শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন: প্রাণ ফিরে পায় জাতি, গড়ে ওঠে নন্দিত বাংলাদেশের ভিত্তি

8058

Published on মে 16, 2023
  • Details Image

বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা, দেশের অভ্যন্তরীণ হাজারো প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এখন বিশ্বের বুকে এক নতুন বাংলাদেশের আওয়াজ পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। তার হাত ধরে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মহিমান্বিত হয়েছে বাঙালি জাতি, 'তলাবিহীন ঝুড়ি'র ইমেজ থেকে বাংলাদেশকে মুক্তি দিয়েছেন। স্বীয় সাহস, দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বের গুণে বিশ্বের বুকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে এখন তার পরিচিতি। কিন্তু এই পথপরিক্রমার প্রতিটি দিন ছিল একসময় দুঃস্বপ্নের মতো। স্বজন হারানোর বেদনায় প্রতিনিয়তই অশ্রুজলে ভিজেছে তার মায়াবী শাড়ির আঁচল। নির্বাসিত জীবনের প্রতিটি দিন কেটেছে আততায়ীর হাতে প্রাণ হারানোর আশঙ্কা নিয়ে। তবুও তিনি দমে যাননি। সব ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে, নিয়মিত বুলেট-বোমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, আজকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন এক অদম্য বাংলাদেশকে। মানবিকতার প্রয়োজনে নিজেও হয়ে উঠেছেন অপ্রতিরোধ্য। পিতার প্রতিষ্ঠা করা দেশকে গড়ার জন্য জন্য প্রাণপণে কাজ করছিলেন শেখ হাসিনা, মাঝপথে বারবার বাধা এসেছে। এমনকি তিনি যখন দেশকে দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত করতে তীব্র প্রতিজ্ঞ হলেন, তখন তাকে দেশ থেকে সরানোর অপচেষ্টা করা হলো। কিন্তু নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে, দেশের মানুষের কাছে থেকে গেলেন তিনি।

বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের সময় একাধিকবার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় ২০০৭ সালে তাকে দেশ থেকে সরানোর অপচেষ্টা করে উগ্রবাদী গোষ্ঠী ও তাদের আন্তর্জাতিক চক্র। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকাল চলছিল তখন। চিকিৎসার জন্য শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন দেশের বাইরে। সেসময় তাকে দেশে না ফেরার জন্য হুমকি দেয় তারা। কিন্তু জেলের ভয় উপেক্ষা করে সেই বছরের ৭ মে দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। দেশকে যখন বিরাজনীতিকরণের ষড়যন্ত্র চলছিল, ঠিক সেই পরিস্থিতিতে নিরাপদে বিদেশে না থেকে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশরত্ন শেখ হাসিনার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত কোটি কোটি জনতাকে আন্দোলিত করে তোলে। এর আগেও, ১৯৮১ সালের ১৭ মে, বিধ্বস্ত বাংলাদেশের বুকে তুমুল প্রাণের গণজোয়ার নিয়ে ফিরে এসেছিলেন তিনি। তখনও জান্তার ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া প্রাণে জনতারা প্রাণে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সাহস ফিরে পেয়েছিল। শেখ হাসিনার প্রথম প্রত্যাবর্তন ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিত অপশক্তির হাত থেকে বিজয়ী বাঙালি জাতির স্বকীয় রক্ষার জন্য, আর দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তনটি বাংলাদেশকে জঙ্গিগোষ্ঠীর কড়াল গ্রাস থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তাই বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রতিটি প্রত্যাবর্তন বিশ্বের বুকে নন্দিত বাংলাদেশ গড়ার ইতিহাসের একেকটি অনবদ্য মাইলফলক।

সাহসী সময়ের অনুপ্রেরণা ও জনমনের আলোকবর্তিকা

২০০৭ সালে সামরিক বাহিনীর সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আন্তর্জাতিক কুচক্রীদের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র রুখে দেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। চিকিৎসা শেষে বন্দুকের নল উপেক্ষা করে দেশে ফিরেই গণতন্ত্র রক্ষার ডাক দিলেন নেত্রী। কেঁপে উঠলো জাতির মাথার ওপর চেপে বসা ছদ্মবেশী সুশীল জান্তাদের আত্মা। কয়েকদিন পর, ১৬ জুলাই, শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে জনজাগরণ স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে তারা। কিন্তু জেলে যাওয়ার আগে দূরদর্শী নেতা শেখ হাসিনা যে নির্দেশ দিয়ে যান, তার প্রতি আস্থা রাখে জনগণ। সংগঠিত হতে থাকে দল। যার ফলাফল, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এবং আজকের বাংলাদেশের বিশ্বজয়ের গল্প...

একটা কথা প্রচলিত আছে: যখন আওয়ামী লীগ জেতে, তখন জিতে যায় বাংলাদেশ; আবার যখন আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন পুরো দেশটাই মুখ থুবড়ে পড়ে। হ্যা, তাই। বাংলাদেশ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, অগ্রযাত্রা ও আওয়ামী লীগ একই সূত্রে গাঁথা। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে এগুতে থাকে আওয়ামী লীগ, চূড়ান্তভাবে বঙ্গবন্ধুর হাতে সঞ্জীবনী লাভ করে দলটি। এই দলের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার অমিয়সুধা পান করি আমরা। এরপর আকাশজুড়ে ডানা মেললো লাল-সবুজের দামাল পতাকা। আর বিধ্বস্ত ভূমিজুড়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্মম নাগপাশের চিহ্ন, ৫৫ হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি ইঞ্চিতে সদ্য শৃঙ্খলমুক্তির স্পষ্ট দাগ, দুই যুগের অধিক সময়ের শোষণ আর ৯ মাসের যুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল আমাদের সোনার বাংলা।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যার কণ্ঠের বজ্র এবং উদ্ধত তর্জণীর নাচনে প্রাণ বাজি ধরেছিল সাত কোটি বাঙালি, সেই মহান নেতা, ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য-স্বাধীন এই বিধ্বস্ত রাষ্ট্রের শরীর থেকে সব ক্লেদ মুছে ফেলার মিশনে নামলেন। শুরু হলো দেশ গড়ার কাজ। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, দুর্ভাগ্য এই হতভাগা জাতির, দেশাদ্রোহী ও ছদ্মবেশীদের ষঢ়যন্ত্র চলতেই থাকলো। অবশেষে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িকে ঢেকে দিলো অশুভ মেঘের কালো ছায়া, সেই কালরাতের আঁধারে সব আলোর পরশ ডুবে গেলো। এরপর দীর্ঘদিনের জন্য সামরিক শাসন এবং মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত কুচক্রীদের বিষাক্ত নখরের আঁচরে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে প্রিয় দেশ। হাহাকার শুরু হয় জনমনে। ঠিক এমনই এক সময়, স্বৈরশাসনে হাঁপিয়ে ওঠা জনমনে স্বস্তি ফেরাতে, দেশজনতার আকুল আহ্বানে দৃশ্যপটে আবির্ভাব তার: ১৯৮১ সালের ১৭ মে, অর্ধযুগ নির্বাসন শেষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্তমিত করার জন্য মুজিব পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করতে ১৫ আগস্ট যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, সেসময় বিদেশে অবস্থান করায় ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই দুহিতা- শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এরপর তার দেশে ফেরার সব প্রচেষ্টা নস্যাৎকরে দেয় স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। দীর্ঘ ছয় বছর বিদেশের মাটিতে আততায়ীর হাতে প্রাণ হারানোর আশঙ্কা নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন তিনি। এই টালমাটাল সময়ের সুযোগটা কাজে লাগিয়ে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাকে আবারো শ্মশানে পরিণত করে স্বাধীনতাবিরোধী ও উগ্রবাদীরা। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে বিশ্বের বুকে বীরের জাতি হিসেবে বাঙালি যে গৌরব অর্জন করেছিল, সেই পরিচয়কে কালিমালিপ্ত করে তারা। উগ্রবাদের উত্থান, সামাজিক নৈরাজ্য এবং অনাচারের ভারে নুয়ে পড়ে বাংলাদেশের উচ্চ শির। দেশমাতৃকা ও আপামর জনতার জীবনের দুর্যোগ অসহনীয় হয়ে ওঠে। এরকম একটি পরিস্থিতে আর দূরে থাকতে পারলেন না বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। পিতার প্রতিষ্ঠা করা দেশের মানুষের মানবিক মুক্তির জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করে ছুটে আসেন তিনি। ১৯৮১ সালের ১৭ মে, অন্ধকারে নিমজ্জিত হতাশাগ্রস্ত বাঙালি জাতির আশার প্রদীপ হয়ে ফিরলেন শেখ হাসিনা। জনাকীর্ণ রাজধানীর জনস্রোত ভিজে গেলো অনলঅশ্রুতে। শুরু হলো নতুন সংগ্রাম। এলোমেলো হয়ে যাওয়া এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় দলটির দায়িত্ব নিলেন তিনি। সেই থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ বছর রাজপথে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে সংগঠিত করেছেন। কিন্তু থেমে ছিল না ষড়যন্ত্রীরা।

আপামর জনতার জন্য নিজেকে বিপন্ন করে দেওয়া প্রাণ

স্বৈরাচারবিরোধী তৎপরতার কারণে শেখ হাসিনাকে জনগণের থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র হয়। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক সরকার তাকে আটক করে ১৫ দিন অন্তরীণ রাখে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি এবং নভেম্বর মাসে তাকে দুবার গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৫ সালের ২রা মার্চ তাকে আটক করে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দি ছিলেন। ১৯৮৭ সালে ১১ নভেম্বর তাকে গ্রেফতার করে এক মাস অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়ে গৃহবন্দি হন। ১৯৯০ সালে ২৭ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ করা হয়। এতো কিছুর করেও দমিয়ে রাখা যায়নি তাকে।

অদম্য নেত্রীকে বন্দি করেই থেমে থাকেনি তারা। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দুর্বার আন্দোলন আন্দোলন থামিয়ে দিতে গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনাকে অজস্রবার রাষ্ট্রীয় মদতে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনকালে তাকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এসময় কয়েকজন নিহত হন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তাকেসহ তার গাড়ি ক্রেন দিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে সরকারের পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এসময় ৩০ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী শহীদ হন। লালদীঘি ময়দানে ভাষণদানকালে তাকে লক্ষ্য করে দুবার গুলি বর্ষণ করা হয়। জনসভা শেষে ফেরার পথে আবারও তার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাননি। নিজের প্রাণের মায়া উপেক্ষা করে জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার ফিরিয়ে আনতে: গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে অটল থেকেছেন তিনি।

তার নেতৃত্বেই ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে কোনও দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেনি। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করার নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে প্রধান বিরোধীদলের আসনে বসে আওয়ামী লীগ। পঞ্চম জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন জননেত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতার মোহে না ভুলে, শক্তিশালী গণতন্ত্রের লক্ষ্যে জনগণের জন্য কাজ করার ব্রত নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা থেকে যান রাজপথে। দেশের প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী হওয়ার পরও শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বারবার হামলা করা হয়েছে। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন চলাকালে তাকে লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে তার কামরা লক্ষ্য করে অবিরাম গুলি ছোড়া হয়। তবুও মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ে কখনও পিছপা হননি শেখ হাসিনা।

পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে বিএনপির ভোটারবিহীন নির্বাচনের বিরুদ্ধে তিনি গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনের মুখে ৩০ মার্চ তৎকালীন খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। শেখ হাসিনার আপোষহীন কঠোর অবস্থানের কারণেই জনগণ ফের ভোটের অধিকার ফিরে পায় এবং সেবছরই জুন মাসে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার নেতৃত্বে ১৪৬ আসনে জয় লাভ করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। আবার শুরু হয় অগ্রযাত্রা। প্রধানমন্ত্রী হয়েই, দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত থাকা গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বণ্টনে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি করেন তিনি। পরের বছর পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদিত করেন, ফলে কয়েক দশক ধরে চলমান চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের উত্তেজনা প্রশমিত হয়। ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় তার সরকার দুই কোটি বন্যাদুর্গত মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্য প্রদান করে। এসব ঘটনার পরম্পরায় বিশ্ব গণতন্ত্রের শীর্ষ নেতাদের কাতারে উচ্চারিত হতে থাকে তার নাম। তবুও থেমে থাকেনি ষঢ়যন্ত্র। ২০০০ সালে ফের এক জনসভাকে কেন্দ্র করে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জঙ্গিদের নেতৃত্বে কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং সেখানকার জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দুটি বোমা পুঁতে রাখা হয়। ঘটনাস্থলে পৌঁছার পূর্বেই বোমাগুলো শনাক্ত হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা।

২০০১ সালের নির্বাচনে জনপ্রিয় ভোট বেশি পেয়েও, শুধু আসন সংখ্যা কম হওয়ায় সরকার গঠন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। আবারও বিরোধীদলীয় নেত্রী হন শেখ হাসিনা। এবার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত করে দেশকে। মন্ত্রিত্ব পান যুদ্ধপরাধীরা। হত্যা করা হয় শেখ হাসিনার আস্থাভাজন দুজন জনপ্রিয় সংসদ সদস্যকে। দেশজুড়ে ৬৪ জেলায় চালানো হয় বোমা হামলা। এমনকি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য এক ডজনেরও বেশি আর্জেস গ্রেনেড হামলা ও গুলি চালানো হয়। এই ঘটনায় নিহত হন ২২ জন। শেখ হাসিনা নিজেও আহত হন। কিন্তু যার বুকে জেগে থাকে বাংলাদেশ, তাকে থমকে দেওয়া সহজ নয়। গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে তিনি অনঢ় থাকলেন।

বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনা: একে অপরের সমার্থক নাম

বিএনপি-জামায়াত সরকারের মেয়াদ শেষে নিয়মানুসারে ক্ষমতা ছেড়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন না দেওয়ায় ফের রাজপথে নেমে আসেন নেত্রী। কিন্তু চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে হয় তাকে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। রাজনীতি ও দেশ থেকে নির্বাসনে গিয়ে বিদেশে নিরাপদ জীবনযাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু তিনি সব প্রলোভন প্রত্যাখান করেন। দেশের পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে, দ্রুত চিকিৎসা শেষ করে, গ্রেফতারের হুমকি পরোয়া না করে, অমিত বিক্রমে ২০০৭ সালের ৭ মে দেশে ফিরে আসেন তিনি। তার আপোষহীন মনোভাবের কারণে বাংলাদেশের গণতন্ত্র লুট করার ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। ফলে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই, সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে সংসদ ভবন চত্বরে সাবজেলে পাঠায়।

তবে দেশজুড়ে তীব্র বিক্ষোভ ও জনমতের কারণে প্রায় ১ বছর পর ২০০৮ সালের ১১ জুন তাকে অসুস্থ অবস্থায় মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সেই অনির্বাচিত সরকার। এরপর বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন- 'দিন বদলের সনদ'। একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে জনগণের জন্য সব ধরনের গণতান্ত্রিক সুবিধা নিশ্চিতের ঘোষণা দেওয়া হয় এই ইশতেহারে।

তুমুল প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, শুধু শেখ হাসিনার গণতন্ত্রমুখী ও দুঃসাহসী নেতৃত্বের গুণে, নির্বাচনে একচেটিয়া জয় লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের জোট। জোটের মোট অর্জিত ২৬৭ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগই পায় ২৩০টি। এবার তিনি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে গণতন্ত্রের সুফল পৌঁছানোর প্রয়াস করেন। নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি করে পাঁচ কোটি মানুষকে মধ্যবিত্ত উন্নীত করেন। স্বাধীনতার প্রায় চার দশকের মাথায় এসে গণতন্ত্রের প্রকৃত সুফল ভোগ করতে শুরু করে জনগণ। মাথাপিছু আয় ও জীবনযাত্রার মান বাড়তে থাকে মানুষের। দেশ এগুতে থাকে সমৃদ্ধির পথে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ও রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করে ২০১৪ সালের নির্বাচনেও জয়লাভ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে টানা তৃতীয় বার ও মোট চতুর্থ বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বারবার ধ্বংসস্তূপ থেকে স্ফিংস হয়ে উঠে এসে দেশকে নতুন জীবন দান করে, এখন বাংলাদেশের একটি প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছেন এই মহান নেত্রী। তিনি হাসলে বাংলাদেশ হাসে। তার মুখেই শোভা পায় বাংলাদেশের হাসি। শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ, একে অপরের প্রতিধ্বনি।

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত