্যিকারের আত্মিক পরিচিতি দিয়েছেন।
সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির কারণে বাঙালি শব্দটির অর্থ বহুদিন বাংলার হিন্দু ও মুসলমান উভয়ই ভিন্নভাবে দেখেছেন। বহু মুসলমান মনে করেছেন, তারা বাঙালি নন; কেবলই মুসলমান; আরব কিংবা পারস্য দেশ থেকে আসা মানুষ। ভেবেছেন, বাঙালিত্বের মাধ্যমে তাদের ধর্ম হয়তো বিনষ্ট হবে। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, হিন্দুরাও এক সময় বাঙালিত্বের সংজ্ঞায় মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করতে চাননি। ধর্ম ও সংস্কৃতি যে অভিন্ন বিষয় নয়- সে কথা বুঝতে বাংলার হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই দীর্ঘদিন ব্যর্থ হয়েছে। ধর্মীয় আচার-উপাচারের বাইরে আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবন প্রভাবিত হয় দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, তার জলবায়ু, মানুষের অভ্যাস- এ রকম কিছু উপাদানের মাধ্যমে, যাকে আমরা বৃহত্তর অর্থে সংস্কৃতি বলতে পারি।
এখানেই আমরা লক্ষ্য করি শেখ মুজিবুর রহমানের দুটি কৃতিত্ব। প্রথমত, তিনি বাঙালিত্বের প্রাক-বিচারিক ধারণায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসেন। মুসলমানত্বের যে ধারণার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের জন্ম, সেটি যে মিথ্যে মিথ- সে কথা স্পষ্ট তুলে ধরেন যখন তিনি বাঙালি ও মুসলমানের মধ্যকার অযৌক্তিক বিভাজনের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষমাত্রই যে বাঙালি- সে কথাটা রাজনৈতিক আঙিনায় সোচ্চার করে তোলেন মুজিবই প্রথম। দ্বিতীয়ত তিনিই হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি একটি জাতিকে জাতিরাষ্ট্রে পরিণত করেন। শেখ মুজিব হাজার বছরের বাঙালিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র দিলেন। মুজিবের কৃতিত্ব এখানেই; তিনি বাংলাদেশের মানুষের পরিচিতিকে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি থেকে মুক্ত করলেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে- মুজিব কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন; নাকি সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভ করা সত্ত্বেও তাকে অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে দেওয়া হয়নি বলেই তিনি স্বাধীনতার ডাক দিলেন? নাকি ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডই এর কারণ? ইতিহাসে প্রায় সব ঘটনার কিছু তাৎক্ষণিক কারণ তো থাকতেই পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে চান- সে ব্যাপারে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তবে কৌশলগত কারণে তিনি সেই সংকল্প প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছেন অনেক পরে। নইলে তিনি জাতির পিতা নন; বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিত্রিত হতেন। ১৯৬৬ সালে তিনি যখন ছয় দফা ঘোষণা করেন, তখনই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি কার্যত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পৃথক হওয়ারই ইঙ্গিত দেন। পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখার জন্য তদানীন্তন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খান যে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) জারি করেছিলেন; মুজিব কৌশলগত কারণে এই নির্দেশ মেনে নিয়েই নির্বাচনে অংশ নিলেন। পাশাপাশি তিনি নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ৬ দফার ওপর জোর দিলেন। বললেন, ৬ দফা হচ্ছে স্বায়ত্তশাসনের দাবি। সহজে বুঝতে দিলেন না যে ছয় দফা প্রকৃতপক্ষে তদনীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ছিল ম্যাগনাকার্টা স্বরূপ। এ ব্যাপারে তার নিরাপস অবস্থানের পরিচয় পাওয়া যায় একাত্তর সালের জানুয়ারি মাসে তিনি যখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ সদস্যদের নিয়ে এক জনসভায় শপথ পাঠ করান- কোনোক্রমেই তারা কেউ ছয় দফার প্রশ্নে কোনো রকম আপস করবেন না। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি প্রশাসক এবং ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায়ও তিনি ছয় দফার কোনো দফাই পরিত্যাগ করতে সম্মত হননি। ততদিনে পাকিস্তানি আলোচকরা বুঝে ফেলেছিলেন- সত্যিই এ হচ্ছে বাঙালির মুক্তির সনদ।
দেশপ্রেমের গভীর ও হূদ্যিক অনুভবের পাশাপাশি যৌক্তিক কৌশলের প্রয়োগ ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয়। তার ৭ মার্চের ভাষণের শেষ দুটি বাক্যে যখন তিনি 'মুক্তি' ও 'স্বাধীনতা' শব্দের মধ্যে এক রকম সমীকরণ সাধন করেন তখন বোঝা যায়; যখনই তিনি 'মুক্তি' শব্দটি ব্যবহার করেছেন, তখন তিনি শব্দটি 'স্বাধীনতা' অর্থেই ব্যবহার করেছেন। রাজনৈতিক কৌশলের কারণে একেবারে শেষে তিনি বুঝিয়ে দিলেন- 'মুক্তি' শব্দটি তার কাছে 'স্বাধীনতা'রই সমার্থক। তাই ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল নিউজউইক পত্রিকা তাকে যথার্থই বলেছিল, 'পোয়েট অব পলিটিক্স'। কিউবার তৎকালীন নেতা ফিদেল কাস্ত্রোও যথার্থ বলেছিলেন, 'আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু দেখেছি শেখ মুজিবকে।' এই হিমালয়সমান ব্যক্তিত্ব যে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হলেন, তা শুধু বাঙালির আবেগের উচ্চারণ নয়; যুক্তিরও উক্তি।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক
সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল