1480
Published on জানুয়ারি 10, 2022স্কোয়াড্রন লিডার সাদরুল আহমেদ খান (অব):
২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কুখ্যাত অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হলে ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে ১২.২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর রাত ০১.৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী। ঢাকা সেনা নিবাসের বিভিন্ন সেলে রাখার পর ১ এপ্রিল ১৯৭১ তাঁকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় রাওয়ালপিন্ডিতে। এর পর সরিয়ে আনা হয় মিয়ানওয়ালির কারাগারে। থাকতে দেওয়া হয় ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত সেলে। এই সময় পাকিস্তান সামরিক সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ এনে বিচার শুরু করে। ১২টি অভিযোগের ছয়টির দণ্ড ছিল মৃত্যু এবং অভিযোগগুলোর একটি ছিল পাকিস্থানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার । মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জেলে বন্দি ছিলেন। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী । কেমন ছিল সেদিনগুলো, চলুন ফিরে দেখা যাক ইতিহাসের পাতায়।
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পূর্ব পাকিস্থানে জেনারেল নিয়াজি আত্ম সমর্পণ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত কোন সংবাদ প্রচার হয়নি, পাকিস্তানের সাধারন মানুষেরা জানতেই পারেনি পূর্ব পাকিস্তানে নিজ বাহিনীর পরাজয়, কারাগারে সেলবন্দী দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুও এ সম্পর্কে অবগত থাকার কোন সুযোগ ছিল না। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তান রেডিওতে জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন পাকিস্থানের প্রসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, সেখানে তিনি নিজ সেনাবাহিনীর আত্ম সমর্পণের কথা বলেননি উল্টো যুদ্ধ চালিয়ে জয় লাভ করার মিথ্যা প্রলোভন দেখান, ইতিহাসবিদ্দের কাছে এ ভাষণ ছিল নিরলজ্জতার নিকৃষ্ট উদাহরণ। পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে এ সংক্রান্ত কোন সংবাদই প্রচার করতে দেয়নি ইয়াহিয়া প্রশাসন। মিথ্যাচার আর অপমানে ফুসে উঠতে থাকা পশ্চিম পাকিস্তানে সম্ভাব্য সামরিক ক্যু এড়ানোর জন্য ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ ইয়াহিয়া পদত্যাগের ঘোষনা দিয়ে শাসনভার তুলে দেন জুলফিকার আলী ভুট্টো’র হাতে।
এদিকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে কয়েক মাইল দূরে এক অজ্ঞাত স্থানে (সিহালা পুলিশ রেস্ট হাউস) কয়েক দিনের জন্য সরিয়ে নেয়া হয়। ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সেই গোপন আস্তানা থেকে বের করে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে গৃহবন্দি করা হয়।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে চাপ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের ৬৭টি দেশের সরকার প্রধানকে চিঠি দেন। তাছাড়া ভারতের হাতে যুদ্ধবন্দি জেনারেল নিয়াজী সহ পাকিস্তানের ৯৩০০০ সামরিক সদস্যকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য পাকিস্তানও তৎপরতা শুরু করে।
২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল থেকে মুজিবনগর সরকার ঢাকায় সচিবালয় চালু হলে বঙ্গবন্ধু কে বাংলাদেশে ফেরত আনার কূটনীতিক কাজ বেগবান হয়।
২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন ভুট্টো।“ ভুট্টো তাঁকে পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যে কোনও রকম একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য জোরাজুরি করেন। উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ আমি কি মুক্ত না এখনও বন্দি? আমি যদি মুক্ত হই তাহলে আমাকে যেতে দিন। আর যদি বন্দি হই তাহলে কোনও কথা বলতে প্রস্তুত নই’।”
ভুট্টো তাঁকে জানালেন তিনি মুক্ত, তবে ফেরত পাঠাতে আরও দিনকয়েক লাগবে। একপর্যায়ে ভুট্টো দাবি করেন, পাকিস্তানের দুই অংশ তখন পর্যন্ত আইনের চোখে একই রাষ্ট্রের অন্তর্গত। জবাবে বঙ্গবন্ধু তাঁকে মনে করিয়ে দেন, বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল, কিন্তু সে ফলাফল মানা হয়নি। ‘পাকিস্তান যদি এখনও অবিভক্ত দেশ হয় তাহলে আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসক নন, আমি।’ বঙ্গবন্ধুর পাহাড়সম ব্যক্তিত্বের কাছে এভাবেই পরাজয় ঘটে ভূট্টো’র কূটচাল।
২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখের পাকিস্থানের পররাস্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমেদ বঙ্গবন্ধুকে প্রস্তাব দেন আকাশ পথে বাংলাদেশে নেয়ার। কিন্তু পিআইএ এর বিমান ভারতের আকাশ সীমা দিয়ে প্রবেশের নিষেধ রয়েছে তাই তৃতীয় কোন দেশে যেতে হবে ,সেক্ষেত্রে প্রস্তাব করা হয় তেহরান, বঙ্গবন্ধু আপত্তি জানালেন। পরে পাকিস্থান প্রস্তাব করল লন্ডন, বঙ্গবন্ধু সম্মত হলেন।
৭ জানুয়ারি ১৯৭২ শেষবারের মতো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন ভুট্টো। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেন, ‘আজ রাতেই আমাকে মুক্তি দিতে হবে, এ নিয়ে অযথা বিলম্বের সময় নেই। হয় আমাকে মুক্তি দিন অথবা মেরে ফেলুন।’ ভুট্টো তাঁকে বলেন, এত দ্রুত সব আয়োজন করা কঠিন। বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত হলেন, অবস্থা বেগতিক দেখে ভূট্টো বিমানের ব্যবস্থা করতে আদেশ দিলেন নিজ সচিব কে।
৮ জানুয়ারী ১৯৭২ সালের প্রথম প্রহরে তাঁকে নিয়ে পিআইএ এর একটি উড়োজাহাজ যাত্রা করে লন্ডনে। স্ট্রাটেজিক কার্গো হিসেবে বিরতিহীন ফ্লাই করে বিমানটি। এভাবেই পাকিস্থানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।
৮ জানুয়ারি ১৯৭২ লন্ডনে পৌঁছালে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডন হিথরো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে স্বাগত জানালেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড । তাঁকে রাষ্ট্রীয় অতিথির সম্মানে ক্লারিজেস হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। অল্প সময়ের মধ্যে লেবার পার্টির নেতা হ্যারাল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে এসে বলেন, “গুড মর্নিং মি প্রেসিডেন্ট”। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির কথা শুনে হাজার হাজার বাঙ্গালী হোটেল ঘিরে, “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” স্লোগান দিতে থাকে। এর পরে ক্লারিজেস হোটেল লবিতে সাংবাদিক সম্মেলন করেন বঙ্গবন্ধু।
৮ জানুয়ারি ১৯৭২ রাতে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিষয়টি উত্থাপন করেন।
৯ জানুয়ারি ১৯৭২ ভোর ছয়টায় লন্ডনের হিথরো বিমান বন্দরে উপস্থিত হলেন বঙ্গবন্ধু সেখান থেকেই টেলিফোনে ইন্দিরাগান্ধী-বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আধাঘণ্টা আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানান ইন্দিরা গান্ধী এবং অনুরোধ করেন ঢাকার পথে যেন তিনি দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন। বঙ্গবন্ধু আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট জেটে করে দিল্লির উদ্দেশে রওনা হন।
১০ জানুয়ারী ১৯৭২ সোমবার সকাল ৮টায় ভারতে যাত্রাবিরতি দেন, সেখানে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানানো হয়, উপস্থিত ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি এবং প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধী। দিল্লিতে জনসমাবেশে সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী, জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য এবং শরণার্থী বাংলাদেশীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে একই বিমানে দিল্লী থেকে তেজগাঁও বিমান বন্দরে অবতরণ করেন জাতির জনক। মাটিতে পা রেখেই আবেগে কেঁদে ফেলেন বঙ্গবন্ধু। বিমানবন্দরে গার্ড-অব-অনার দেয়া হ্ল, অস্থায়ী সরকারের সদস্য,মিত্র বাহিনীর সদস্য, মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিকামী সব বাঙালি অশ্রুসজল নয়নে বরণ করেন ইতিহাসের মহানেতাকে। সেখান থেকে পৌঁছে যান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বিমানবন্দর ও রাস্তার দুপাশে তখন অপেক্ষমাণ লাখো জনতা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে দেশবাসীর সামনে প্রায় ৩৫ মিনিট দিকনির্দেশনামূলক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ শেষে বাড়ি ফেরেন জাতির পিতা। আর এভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শেষ হ্ল। জাতির পিতাকে স্বাধীন দেশে বরণ করে ধন্য হ্ল বাঙালী জাতী, বিজয় পেল পূর্ণতা। সবার কণ্ঠে ছিল ‘জয় বাঙলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
লেখকঃ সাবেক ডেপুটি সার্জেন্ট- এট- আর্মস এবং সদস্য, অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)