1166
Published on মে 18, 2021জীবনের ঝুঁকি থাকার পরও দেশ গড়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন বলেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল, জাতি হিসেবে গর্বের।
রোববার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা'র স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৪০ বছর উপলক্ষে ‘সেদিন শেখ হাসিনা যদি দেশে না ফিরতেন’ শীর্ষক বিশেষ ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
তারা আরো বলেন, মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার এই মানসিকতাই শেখ হাসিনাকে একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আজ বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, শেখ হাসিনা তখন তার ছোট বোন শেখ রেহানা, স্বামী ও দুই সন্তানসহ তখনকার পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। ফলে তারা প্রাণে বেঁচে যান।
শেখ হাসিনার দেশে ফেরার এই দিন উপলক্ষে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে। এটি পরিচালনা করেন সুভাস সিংহ রায়।
ওয়েবিনারে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমীর হোসেন আমু বলেন, “সব হারানোর বেদনা অন্যদিকে নিজের জীবনের ঝুঁকি, এই অবস্থায় তিনি দেশে এসেছিলেন মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। সব হারিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করতে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। এজন্য তিনি সফল হয়েছেন।
“বারবার তাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আজকে বাংলাদেশকে এই পর্যায়ে আনতে তিনি সক্ষম হয়েছেন, যেটা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল।
আজকে হাতে গোনা কয়েকজন রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এটা জাতি হিসেবে আমাদের গর্বের। শেখ হাসিনা ফিরে না আসলে যুদ্ধপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ যে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে, তা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারনেই।”
শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন তখন ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ।
ওয়েবিনারে তিনি পঁচাত্তর পরবর্তীকালে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের ইতিহাস বর্ণনা করে বলেন, “আওয়ামী লীগের ওপর এমন নিপীড়ন আনা হলো যে তারা দল থেকে বেরিয়ে অন্য দল করল। আওয়ামী লীগ ব্রাকেটবন্দি হয়ে গেল। এতে সারাদেশের কর্মীরা খুব হতাশ হয়ে গেলেন। কে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। শেখ হাসিনা আসার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।”
শেখ হাসিনার সংগ্রামী জীবনের চিত্র তুলে ধরে শিক্ষামন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি বলেন, “কাউকে এত ত্যাগ, এত লড়াই করতে হয়েছে- এই ইতিহাস পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এক রাতে ১৮ জন সদস্য হারানো। তারপর নিজের দেশে ফিরতে না পারা।“
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এই ৪০ বছরে শেখ হাসিনা প্রতিটি মুহূর্তে সংগ্রাম করেছেন উল্লেখ করে দীপু মনি বলেন, “যেখানে গেছেন তিনি বাধার মুখে পড়েছেন। কিন্তু তিনি দমে যাননি। সারাদেশে তিনি সংগঠনকে শক্তিশালী করেছেন। শত বাধার মুখেও গণতন্ত্রকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
“আওয়ামী লীগ তার নেতৃত্বেই প্রতিটি নির্বাচনে একর পর এক জয়লাভ করেছে। তিনি জানেন কোন সময়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই সত্তর বছর বয়সের তিনি একইভাবে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।”
ফিরে এসে আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করা তার চ্যালেঞ্জ ছিলো উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীল সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, “সেই কাজে তিনি সফল হয়েছিলেন। ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন। একই সঙ্গে দারিদ্রমুক্ত দেশ গড়া তার প্রতিজ্ঞা ছিল।”
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, “বঙ্গবন্ধু কন্যা যেদিন দেশে পা রাখলেন সেদিনই মানুষ আশায় বুক বেধেছিলেন। তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হবে, এবার আওয়ামী লীগ অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। সব হয়েছে। নতুন প্রজন্মের জন্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্য তিনি একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছেন।”
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ১০ দিন পর ২৫ অগাস্ট সকালে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে শেখ হাসিনা বোন শেখ রেহানা এবং তার স্বামী ওয়াজেদ মিয়া, শিশু পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও শিশু কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেনসহ দিল্লি পৌঁছান।
ভারতে তখন জরুরি অবস্থা চলছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোনো খবরাখবর ভারতের পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে না। কাজেই তখনকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে এক রকম অন্ধকারে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে।
দিল্লিতে পৌঁছানোর দুই সপ্তাহ পর ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসায় যান। সেখানেই শেখ হাসিনা ১৫ অগাস্ট ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা জানতে পারেন।
এরপর ভারতেই একপ্রকার নির্বাসিত সময় কাটে শেখ হাসিনা পরিবারের। ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা বিভিন্ন সময় দিল্লি যান তাদের খোঁজ-খবর নিতে।
এরপর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কয়েকজন নেতা কয়েক দফায় দিল্লিতে তার সঙ্গে দেখা করেন। তাদের সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিতে রাজি করানো।
১৯৮১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে থাকা অবস্থায় তিনি খবর পান, ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছে। এর এক সপ্তাহ পরে আওয়ামী লীগের সেই সময়ের শীর্ষ নেতারা দিল্লি যান।
আব্দুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ, এম কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, স্বামী গোলাম আকবার চৌধুরীসহ বেগম সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, বেগম আইভি রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ১৯৮১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে দিল্লি পৌঁছান।
শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েকটি বৈঠক করেন তারা।
১৬ মে শেখ হাসিনা ও তার মেয়ে দিল্লি থেকে একটি ফ্লাইটে কলকাতা পৌঁছান। ১৭ মে বিকালে তারা কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান। তাদের সঙ্গে ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলী।
সেদিন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আর প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজার হাজার জনতা জড়ো হয়েছিল তেজগাঁওয়ের পুরনো বিমানবন্দরে।
‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় বিমানবন্ধর এলাকা। ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম পিতৃ হত্যার বদলা নেব।’, ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’ স্লোগানে মুখরিত ছিল এলাকা।
বিমানবন্দর থেকে শেখ হাসিনাকে নিয়ে যাওয়া হয় মানিক মিয়া এভিনিউয়ে, সেখানে লাখো জনতার উপস্থিতিতে এক সমাবেশে শেখ হাসিনা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, “সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।
“আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই।”
এরপর থেকে ১৭মে আওয়ামী লীগ ও এর অন্যান্য সংগঠন শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্সন দিবস পালন করে।