6845
Published on আগস্ট 31, 2021অজয় দাশগুপ্তঃ
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম এবং আরও কয়েকজন নেতা যথার্থই বলেন– ‘কারও ভাষণে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি।’ ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রভাব-প্রলোভন-হুমকি কাজে লাগিয়ে গঠিত হয়েছিল বিএনপি নামের দলটি। এই দল গঠনের কয়েকদিন পর আমি চাঁদপুরে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। দশকের পর দশক আমজনতার স্বার্থ নিয়ে রাজনীতি করেছেন, নির্যাতন ভোগ করেছেন– এমন কয়েকজন সেখানে উপস্থিত। আগের দিন চাঁদপুর শহরে বিএনপি গঠনের আয়োজিত সমাবেশের উল্লেখ করে একজন বলেন, যে দলে যোগ দিলেই ক্ষমতাসীন– সে দলে যুক্ত হওয়ার মতো লোকের অভাব হয়নি। মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হতে হবে না, কোনো সমস্যা নিয়ে মিছিল-সমাবেশ করতে হবে না, জেল-জুলুম সহ্য করতে হবে না, নির্বাচন করতে হবে না– কী আনন্দ! কী আনন্দ!
বিএনপি নেতারা ঠিকই বলেন, কারও বক্তৃতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসেনি। তারা এটা বলতে চান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ প্রসঙ্গে। প্রকৃতপক্ষে এটা প্রযোজ্য জিয়াউর রহমানের ‘২৭ মার্চ প্রদত্ত চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ভাষণ’ প্রসঙ্গে। যে লাখ লাখ তরুণ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়নের জন্য মরণপ্রাণ লড়েছিল, তাদের মধ্যে একজনও কি মিলবে– যে জিয়াউর রহমানের ভাষণ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল? মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গনে গিয়েছে জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে, সহযোদ্ধা কারও প্রাণ গেলে জাতীয় পতাকায় আবৃত করে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানিয়েছে। এ সময় কেউ কি জিয়াউর রহমানের নাম নিয়েছে? তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে এই স্লোগান দুটি নিষিদ্ধ করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শত শত গোপন দলিল প্রকাশ করেছে, যেগুলোতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো সে সময়ে পাকিস্তানে অবস্থিত মার্কিন কূটনীতিকরা পাঠিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং পররাষ্ট্র ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের পদস্থ ব্যক্তিদের আলোচনা থেকেও আমরা সে সময়ের অনেক ঘটনা জানতে পরি। এর কোনোটিতেই জিয়াউর রহমানের নাম পর্যন্ত নেই। ১৩ মার্চ সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে একটু দূরে ছিলেন, কিন্তু এটা ছিল নিছক কৌশলগত। তিনি স্পষ্ট করেন, তার লক্ষ্য ‘মুক্তি’– যা স্বাধীনতার খুব কাছের বিষয়।
পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাস থেকে ১৫ মার্চ, ১৯৭১ তারিখ জানানো হয়– Sheikh Mujibur Rahman announced in Dacca early today, that his party, the Awami League, was taking over the administration of East Pakistan on the grounds that the party had a majority (288 of 300) in the Provincial Assembly. Mujib acted unilaterally and in defiance of President Yahya Khan’s Martial Law Administration which continues to be the Government of Pakistan. The fact that Mujib’s announcement contained 35 “directives” for assuming control of the administration indicates that it was a deliberate and carefully planned move.
In taking this step, Mujib has directly confronted the Yahya government but has carefully avoided an unqualified declaration of East Pakistani independence and has based his action on the “democratic” voice of the people as expressed in the December election. The Yahya regime must react quickly to this critical move, and Yahya himself has flown to Dacca to talk with Mujib.
২৬ মার্চ, ওয়াশিংটনে স্পোশাল গ্রুপ অব অ্যাকশনের সভার আলোচনায় জানানো হয়– A clandestine radio broadcast Mujibur Rahman declaring the independence of Bangla Desh.
এখানে জিয়াউর রহমান কোথায়? ৩১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা হিলালি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে ইয়াহিয়া খানের একটি বার্তা পৌঁছে দেন। এতে বলা হয়– In the larger interest of the country I exercised utmost restraint and patience and tried to evolve a generally acceptable formula to resolve constitutional difficulties. In pursuit of the same objective, I went personally to East Pakistan to hold consultations with Sheikh Mujibur Rahman. Even while I was there, the Awami League leaders continued to make statements and to indulge in practices which clearly showed that they were not prepared for pursuing a compromise. The last round of talks in Dacca left me in no doubt that they had no intention of accepting any constitutional formula which would ensure integrity and unity of the country. Eventually a point was reached where the Awami League put forward final proposals which virtually amounted to dismemberment of the country.
বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১। যুক্তরাষ্ট্রের গোপন দলিলে আগেরদিন বলা হয়– Pakistan Ambassador Hilaly told Van Hollen on instructions April 16 that Government of Pakistan wished to bring to USG’s attention possible approach by representatives alleging to represent “Provisional Government of Bangla Desh.”
শপথ গ্রহণের পর ১৯ এপ্রিল হেনরি কিসিঞ্জার জানতে চান, বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান কোথায় এবং কারা রয়েছে সরকারে। উত্তরে বলা হয়, স্থানটি কুষ্টিয়ার চুয়াডাঙ্গায় (প্রথমে এখানেই শপথের কথা ছিল, পরে মেহেরপুরে স্থানান্তর করা হয়)। শেখ মুজিবুর রহমান সরকার প্রধান এবং তাজউদ্দিন আহমদ দ্বিতীয় ব্যক্তি।
৩ জুন হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জারের মধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশ। কিসিঞ্জার বলেন– `If East Pakistan becomes independent, it is going to become a cesspool. It is going to be 100 million people, they have the lowest standard of living in Asia, no resources.’
Cesspool শব্দের অর্থ বাড়ির শৌচালয়ের মলমূত্র সংগ্রহের জন্য ভূগর্ভস্থ গর্ত। হায়! তার এ ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যে ভুল পথে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়, তার পেছনে হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকা ছিল। খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও জিয়াউর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতায় এসেছিল। তাদের ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় আসেন এইচ এম এরশাদ ও খালেদা জিয়া। তারা পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র এবং আরও কিছু দেশ এবং বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মাধ্যমে যে সব নীতি ও কর্মসূচি বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল তার পরিণতিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন ব্যাহত হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।
১৯৭১ সালের ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এক আলোচনায় বল হয়, পররাষ্ট্র দফতর has received document/2/ dated “Mujibnagar”, April 24, 1971, addressed to President. Document requests immediate USG recognition of “sovereign independent People’s Republic of Bangladesh” and establishment of diplomatic relations between USG and Bangladesh Government which it says “exercising full sovereignty and lawful authority within the territories known as East Pakistan prior to March 26, 1971.” Also attached are “Proclamation of Independence” dated April 10, 1971, proclamation by “Acting President” Islam continuing East Pakistan laws in force in “Bangladesh”, and purported cabinet of Bangladesh Government including “President” Sheikh Mujibur Rahman. Document mailed regular international air mail from West Berlin, postmarked May 26, 1971 with no return address.
এখানেও তো নেই জিয়াউর রহমান। তাহলে কোথায় আছেন তিনি?
রাজা ত্রিদিব রায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষ নিয়েছিলেন। তিনি The Departed Melody নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন ২০০৩ সালের জুলাই মাসে। এ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের মার্চের শেষ দিকে কালুরঘাটে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অভিযান পরিচালনার পর জিয়াউর রহমান তার অনুসারীদের নিয়ে পালিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় নেন। একদিন সকাল ১১ টার দিকে একদল মিজো বিদ্রোহী (যারা ভারতের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছিল) ও পাকিস্তানি একদল সৈন্য জিয়াউর রহমানের বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। জিয়াউর রহমান এবং তার সঙ্গে থাকা ১০১ জন সৈন্য ও অফিসার এ সময় পালিয়ে যায়। মাত্র একজন বাদে সকলে অস্ত্র লেকের পানিতে ফেলে দেয়। খরস্রোতা এলাকা অতিক্রম করার সময় কান্তি নামের এক চাকমা জিয়াউর রহমানকে পিঠে বহন করেন। খাগড়াছড়িতে পৌঁছে জিয়াউর রহমান এক চাকমা দোকান থেকে কিছু পণ্য কেনেন বাকিতে এবং তার বিপর্যস্ত সেনাদল নিয়ে ভারতের ত্রিপুরা পৌঁছান। [পৃষ্ঠা ২১৫]
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বঞ্চলীয় কমান্ডের জনসংযোগ অফিসার সিদ্দিক সালিক ১৯৯৭ সালে প্রকাশ করেন Witness to Surrender গ্রন্থ। এর প্রথম পৃষ্ঠাতেই লিখেছেন, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনের বেশ আগেই ‘শেখ মুজিব বলেছেন, আমার লক্ষ্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলব। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর কে আমাকে চ্যালেঞ্জ করবে?’
গ্রন্থে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট-১ অধ্যায়ে লিখেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান রেডিও-এর ফ্রিকোয়েন্সির ওয়েভলেন্থের কাছাকাছি ধরা পড়ল শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব রেকর্ডকৃত পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা– গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।’ [পৃষ্ঠা ৭৫]
যে বাংলাদেশের উত্থান রুখতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এ হিংস্র গণহত্যা পরিচালনা করে তার অন্যতম হোতা সিদ্দিক সালিক গ্রন্থের অনেক স্থানে বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ উল্লেখ করলেও জিয়াউর রহমানের নাম নিয়েছেন কেবল ৭৯ পৃষ্ঠায়, যিনি কালুরঘাট বেতারের ট্রান্সমিটার ব্যবহার করেছেন- to broadcast the `declaration of independence.’
তিনি declaration of independence শব্দ তিনটি উদ্ধৃতির মধ্যে রেখেছেন। কারণ বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং তার ডাকেই লাখ লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা লড়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের নেতৃত্বে। গ্রন্থের কোথাও ‘বিএনপির স্বাধীনতার ঘোষকের’ বিষয়ে আলোচনা নেই। তবে তার পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছে– ‘Later in August 1975, he staged the coup which deposed Mujibur Rahman and resulted in the killing of the Sheikh and his family.’ [পৃষ্ঠা ৭৯]
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীমুক্ত স্বদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে আসেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। লাখ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানায়। এরপর তিনি রেসকোর্স ময়দানে সমবেত জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ চরম ত্যাগস্বীকার করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশ টিকে থাকবে। এই রেসকোর্স ময়দানেই ১০ মাস আগে ৭ মার্চ (১৯৭১) তিনি উচ্চারণ করেন– এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
মুক্ত স্বদেশে জিয়াউর রহমান প্রথম কবে ঢাকা আসেন? কেউ কি সেদিন তাকে স্বাগত জানাতে বাস স্ট্যান্ডে কিংবা অন্য কোনো স্থানে উপস্থিত ছিলেন?
লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধা এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক
সৌজন্যেঃ bdnews24.com