1830
Published on জানুয়ারি 10, 2022তন্ময় আহমেদঃ
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। ত্রিশ লাখ শহীদ ও চার লাখ নারীর ত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করে আমাদের জন্মভূমি। সেই পৌষের পড়ন্ত বিকেলে বিজয়ের উত্তাপে শীতের অনুভূতি হারিয়ে ফেলে মানুষ। উল্লাসে ফেটে পড়ে জনগণ। তবে রাত পেরোনোর আগেই এক অজানা আশঙ্কা ভর করে বাঙালি জাতির মনে। বঙ্গবন্ধু যে তখনো পাকিস্তানের জেলে বন্দি। যার ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে ফেললো জাতি, সেই জ্যোর্তিময় মানুষটির জন্য কেঁদে উঠলো বাংলার মাটি।
স্বাধীনতার বাঁধভাঙা উদ্দাম উচ্ছ্বাস, স্বজন হারানোর বেদনা, বিধ্বস্ত আবাসভূমি: এরপর আবার প্রিয় নেতার অনুপস্থিতি! কিছু সময়ের জন্য ঠিক যেন রাডারহীন এক জাহাজের মতো অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল বাংলার মানুষ। তবে স্বাধীন দেশের প্রথম সূর্যদয়ের সময় থেকেই বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে একাট্টা হয় পুরো জাতি। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে মিত্র রাষ্ট্রগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও চাপ প্রয়োগ করে পাকিস্তানকে। অবশেষে ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানিরা। এরপর ৯ জানুয়ারি লন্ডনে নামেন তিনি। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে বহন করা ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানটি যখন ঢাকার মাটি স্পর্শ করে, তখন লাখ লাখ বাঙালির হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলার আকাশ। পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
মোটাদাগে, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বলতে আমরা এই ঘটানাগুলিই বুঝি। বর্ষীয়ান অনেক নেতা, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক এবং বিভিন্ন ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থ থেকেও আমরা এসবই জেনে থাকি। তবে বঙ্গবন্ধুর এই প্রত্যাবর্তন শুধুই একটি প্রত্যাবর্তন নয়। আমাদের মতো নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের কাছে বঙ্গবন্ধুর এই প্রত্যাবর্তন হলো তার জীবন এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনের যে যাত্রা, সেটার চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তন। ১০ জানুয়ারির প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশকে যেমন পূর্ণতা দিয়েছে, তেমনি এর আগেও বারবার প্রত্যাবর্তন করেছেন বঙ্গবন্ধু। তার সবগুলো প্রত্যাবর্তনই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তবে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দুটো কারণে বিশেষ বলে মনে করি আমরা। একটি কারণ, তার এই ফিরে আসার মাধ্যমেই বাংলাদেশ ফিরে পেয়েছে তার প্রতিষ্ঠাতাকে, পরিপূর্ণতা পেয়েছে আমাদের মহান স্বাধীনতা। আরেকটি কারণ হলো, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের জেলে একাধিকবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল, কবর খোঁড়া হয়েছিল তার জেলের সামনে, এমনকি পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পনের আগের দিন রাতে কারাগারে দাঙ্গা লাগিয়ে সর্বশেষ খুন করার চেষ্টা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। তবে এক জেলারের সতর্কতার কারণে সেই হত্যাচেষ্টা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। রাখে আল্লাহ, মারে কে। এক মৃত্যুফাঁদের অচ্ছেদ্য জাল থেকে এই ফিরে আসা তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ তার এই ফিরে আসার মাধ্যমেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল।
বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন জন্যই বিজয়ের তিন মাসের মধ্যেই আমরা ফেরত পাঠাতে পেরেছিলাম মিত্র বাহিনীর সেনাদের। আমরা ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলাম এক কোটি শরণার্থীকে। স্বল্প সময়ের মধ্যে পূনর্বাসিত করা সম্ভব হয়েছে যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় দুই কোটি স্থানচ্যুত মানুষকে। স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি আদায় করে এনেছেন বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে দ্রুত মাথা তুলে দাঁড়া করানোর জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় সংস্কার এনেছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পরপরই ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিত্তিও রচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুকন্যা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ যে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে আজ, সেটার ভিত্তিটা বঙ্গবন্ধুই দিয়ে গেছেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর, বিশ্বের অনেক বড় বড় নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একবার দেখা করার জন্য অধীর হয়ে থাকতেন। তার নেতৃত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। এমনকি তাকে নিজ দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়েও গেছেন।
তবে এর আগেও কিন্তু বারবার প্রত্যাবর্তন করেছেন বঙ্গবন্ধু। প্রথমত, দেশভাগের পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একনিষ্ঠ কর্মী ও তরুণ ছাত্রনেতা হিসেবে ঢাকায় ফেরেন তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের প্রথম ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে। ফলে পাকিস্তান সরকারে গ্রেফতার করে তাকে। কিন্তু ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে চার দিনের মাথায় তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় জান্তারা। এরপর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করেন তিনি। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সাড়া দেশে ছড়িয়ে দেন তরুণ শেখ মুজিব। ফলে পাকিস্তানিদের রোষানলে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব হারাতে হয় তাকে, দীর্ঘমেয়াদের জন্য যেতে হয় জেলে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে রক্ত ঢেলে দেয় অদম্য বাঙালি। এরপর দীর্ঘমেয়াদের জেলজীবন শেষ করে মুক্ত মানুষ হিসেবে ফিরে আসেন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
ছাত্রলীগ নেতা থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে ওঠেন তরুণ মুজিব। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একচেটিয়া বিজয় হয় যুক্তফ্রন্টের। ধর্ম ব্যবসায়ী মুসলিম লীগের ভণ্ডরা ধর্মের দোহাই দিয়ে মাত্র ৯টি আসন পেয়ে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। এরপর ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেন তিনি। ধর্মের জাঁতাকল থেকে বের হয়ে, হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বহু ধর্ম-বর্ণের মেলবন্ধনে প্রত্যাবর্তন করে বাঙালি জাতি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয় এবং মন্ত্রী হওয়া, পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রে মন্ত্রিসভা বাতিল এবং গ্রেফতার হয়ে বঙ্গবন্ধুর জেলে যাওয়া। আবারো পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালের শেষ দিকে মন্ত্রিত্ব লাভ এবং দলের কাজে মনোনিবেশ করার লক্ষ্যে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়া-এসব প্রতিটি ধাপেই বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন হয়েছে, কখনো মন্ত্রিত্ব থেকে নেতৃত্বে প্রত্যাবর্তন, কখনো ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহারের সংস্কৃতি থেকে পরিচ্ছন্ন ধর্ম চর্চা ও স্বচ্ছ রাজনীতির দিকে জাতিকে সঙ্গে নিয়ে প্রত্যাবর্তন।
জীবনের চারভাগের প্রায় এক ভাগ কাটিয়েছেন জেলে। ফিরে এসেছেন বারবার। টুঙ্গিপাড়ার সাধারণ ছোট্ট থেকে পরিণত হয়েছেন বাঙালি জাতির মুক্তির কাণ্ডারিতে। সময়ের প্রয়োজনে তীব্র আন্দোলন করেছেন, সশস্ত্র বিপ্লব করেছেন, আবার ১৯৭০ সালের নির্বাচনে একচেটিয়াভাবে জেতার পর কোনো ষড়যন্ত্রের সুযোগ দিতে চাননি পাকিস্তানিদের, তাই ১৯৭১ এর জানুয়ারি থেকে মার্চ জুড়ে তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছেন তীব্র অসহযোগ আন্দোলন। সঙ্গে চালিয়ে গেছেন সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধুর গতিময় নেতৃত্ব কখনো তীব্র উত্তাপ ছড়িয়েছে, জাতির স্বার্থে কখনো ফিরেছেন আলোচনার কৌশলে। কিন্তু কখনো আপস করেননি।
বাঙালির বাঁচার দাবি খ্যাত ছয়দফার সঙ্গে যেমন আপস করেননি, তেমনি কখনো বাঙালির ভাগ্য পরিবর্তনে বাধা হয় এমন কোনো প্রস্তাবকেও প্রশ্রয় দেননি। ৭ মার্চের ভাষণে স্পষ্ট করে তিনি বলেছেন, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। তিনি আমৃত্যু বাংলার মানুষের মুক্তি চেয়েছেন। বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য যা করা প্রয়োজন বলে মনে করেছেন, সঠিক সময়ে ঠিক সেই কাজটিই করেছেন। বঙ্গবন্ধু যতবার জেল থেকে বাংলার মুক্ত বাতাসে ফিরে এসেছেন, ততবারই বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বপ্নের সলতেয় একবার করে আগুন জ্বালিয়েছেন। একারণেই দীর্ঘ দুই যুগের আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু সবসময় মাঠে থাকতে না পারলেও, অদম্য জনতা বঙ্গবন্ধুর নামেই সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে যতবার দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, ততবার আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে তার প্রত্যাবর্তন হয়েছে বাঙালির মানসপটে। নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নেতাদের একজন। তার কৌশল, বাগ্মিতা, ত্যাগের মানসিকতা, সৃষ্টিশীলতা ও দেশপ্রেম ফল্গু হাওয়ার মতো প্রতিনিয়ত প্রবাহিত হচ্ছে নতুন প্রজন্মের ধমনীতে। যতদিন বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ থাকবে, পৃথিবীতে যতদিন বাঙালি থাকবে, ততদিন প্রতিটি প্রজন্মের মধ্যেই অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে বারবার ফির আসবেন বঙ্গবন্ধু।
লেখক: কোঅর্ডিনেটর, সিআরআই এবং এএলবিডি ওয়েব টিম।
সৌজন্যেঃ সময় নিউজ