4624
Published on আগস্ট 15, 2021শাহরিয়ার রিয়াজ:
মুজিব হত্যার প্রেক্ষাপটে যে কয়টি বিদেশি শক্তি দৃশ্যপটে এসেছে তারমধ্যে পাকিস্তান, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ। পরাজিত শক্তি পাকিস্তান যে প্রতিশোধ নিতে চাইবে এটা তো নিশ্চিত। আর সব থেকে বড় ভূমিকা রেখেছে যে দেশটি সেটা হলো প্রেসিডেন্ট নিক্সনের যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের জয় তাদের জন্য অপমানজনক ছিল। কেননা বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও পাকিস্তানিদেরকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতার পরও জাতির পিতার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিল। তার প্রতিশোধও তারা নিতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক।
আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী তার বইয়ে তুলে ধরেছেন, মুজিব হত্যার প্রধান ব্যক্তিবর্গ–মোশতাকসহ অনান্যদের সাথে মার্কিন যোগসাজশ ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই। ভারতে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের দপ্তরে মোশতাকের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন মার্কিন কর্মকর্তারা। যুক্তরাষ্ট্র একদিকে যেমন অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানিদের সাহায্য করেছে, অন্যদিকে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের জন্য পাঠিয়েছে নানা রকম ত্রাণ সামগ্রী। কলকাতার সার্কাস অ্যাভিনিউতে ছিল মোশতাকের অফিস। মোশতাক তখন মার্কিন পরামর্শে যুদ্ধ থামিয়ে আলোচনা করার জন্য জোর প্রচার চালানোর পাশাপাশি অস্থায়ী সরকারকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্রে পাকাচ্ছিলেন বারবার।
তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশে পেন্টাগন জাতীয়তাবাদী ও বৈধ সরকারকে উচ্ছেদ করতে চায়, সেসব দেশে তারা একটা নীতি সাধারণভাবে মেনে চলে। তা হলো, একই তাবেদারকে তারা দুইবার ব্যবহার করে না। প্রয়োজন ফুরালে কমলার খোসার মতন তাদের ফেলে দেয়, হত্যা করতেও দ্বিধা করেনা। সুতরাং বাংলাদেশে মুজিব হত্যা চক্রান্ত সফল হওয়ার পরদেশিয় তাবেদাররা পরিত্যক্ত হবে, খুনি সামরিক অফিসারদের দেশছাড়া হতে হবে- এটাই তাদের স্বাভাবিক পরিণতি। অদূর ভবিষ্যতে যদি কারও অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়, তাতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। কালক্রমে তা অনেকটা প্রমাণিত ।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নীতির একটি উদাহরণ মুক্তিযুদ্ধের আগেই দেখা গিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ দেশের সর্বত্র উড়লো নতুন জাতীয় পতাকা। সবুজের মধ্যে রক্তিম সূর্য। সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র। দোকান, বাড়িতে এমনকি সরকারি অফিসে পর্যন্ত নতুন এ পতাকা উড়লো। স্বাভাবিকভাবেই বিদেশি দূতাবাসগুলোর দিকে সবার নজর। ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনে দেখা গেল, বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। ফরাসি এবং চীনা দূতাবাসে তখনও পাকিস্তানের পতাকা উড়ছিল। বিক্ষুব্ধ জনতা সেই পতাকা নামিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। আর মার্কিন দূতাবাসে কেবল দেখা গেল তারা শুধু নিজেদের পতাকাই উড়িয়েছে, বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তান- কারও পতাকাই তোলেনি।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এবং পাকিস্তানের ভুট্টো যে বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রে জড়িত, এর প্রমাণও রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রবল প্রতাপশালী দেশের বিরোধিতা সত্ত্বেও মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। কিসিঞ্জারের সাবেক স্টাফ অ্যাসিস্ট্যান্ট রজার মরিস এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবের প্রতি কিসিঞ্জারের ঘৃণার কথা স্বীকার করেছেন। মরিস বলেন, ‘শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে কিসিঞ্জার তার ব্যক্তিগত পরাজয় বলে মনে করতেন। কিসিঞ্জারের বিদেশি শত্রুর তালিকার সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তিরা হচ্ছেন আলেন্দে, থিউ ও মুজিব। এ তিনজন তার বিভিন্ন পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেন। মুজিব ক্ষমতায় আসেন সবকিছু অগ্রাহ্য করে। আমেরিকা ও তার অনুগ্রহভাজন পাকিস্তানকে সত্যিকারভাবে পরাজিত করে এবং মুজিবের বিজয় ছিল আমেরিকার শাসকবর্গের পক্ষে অত্যন্ত বিব্রতকর।‘ (বাংলাদেশ : দ্য আনফিনিশড রেভুলিউশন, লরেন্স লিফসুলজ পৃ. ১৩৬–১৩৮)।
১৫ অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের পর এ নিয়ে প্রথম প্রকাশিত বইয়ের লেখক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত–র কাছে খুনি ফারুক স্বীকার করে যে, “১৫ই অগাস্ট যখন তার লোকজন শেখ মুজিবের এবং সেরনিয়াবাত এর বাড়িতে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল, তখন মার্কিনি দূতাবাসের কয়েকটি গাড়ি ঢাকা নগরীর চতুর্দিকে ছোটাছুটি করছিল, খন্দকার মোশতাককে সঙ্গে করে খন্দকার রশিদ রেডিও স্টেশনে পৌঁছার অনেক আগে থেকেই তাহেরউদ্দিন ঠাকুর সেখানে উপস্থিত ছিল।”
মুজিব হত্যার পরপরই মার্কিন সংশ্লিষ্টতার খবর ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার খবর প্রকাশ বন্ধে ভারতের সংবাদমাধ্যমের ওপর জরুরী ভিত্তিতে বিধিনিষেধ আরোপে দেশটির সরকারের প্রতি চাপ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিকরা।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পরের মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তারবার্তায় বিষয়টি উঠে আসে। গোপন এক তারাবার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার দিল্লিতে তার দূত মারফত ভারত সরকারকে জানান– ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আমরা আশা করি।’ ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী নিজের দেশে জরুরী অবস্থা জারি করেন। তখন ভারত সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়- এমন সংবাদ প্রকাশে শহরের সব ধরনের পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। উইকিলিকস প্রকাশিত ১৯৭৩–৭৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রায় ১৭ লাখ তারবার্তার মধ্যে এ সংক্রান্ত কিছু তারবার্তায় এই তথ্য উঠে আসে। যদিও এগুলোকে ওই সময় গোপনীয় বলা হয়েছে, তবে এখন সেগুলো উন্মুক্ত করা হয়েছে।
জাতির পিতাকে হত্যার চার দিনের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৯ আগস্ট দিল্লিতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম স্যাক্সবে–র প্রতিবেদনে বলা হয়, দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত উপ–প্রধান ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবের কাছে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার একটি প্রতিবেদনের সমালোচনা করেছেন।
স্যাক্সবে তারবার্তায় লিখেন, “তার সহকর্মী যুগ্ম সচিবকে বলেছেন– বাংলাদেশের সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে জড়িয়ে ভারতের গণমাধ্যমে অব্যাহত অভিযোগের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থান নেব। এ ধরনের অভিযোগ অবমাননাকর ও ভারত সরকারের নিজস্ব বিধিনিষেধের লঙ্ঘন এবং এটি যুক্তরাষ্ট্র–ভারতের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”
তারবার্তায় আরও বলা হয়, “এ ধরনের অভিযোগ সংবাদ আকারে প্রকাশ বন্ধ করতে নিজস্ব বিধিবিধান প্রয়োগের পদক্ষেপ নিতে ভারত সরকার কেন প্রস্তুত নয়- তা আমাদের বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের ব্যাপারে লেখালেখির ক্ষেত্রে বিদেশি প্রতিনিধিদের সতর্ক করেছে ভারত সরকার। সুতরাং দূতাবাস আশা করে, নিজেদের সংবাদকর্মীদের বিষয়েও অন্তত তারা একই কাজটি করবে।”
এরও দুইদিন পর ২১ অগাস্ট, স্যাক্সবে আরও একটি তারবার্তা পাঠান। এতে ভারতের ব্লিটজ ম্যাগাজিনে মুজিব হত্যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র সংশ্লিষ্টার অভিযোগ এনে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সমালোচনা করা হয়। এতে তিনি বলেন, “সন্ধ্যায় মিসেস গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে প্রতিবেদনটি আলোচনায় আনার পরিকল্পনা করেছেন সিনেটর ইয়াগলেটন।”
এর তিন মাস পর কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ দূতাবাসের ১৮ নভেম্বরের একটি তারবার্তায় রাষ্ট্রদূত বোস্টারকে ১৫ অগাস্টে মুজিবের পতনের জন্য দায়ী করা হয়। ‘একটি বন্ধুভাবাপন্ন হিসেবে স্বীকৃত দেশের সরকারী দল প্রভাবিত পত্রিকায় এ ধরনের আক্রমণ হজম করা কঠিন’- তারবার্তায় বলা হয়। এর জবাবে দুইদিনের মধ্যে দিল্লি দূতাবাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই তারবার্তা পাঠান। ২০ নভেম্বরের তারবার্তায় হেনরি কিসিঞ্জার লিখেন, “উপ–সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাবস ওয়াশিংটনে ভারতীয় মিশনের উপ–প্রধানকে জানান, রাষ্ট্রদূত বোস্টারের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক অভিযোগ দায়িত্বজ্ঞানহীন ও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’এবং তার উচিত নয়াদিল্লিকে জানানো– পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আগে থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে আমরা এমনটাই আশা করছি। তোমারও উচিত একই উদ্যোগ নেওয়া।” একথা বলে তারবার্তাটি শেষ করেন কিসিঞ্জার।
যুক্তরাষ্ট্র শহরটির (কলকাতা) ‘অধিকাংশ কুৎসিত আলোচনার’ বিষয়বস্তু– রাষ্ট্রদূত এমন ধরনের একটি তারবার্তা পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে পাঠানোর দুই সপ্তাহ পর যুগান্তরের প্রতিবেদনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের মার্কিন দূতাবাস।
৬ নভেম্বর লেখা তারবার্তায় ডেভিস ইউগিন বোস্টার বলেন, “১৫ অগাস্টের সামরিক অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল এমন ধারণা ওই ঘটনার পর ব্যাপক প্রচার পায়। মোশতাক আহমেদের পশ্চিমাপন্থি এবং সোভিয়েত ও ভারতবিরোধী পরিচিতি রয়েছে। এছাড়া সব বড় ঘটনায় অদৃশ্য (বিদেশিদের) হাত খোঁজার বিষয়ে বাঙালিদের মধ্যে তীব্র প্রবণতা দেখা যায় এবং মনে করা হয়, যেকোনওভাবে বা উপায়ে মুজিবকে উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা রেখেছে।”
এরপর তিনি তারবার্তায় লিখেন, সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ফোমিন থেকে উৎসাহ নিয়ে বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদূত নিকোলাই বোয়াদজিভ একজন কূটনীতিককে মুজিবের মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কোনও দেশের কোনও লাভ হয়েছে কিনা সে প্রশ্ন করেছেন। পাশাপাশি এটিও বলেছেন যে চিলির ঘটনার সময়ও রাষ্ট্রদূত বোস্টার সেখানে ছিলেন।
অর্থাৎ এই তারবার্তায় রাষ্ট্রদূত বোস্টার বোঝাতে চেয়েছেন যে, বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদূত কূটনৈতিকভাবে মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার জড়ানোর বিসয় ইঙ্গিত করেছেন।
আরেকটি তারবার্তায় বোস্টারকে তার সহকর্মীদের বলতে দেখা যায়, “১৯৬৩ সালে তিনি একটা সময় চিলিতে তিন দিন ছিলেন। তবে তাকে সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।” ২০০৬ সালে বোস্টারের মৃত্যুর পরপরই সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলজ, রাষ্ট্রদূত বোস্টার নিজেই তার ‘দ্য আনফিনিশড রেভ্যুলেশন’ বইয়ের সোর্স ছিলেন বলে দাবি করেন। এতে অভিযোগ করা হয়, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের যোগাযোগ ছিল।
বিদেশিদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যায় সবচেয়ে বেশি উল্লাসিত হন পাকিস্তানের ভুট্টো। ১৫ অগাস্ট মুজিব হত্যার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তান বাংলাদেশের খুনি সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যায় খুশিতে ডগমগ ভুট্টো তাৎক্ষণিকভাবে মীরজাফর মোশতাক সরকারকে দুই কোটি ডলার মূল্যের ৫০ হাজার টন চাল ও দেড় কোটি গজ কাপড় দেওয়া কথা ঘোষণা করে। কিসিঞ্জার–ভুট্টোরা বাংলাদেশের খুনিদের দিয়েই হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়।
দেশিয় পরাজিত শক্তির সাথে বিদেশি এ অপশক্তিগুলো মুজিবহত্যার মাধ্যমে দেশকে ডুবিয়ে দেয় শত বছরের অন্ধকারে। আমরা সরে যাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বহুদূরে।
সৌজন্যেঃ bdnews24.com