1022
Published on নভেম্বর 3, 2021হীরেন পন্ডিতঃ
সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান এই চারটি নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্রসম। এই চারজনকে ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা হয়তো সম্ভব না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৯৭১ এ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অপরিসীম ভূমিকা রেখেছেন এই চারজন।
বাংলার ইতিহাসে অনেক গৌরবময় অধ্যায় রয়েছে। এমনই একটি অধ্যায় ১৯৭১। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এটি এক অনন্য অধ্যায়। ১৯৭১ সালে বাঙালিরা তাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রম হারানোর যন্ত্রণায় বিদীর্ণ বুক নিয়েও যে সাফল্য অহরহ আমাদের গর্বিত করে তা হলো আমাদের ‘স্বাধীনতা’। একটি নিজস্ব পতাকা। একটি পৃথক মানচিত্র এবং আমাদের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য। এই প্রাপ্তি বিশ্বসভায় আমাদের উজ্জ্বল এক অহংকারকে সমুন্নত করে রেখেছে। চিরকালই রাখবে।
আবার কোনো কোনো দিনকে কালো মনে করা হয়। আর সেই প্রাপ্তির পাশাপাশি যে লজ্জা আমাদের চিরকাল ¤্রয়িমাণ করে রাখবে, সে হলো জাতির জনক হত্যাকা-, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ আর সেই চূড়ান্ত লজ্জা-দুঃখ এবং লজ্জাজনক ঘটনার ধারাবাহিকতায় জেল হত্যাকা- ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫ এর সাথে আরো এক নির্মম হত্যাকা-ের দিন হলো ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভায় গ্রেনেড হামলা।
নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধরত দেশ তখনো নেতৃত্বহীন ছিল না। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যে চারজন মহান নেতা সফলভাবে শূন্যতা পূরণ করেছিলেন তাঁরা হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি আন্দোলনে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশ নিয়েছেন। তাঁরা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আজীবন সঙ্গী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা শুরু করে। এরপর বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেফতার করে নিয়েছে যাওয়া হয়। গ্রেফতারের কিছু আগে ২৫ মার্চ রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চ ভোরে বঙ্গবন্ধু একটি ছোট ইপিআর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসক ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু না, জাতির সেই সংকটে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দ নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান মহান মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব নেন।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয় ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে এক শপথ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, এম মনসুর আলীকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, এএইচএম কামারুজ্জামানকে অর্থমন্ত্রী এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়ে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। ১৭ এপ্রিল গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়। বৈদ্যনাথতলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মুজিবনগর। এই চার নেতা যদি দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধের নেতৃত্বের হাল না ধরতেন তাহলে হয়তো আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে আমাদেরকে আরো কঠিন মূল্য দিতে হতো।
৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকা- নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অনিবার্যভাবেই উঠে আসে ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার ভগ্নিপতি পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এবং তার এক ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ১৫ আগস্ট নিহত হন। বোঝা যায়, অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল একটি পরিবার। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় চার নেতাকে ২৩ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয়। ১৫ আগস্টের আট দিন পর। ১৫ আগস্টের পর আট দিন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। সে সময় খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সরকার ক্ষমতায় ছিল, যার মন্ত্রিসভা। সকল সদস্য আওয়ামী লীগের। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান জাতীয় চার নেতা দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত; মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁরা প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব দেন। তাঁদের হাত ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সরকারের পথচলা শুরু হয়।
জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর ঘটেছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-। আবার নতুন করে জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করে ফেলার মহাপরিকল্পনা হিসাবে প্রথমে জাতির পিতাকে সপরিবার-সবান্ধব হত্যা করা হলো অত্যন্ত নারকীয়ভাবে। দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গেলেন তাঁর দুই কন্যা, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর বোন শেখ রেহানা। যে মহানায়কের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অবদানে বিশ্ব মানচিত্রে সগর্বে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল একটি নতুন দেশ, যে একটি জ¦ালাময়ী বক্তৃতায় এদেশবাসী স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশের লক্ষ বীর সন্তান, হাসিমুখে জীবন দিতে পিছপা হয়নি, ছিনিয়ে এনেছিল একটি স্বাধীন পতাকা, সেই মহান নেতাকে, বাংলাদেশের স্থপতিকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। এবার তারা মনোযোগ দিল স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বাকি নেতাদের প্রতি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যে অপশক্তি বারবার চেষ্টা করেছে আমাদের মুক্তির স্বপ্নকে ধুলিস্যাৎ করে দিতে, তার আজো বিপুল বিক্রমে সক্রিয়। কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করে। মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে কাজ করাই ছিল এই চক্রটির মূল উদ্দেশ্য। মোশতাক সরকারের পতনের পরে ওরা ভেবেছে এই চার নেতামুক্তি পেলে জাতিকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সংগঠিত করে ফেলতে পারবেন। আর এমন হলে দেশের উন্নয়নের ধারাকে প্রতিহত করার তাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত করতে পারবে না। এদের এই হত্যাকা-গুলো ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চিরতরে বিনষ্ট করে দেবার এক গভীর চক্রান্ত। এবং এতে যে তারা অনেকটাই সফল হয়েছে, তা অনস্বীকার্য। যে শোষণহীন, ধর্ম বৈষম্যহীন এক প্রগতিশীল সমাজের প্রতিশ্রুতিতে দেশ স্বাধীন হয়েছিল তা থেকে এখন আজ আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের ফলেই এটা হয়েছে।
১৯৭৫ এর হত্যাকাণ্ডের পরপরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদর্শের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ এক নতুন ধারার রাষ্ট্রনীতি প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র, যারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তারা আবার ফিরে এলো বিপুল বিক্রমে। চলতে থাকলো মুক্তিযুদ্ধের স্থপতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ব্যাপক অপপ্রচার। তার অনেকটাই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল অতিপ্রচারের বদৌলতে।
১৯৭৫ এর ৩রা নভেম্বরের প্রথম প্রহরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত হয়েছিলেন শীর্ষ চারজন রাজনৈতিক নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান। এ নিয়ে একটি মামলা হয়েছে। বিচারও হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত ফয়সালা হয়নি। জেল হত্যা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি।
একটি প্রশ্ন বারবার ফিরে আসে এই চারজন জাতীয় নেতাকে কেন হত্যা করা হয়েছে? এ প্রসঙ্গে একটি সরল ব্যাখ্যা রয়েছে বিশেষ করে গবেষক ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের তাঁরা মনে করেন যে বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য তাঁদের হত্যা করা হয়েছিল। অর্থাৎ তাঁরা নেতৃত্বে ফিরে আসতে পারেন বা তাঁরা ভবিষ্যতে সরকার গঠন করতে পারেন এ রকম একটি সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এটি তাঁদের প্রতিপক্ষ চায়নি। এ জন্য পথের কাঁটা দূর করা হলো। এই চার নেতা দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন; মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের হাত ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সরকারের পথচলা শুরু।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বর সময়কালে সংঘটিত ঘটনা ও হত্যাকা-ে দেশের সাধারণ মানুষের কোনও সম্পৃক্ততা ছিল না, এসময়ে শুধু ক্ষমতার জন্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা, হত্যার প্রতিশোধে হত্যা এবং দেশের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে স্বৈরশাসকদের ক্ষমতায় বসানোর পথ পরিষ্কার করা হয়। বস্তুত ৩-৭ নভেম্বর ১৯৭৫ ছিল সেনাকর্মকর্তাদের ক্ষমতার লড়াই। ইনডেমনিটি আইন করে হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করা হয়।
১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয় এবং তারপরই এসব কলঙ্কজনক হত্যাকা-ের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় ২০১৫ এর ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়। বিচার কার্যক্রম শেষ হওয়ার মধ্যদিয়ে জাতির কলঙ্কের তিলক খানিকটা মোচন হয়। জাতীয় চার নেতা মৃত্যু পর্যন্ত দেশের জন্য অবিচল ছিলেন। মৃত্যুও তাঁদের আদর্শ ও সততাকে একটুকু পরিমাণ বিচ্যুত করতে পারেনি। জাতির পিতার প্রতি তাঁরা আস্থাশীল থেকেছেন। ক্ষমতার লোভ তাদের টলাতে পারেনি। তাঁরা ছিলেন বীর, আদর্শ ও চেতনার প্রশ্নে আপোষহীন। তাঁদের আত্মত্যাগ জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে সবসময়।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো বিএনএনআরসি
সৌজন্যেঃ aparajeobangla.com