বিচ্ছিন্নতা দূর করে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ভাষা

960

Published on ফেব্রুয়ারি 21, 2022
  • Details Image

এম. নজরুল ইসলাম:

বাঙালির মেরুদন্ড মাতৃভাষা বাংলা-এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পাকিস্তানের জন্ম থেকেই বাঙালিরা ছিল সোচ্চার। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন করাচীতে শুরু হলে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষার ওপর একটি সংশোধনী প্রস্তাবে বলেন, উর্দু এবং ইংরেজীর সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হোক। সংশোধনী প্রস্তাবটির ওপর আলোচনায় ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেন, ‘পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।’ পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন বলেন, ‘পূর্ব বাংলার অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনোভাব যে, একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।’ (নওবেলাল, ৪ মার্চ, ১৯৪৮)।

মুসলিম লীগ দলীয় বাঙালি সদস্যদের বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার খবর ঢাকায় এলে দারুণ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মুসলিম লীগারদের উর্দুভাষা প্রীতির বিরুদ্ধে ঢাকায় ২৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-ধর্মঘট পালিত হয়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল শেষে বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন পরিচালনার উদ্দেশ্যে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে কামরুদ্দিন আহমদ-এর সভাপতিত্বে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে সর্বদলীয় সংগঠন দাঁড় করানো হয়। সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ১১, ১৩ ও ১৪ মার্চ (১৯৪৮) সারা পূর্ব বাংলায় হরতাল পালিত হয়। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের বর্ধমান হাউজস্থ (বর্তমানে বাংলা একাডেমী ) বাসভবনে ১৫ মার্চ মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের বৈঠকে ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শনকরে। ঐদিনই প্রধানমন্ত্রীর সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আপস-রফা আলোচনা-বিতর্কের পর প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিন ৭-দফা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। দফাগুলি ছিল: ১. বন্দি-মুক্তি, ২. তদন্ত অনুষ্ঠান, ৩. ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার, ৪. আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা রহিতকরণ, ৫. বাংলাকে প্রাদেশিক সরকারি ভাষার মর্যাদা প্রদান, ৬. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ প্রাদেশিক সংসদীয় সভায় বাংলার প্রচলন, ৭. সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। ছাত্রদের চাপে প্রধানমন্ত্রী ৭ম দফার পরে ৮ম দফায় নিজ হাতে লেখেন, ‘সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনার পর আমি এ ব্যাপারে নি:সন্দেহ হইয়াছি যে, এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই।’ এই চুক্তি ছিল বাঙালিদের এক বিশাল বিজয়ের প্রতীক।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ৩১ জানুয়ারি (১৯৫২) বিকেলে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে ঢাকা বার লাইব্রেরীতে সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে উক্ত সভায় সর্বসম্মতভাবে ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ গঠন করে নিম্নে বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় : ক. চুক্তি ভঙ্গ করে খাজা নাজিমউদ্দিনের দম্ভোক্তির নিন্দা, খ. বাংলা ভাষা লেখার জন্য আরবি অক্ষর প্রচলনের অপচেষ্টায় ক্ষোভ প্রকাশ, গ. ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের সাধারণ ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন দান, ঘ. জননিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার ও এই আইনের আওতায় বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি।

মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা স্থাপনে একটি জাতির প্রচেষ্টা এবং আত্মোৎসর্গ দুনিয়ার অন্য কোন জাতির ইতিহাসে নাই। বাংলাভাষার গৌরবময় সংগ্রামের ইতিহাস বিশ্ববাসীর নিকট চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম প্রথম চিন্তা করেন। তারা বিশ্বের মাতৃভাষাপ্রেমী সংস্থার মাধ্যমে জাতিসংঘের নিকট ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব উপস্থাপনের উদ্যোগ নেন। প্রস্তাবটি পেয়ে জাতিসংঘ কর্তৃপক্ষ জানায় এটি বাংলাদেশ সরকার দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবিত হতে হবে। এই সংবাদ জানার পর তৎকালীন জননেত্রী শেখ হাসিনার গণতান্ত্রিক সরকার তড়িৎগতিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। যার ফল হিসেবে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালের ১৫ নভেম্বর প্যারিসে তার ৩০তম সাধারণ সভায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে সর্বসম্মতিক্রমে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তারপর থেকে পৃথিবীর ১৮৮টি দেশের ৬০০ কোটিরও অধিক মানুষ প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে। ইউনেস্কো কর্তৃক এই স্বীকৃতি বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ও তার উৎস-প্রতিক ২১ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বজনতার বাক, বিবেক, লেখা, প্রকাশনের অলঙ্ঘনীয় অধিকারের স্মারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। সেদিন ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেস্কো বলেছিল : ‘মাতৃভাষা প্রচলন ও বিকাশের সকল প্রচেষ্টা কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য ও বহুভাষী শিক্ষাকে উৎসাহিত করবে না, তাদের বিশ্বব্যাপী বিকাশেও ভূমিকা পালন করবে এবং সংলাপ, সমঝোতা ও সহনশীলতার ভিত্তিতে সংহতিকে উৎসাহিত করবে।’

আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদার দাবি, স্বাধীকার সংগ্রাম ও আর্থ-সামাজিক অর্জনের ভিত্তি মহান একুশ। ১৯৫৩ সালের নভেম্বরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে তাদের প্রতিশ্রুত ২১-দফার ১ম দফায় ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। অন্য কোন উপায় না দেখে বাঙালির ভাষার দাবি মেনে ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালে পাকিস্তানে প্রথম ও দ্বিতীয় সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। গৌরবোজ্জ্বল এই স্বীকৃতি আদায়ের পর ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঐতিহাসিক ৬-দফা ঘোষণা করেন। তারপর ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে সংবিধান সম্পর্কিত আইন গৃহীত হয়। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয় : এই প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ১৯৭১ সালে পাক-বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর গোলাম আজম-নিজামীগং কর্তৃক ধ্বংসকৃত শহীদ মিনার বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালে পুনর্নিমাণ, সর্বস্তরে বাংলাভাষা প্রচলন, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রথম বাংলায় ভাষণ-এই সবই প্রমাণ করে বাঙালির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি বাংলাভাষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আপোষহীন।

আজীবন মাতৃভাষাপ্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনরে সূচনা পর্বে ১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখনে। এক কথায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত। সঙ্গত কারণেই এবারের অমর একুশে বইমেলা ২০২২-এর মূল প্রতিপাদ্য ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসেবে প্রতিবারই জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর সরকার বাংলাভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরও ভাষার চর্চার ব্যাবস্থা করেছেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছেন, যেখানে হারিয়ে যাওয়া মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২ উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা যেমন জরুরি তেমনি অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের সাহিত্যকে বিশ্ব-পরিসরে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক সাহিত্য সম্মেলন এবং সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে উন্নত চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা অতি প্রয়োজন।’ তিনি বলেন, প্রযুক্তির ব্যাপক বিকাশে মুদ্রিত বইয়ের বিকল্প আবিষ্কৃত হলেও ছাপা বইয়ের আবেদন কখনো ফুরোবার নয়। এ জন্যই অমর একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা।’

প্রধানমন্ত্রীকে আমরা অভিনন্দন জানাই।

সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অঙ্গীকার থেকে দূরে সরে আসা যাবে না। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়-এই সত্যটি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। বাংলাদেশে জঙ্গী-মৌলবাদের তৎপরতা আমাদের সংস্কৃতিকে বিপদগ্রস্ত করেছিল। বর্তমান সরকার কঠোরভাবে জঙ্গী-সন্ত্রাসী চক্রকে নির্মূল করে বাংলা ভাষা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে রক্ষা করে চলছে।

ভাষা মানুষের বিচ্ছিন্নতা দূর করে, পরস্পরকে ঐক্যবদ্ধ করে। ভাষা শ্রেণি মানে না, ধর্ম মানে না, আঞ্চলিক বিভেদকে অগ্রাহ্য করে। কাজেই দেশ ও জাতির ঐতিহাসিক প্রয়োজনে বাংলা ভাষা চর্চাকে বিকশিত ও উন্নত করাই হবে আমাদের অন্যতম কর্তব্য।

লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক

সূত্র : মানবকন্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত