ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধু

1439

Published on ফেব্রুয়ারি 7, 2022
  • Details Image

তন্ময় আহমেদ:

'মোদের গরব মোদের আশা আমরি বাংলা ভাষা' অতুলপ্রসাদ সেনের এই কথা প্রতিটি বাঙালিরই মনের কথা। মা, মাটি আর মুখের বোল- এই তিনে মনুষ্য জন্মের সার্থকতা। নিজের মুখের ভাষার চেয়ে মধুর আর কিছু হতে পারে না। মাতৃভাষার অধিকারকে বুকের রক্ত দিয়ে আপন করে নেওয়ার ইতিহাস আমাদের। এই ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য অবদান রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন সক্রিয় ছিলেন তিনি।

তিনি তখনও ছাত্র। কলকাতা থেকে ফিরে আইন পড়তে ভর্তি হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু দিনরাত মাথার ভেতরে গুঞ্জরণ করে যাচ্ছে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার আগুন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র বুঝতে পারেন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।

পাকিস্তানিরা শুরুতেই আঘাত হানতে চেয়েছিল হাজার বছরের আবহমান বাংলার সংস্কৃতির ওপর। এরই প্রথম পদক্ষেপ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতির ওপর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া। করাচির বৈঠক থেকে এ সিদ্ধান্তের কথা ঢাকা পর্যন্ত আসতে না আসতেই উত্তাল হয়ে ওঠে দামাল ছাত্রছাত্রীরা। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন শেখ মুজিব।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট পালিত হয় ঢাকায়। সচিবালয়ের সামনে থেকে প্রতিবাদরত অবস্থায় আটক করা হয় তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দেন। সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভ শুরু করে ছাত্র-জনতা। সেদিনও প্রথম সারিতে থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার সক্রিয়তার গুরুত্ব অনুধাবন করে অবশেষে তাকে জনবিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান সরকার। ১১ সেপ্টেম্বর আবারো গ্রেফতার করে জেলে নেওয়া হয় জনপ্রিয় ছাত্রনেতা শেখ মুজিবকে। কিন্তু জেলে বসেও তিনি ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে পরামর্শ দিতে থাকেন। আজ আমরা বাংলা ভাষায় বিশ্বজয়ের যে স্বপ্ন দেখি, তার মূল ভিত্তি বঙ্গবন্ধুর হাতেই রচিত। এ বাংলা প্রতিটি বর্ণমালায় তাই মিশে আছে বঙ্গবন্ধুর নাম। ডিজিটাল যুগের কবিতায় কবিরা তাই লিখে যায়--

''অনন্ত অন্তরীক্ষের অগ্নি স্লোগান তুমি শেখ মজিবর
জয় বাংলার বর্ণমালায় সেজে ওঠে আমাদের অম্বর;''

১৯৪৭ সালে, যেখানে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৪.৬ শতাংশ লোক বাংলা এবং মাত্র ৭.২ শতাংশ লোক উর্দু ভাষায় কথা বলতো, সেখানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অর্থই ছিল বাঙালি জনগণকে দাবিয়ে রাখা। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি।

যথা: প্রথমত- আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা। কারণ, বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হলে চাকরির ক্ষেত্রে বাঙালির স্বাভাবিকভাবেই অবাঙালিদের থেকে পিছিয়ে পড়তো।

দ্বিতীয়ত- জনগণকে হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা থেকে বিচ্যুত করা। আদর্শ, চেতনা, মূল্যবোধ থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব হলে; কোনো জাতির জাতির ওপর যা ইচ্ছা তাই চাপিয়ে দেওয়া সহজ হয়। সোজা কথায়- আমাদের বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করা।

তরুণ শেখ মুজিবের ঢাকায় ফেরা

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই মুসলিম লীগ শাসকগোষ্ঠী অত্যন্ত সুকৌশলে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা পূর্ব বাংলাকে ইসলামীকরণের অজুহাতে নিত্য ব্যবহার্য খাম, ডাকটিকিট, রেলগাড়ির টিকিট, বিভিন্ন ধরনের ফরম প্রভৃতিতে বাংলা ব্যবহার বন্ধ করে দেয় এবং তার স্থলে ইংরেজি ও উর্দুর ব্যবহার শুরু করে। এ রকম একটি পরিস্থিতে, ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে শেখ মুজিব কলকাতার ছাত্র জীবন ও রাজনৈতিক অধ্যায় শেষ করে ঢাকায় ফেরেন এবং ১৫০ মোগলটুলীতে ওঠেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে। এ সময় তাজউদ্দীনের সাথে তার পরিচয় হয়।

গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠন

ভারত বিভক্তির পূর্বেই মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক ও সুবিধাবাদী রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়েছিলেন শেখ মুজিব। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, মুসলিম লীগের সাথে থেকে বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই ৩ জুন (১৯৪৭) মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনা ঘোষণার সাথে সাথে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের সিরাজুদ্দৌলা হোস্টেলে ছাত্র ও যুব নেতাদের নিয়ে এক রুদ্বদ্বার বৈঠকে মিলিত হন তিনি। এরপর শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গঠিত হয় পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ।

প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন

১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচিতে যে শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। আর এ সংবাদ ঢাকায় এসে পৌঁছলে, ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এক প্রতিবাদ সভা আহ্বান করা হয়। তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে মুসলিম ছাত্রলীগ, গণতান্ত্রিক যুব লীগ ও তমদ্দুন মজলিশের সমন্বয়ে গঠিত হয় প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।

এ উদ্যোগে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা ভাষার দাবিতে কয়েক হাজার মানুষের স্বাক্ষর নিয়ে, স্মারকলিপি তৈরি করে, সেটি সরকারের কাছে পাঠানো হয়। এ স্বাক্ষর অভিযান সফল করতে অন্যান্যদের সাথে শেখ মুজিবও অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।

ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা

তৎকালীন সময়ে, গণতান্ত্রিক যুবলীগের পরপরই যে ছাত্র সংগঠনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে- সেটি হলো পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ ক্ষেত্রে তিনি তার কলকাতার ছাত্রজীবনের সাংগঠনিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান।

এর ফলশ্রুতিতেই ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলে এক কর্মী সভায় গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। নবগঠিত এ সংগঠনটিতে শুধু কৌশলগত কারণেই ‘মুসলিম’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় পরবর্তীকালে শেখ মুজিব মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নামকরণ করেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ যে ১০ দফা দাবি ঘোষণা করে, তার মধ্যে একটি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করা।

দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এই অধিবেশনে পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব করেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনও এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবটি নিয়ে গণপরিষদে তুমুল বিতর্ক হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা বাতিল হয়ে যায়।

প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকার ছাত্র সমাজ বাংলা ভাষার দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে শহর প্রদক্ষিণ করে। আর এ মিছিলের পুরো ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করেন শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৪৮ সালের ২ মার্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের এক সভা আহ্বান করা হয় । কামরুদ্দীন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

এ সভায় পূর্ববর্তী সংগ্রাম পরিষদ বিলুপ্ত করে ছাত্রলীগ, গণ আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদ্দুন মজলিশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল সংসদের দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে গঠন করা হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সর্বদলীয় পরিষদ। এ পরিষদ ১১ মার্চ সারা পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে এবং তা সফল করার জন্য ব্যাপকভাবে পিকেটিং করার সিদ্ধান্ত নেয়।

শেখ মুজিবের কারাবরণ

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ, ধর্মঘট সফল করার জন্য সকাল বেলা ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে অবস্থান গ্রহণ করে। শেখ মুজিবুর রহমান সেক্রেটারিয়েটের ১ নং গেটে (আব্দুল গনি রোড) অবস্থান নেন। শেখ মুজিবসহ আরও কয়েকজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

১১ মার্চের এ ধর্মঘট শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা সারা দেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের পথিকৃত ছিল এ দিনটি।

পরবর্তী কয়েকদিন মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে ছাত্র সমাজ। তীব্র আন্দলনের মুখে ১৫ মার্চ সরকার সবাইকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শেখ মুজিবসহ অন্যান্য ছাত্রনেতাকে একটি ট্রাকে করে সারা শহর প্রদক্ষিণ করানো হয় এবং সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

১৬ মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন। শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুগ্ধ হয়ে ৭৬ বছরের বৃদ্ধ শেরে বাংলা একে ফজলুল হকও প্রত্যক্ষভাবে এই আন্দোলনে অংশ নেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন।

মোহাম্মদ আলীর জিন্নাহর ঢাকা আগমন

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষণদানকালে বাংলা ভাষার বিরোধিতা করে জিন্নাহ বলেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এ সময় ছাত্ররা ‘না’ ‘না’ বলে প্রতিবাদ করে। ছাত্র সমাজের এ সমবেত প্রতিবাদেও সামনে থেকে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ ও আব্দুল মতিন।

মুসলিম লীগ সরকারের দমননীতির কারণে শেখ মুজিবকে ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কারারুদ্ধ করা হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ১৯৪৯ সালে আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করলে, শেখ মুজিবের হাতে গড়া সংগঠন ‘ছাত্রলীগ’ এর জোরালো প্রতিবাদ করে।

শেখ মুজিব: ছাত্রনেতা থেকে জননেতা

বাংলা ভাষার দাবি জানানোর কারণে জেলে থাকা অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হন শেখ মুজিবুর রহমান। সফল ছাত্রনেতা থেকে সরাসরি জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। এরপর জনদাবির মুখে, ১৯৪৯ সালের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে, জেলখানা থেকে মুক্তি লাভ করেন।

২৯ জুলাই তিনি নারায়ণগঞ্জে এক সাংগঠনিক সফরে যান এবং সেখানে ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী এ গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতায় তিনি ছাত্রলীগের ১০ দফার অন্যতম দাবি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও পাকিস্তানের নৌবাহিনীর সদর দপ্তর করাচি থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তরের দাবি জানান।

এ ছাড়া ১৯৪৮-৫০ সালে পূর্ব বাংলায় খাদ্য সংকটের ফলে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তাতে প্রায় ২০ হাজার লোক গ্রাণ হারায়। প্রতিবাদে শেখ মুজিব আন্দোলন গড়ে তোলেন। ফলে আবারও তিনি মুসলিম লীগ সরকারের কোপানলে পড়ে ১৯৫০ সালে ১ জানুয়ারি কারারুদ্ধ হন তিনি।

ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত কালপর্ব

১৯৫২ সালের ২৬ ও ২৭ জানুয়ারিতে ঢাকায় সমাবেশ করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনিও উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, তমদ্দুন মজলিস, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদসহ মোট ৬২ সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ।

ঢাকায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪ ফেব্রুয়ারি সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতাল শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এক বিশাল ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি সার পূর্ব বাংলায় হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

এরপর পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। এ ঘোষণায় ঢাকার ছাত্র সমাজ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্ররা জমায়েত হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। এরপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে বরকত-রফিক-জব্বার-সালাম-শফিউররা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি গ্রেফতার হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর দুই বছরের বেশি সময় তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকেন। অসুস্থতার কারণে ১৯৫২ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। এ সময় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে ভাষা আন্দোলনের জন্য চূড়ান্ত নির্দেশনা দেন তিনি। শেখ মুজিব ছাত্রনেতাদের জানান, ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে আমরণ অনশন শুরু করবেন। এ তথ্য জানতে পেরে সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরিদপুরে স্থানান্তরিত করে।

১৫ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে পুলিশের বাধা অতিক্রম করে সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে তিনি এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি অ্যাসেম্বলি বসবে, এমএলএ-দের কাছ থেকে রাষ্ট্রভাষার বাংলার পক্ষে সবাই দস্তখত আদায় করবেন। স্টিমার ঘাটে সেদিনে শেখ মুজিবের সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা ভাষা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। এরপর ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি সব রাজবন্দির মুক্তিসহ বাংলা ভাষার দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন।

দেশব্যাপী শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন জোরদার হতে থাকলে, সরকার শেষ পর্যন্ত জনদাবির কাছে মাথা নত করে এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়। জেলখানা থেকে মুক্ত হয়ে সাথে সাথেই মুজিব ঢাকার আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে এক তার বার্তায় ২১ ফেব্রুয়ারির মর্মান্তিক ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন।

এরপর এক দীর্ঘ সংগ্রামী পথচলায় সাত কোটি বাঙালিকে একত্র করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন তিনি। একসময়ের তরুণ ছাত্রনেতা মুজিব ক্রমেই হয়ে ওঠেন জেগে ওঠা বাঙালি জাতির একমাত্র কণ্ঠস্বর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এই নামটিতে একটি বাংলাদেশ বহমান।

লেখকঃ কোঅর্ডিনেটর, সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই); সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বুয়েট ছাত্রলীগ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত