2885
Published on মে 7, 2021অজয় দাশগুপ্ত:
৭ মে ২০০৭ সাল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেসন কাউন্টার থেকে বের হয়ে এসে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনের উদ্দেশে রওনা হবার সময় হাতে গোণা কয়েকজন নেতা তাকে স্বাগত জানান। তখন ছিল জরুরি আইন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিশাল জমায়েত করে দলের সভাপতিকে বিমান বন্দরে স্বাগত জানানোর সুযোগ আওয়ামী লীগের নেই। সবচেয়ে বড় কথা, ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকে বাংলাদেশে ফিরতে না দিতে বিশেষভাবে তৎপর ছিল। কিন্তু বিমানবন্দরের ভেতরের সড়ক থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে নিয়ে গাড়িটি প্রধান সড়কে পড়তে না পড়তেই দেখা গেল অভূতপূর্ব দৃশ্য- দলে দলে আওয়ামী-ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা প্রশস্ত রাজপথ ভরে ফেলল। এ যেন ম্যাজিক! কেবল একটি স্থানে নয়, বিমানবন্দর থেকে ধানমন্ডি পর্যন্ত ১৫-১৬ কিলোমিটার পথজুড়ে কেবল মানুষ আর মানুষ। কণ্ঠে তাদের স্লোগান জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার আগমন স্বাগতম স্বাগতম। উঁই পোকার হঠাৎ আবির্ভাব- এ দৃশ্য আমাদের দেশে অপরিচিত নয়। একটা-দুইটা উঁই পোকা হঠাৎ করেই ঢিপি থেকে বের হয়ে আসে, মুহূর্ত যেতে না যেতেই অনেকটা এলাকা জুড়ে কেবল উঁই আর উঁই। হাজারে হাজারে, লাখে লাখে। ৭ মে তেমনটিই ঘটেছিল- জনে জনে মিলে জনস্রোত। সাধারণত আওয়ামী লীগ কিংবা এ ধরনের দলের বড় সমাবেশে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে নেতা-কর্মীরা আসেন বাস-ট্রাকে। কিন্তু সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এমনটি ঘটতে পারেনি। দেশে জারি রয়েছে জরুরি আইন। তারা আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। প্রবল আন্দোলনের মুখে ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানো বিএনপির অনেক নেতাও তখন কারাগারে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। এমন অবস্থায় কী করে সম্ভব হলো এ ধরনের জমায়েত?
গোয়েন্দারা কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। তারা ধরেই নিয়েছিল বিমানবন্দরে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা হাজির থাকবেন, তারপর শেখ হাসিনা ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে অদূরে সুধা সদনে ফিরে যাবেন নিজের ঘরে। ব্যস, তারপর সবকিছু আগের মতো- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ন্ত্রণে।
শেখ হাসিনা আরও দুই সপ্তাহ আগে স্বদেশে ফেরার জন্য লন্ডন বিমান বন্দরে গিয়েছিলেন। তিনি চিকিৎসার জন্য প্রথমে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার দিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে প্রণীত পরিকল্পনা অনুযায়ী ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাসহ গোটা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল সেই অভিশপ্ত দিনে। অন্তত ২৪ জন সেই হামলায় নিহত হন। এদের মধ্যে ছিলেন কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভী রহমান। আহত সংখ্যা অন্তত ৫ শ’। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ অনেকে আহতের দলে। ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ বানানো হয়েছিল। শেখ হাসিনাসহ আরও অনেক নেতা ছিলেন মঞ্চে। সমাবেশ ও মঞ্চ লক্ষ্য করে একের পর এক গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। চারদিকে মৃত্যুপথযাত্রীদের আর্ত চিৎকার। এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকন্যাকে শরীর দিয়ে আড়াল করে রাখেন একদল নেতা-কর্মী। ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রচণ্ড শব্দ ও গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে শ্রবণ শক্তি কমে যায় এবং তা স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়।
এ ব্যাধি নিয়েই তিনি ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন ব্যর্থ করার সফল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জরুরি আইন জারির পর তিনি কানের চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যান। ফিরে আসবেন লন্ডন হয়ে। সেখান থেকেই বিমানে ওঠার তারিখ নির্ধারিত হয় ২৩ এপ্রিল (২০০৭)। কিন্তু ততদিনে ঢাকায় নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়। অপপ্রচারও চলতে থাকে। কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুর মতোই অদম্য। মামলার কথা জানতে পেরে ঘোষণা দেন- আদালতে গিয়ে তিনি প্রমাণ করে দেবেন যে এ মামলা হয়রানিমূলক। রাজনৈতিকভাবে তাকে দমিয়ে রাখার জন্যই এটা দায়ের করা হয়েছে। ততদিনে ঢাকায় ‘মাইনাস টু’ গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। বলা হচ্ছিল শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক নির্বাসনে পাঠানো হবে। তবে রাজনৈতিক হালচাল যাদের জানা, তারা বলছিল- তত্ত্বাবধায়ক সরকার মাইনাস টু নয়, প্রকতপক্ষে চাইছিল শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দিতে। তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য মাইনাস ওয়ান। সামরিক বাহিনী নেপথ্যে থেকে যে সরকার চালাচ্ছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে তারা। কিন্তু আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদ একই কথা বলেছিল। জনগণ দেখেছে- এদের কেউ গণতন্ত্র দিতে চায় না। আর তাদের অসৎ উদ্দেশ্য ভণ্ডুল করে দিতে বার বার যে দলটি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তার নাম আওয়ামী লীগ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং একই বছরের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ চার সহকর্মীকে হত্যা করেও এ দলকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব এ দলটির। জরুরি আইনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা রুখে দাঁড়াবেন, এ নিয়ে শাসকদের সন্দেহ ছিল না। এ কারণে তারা চেয়েছিল রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে তাকে সরিয়ে দিতে। তাদের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক ছিল বাংলাদেশের বাইরে লন্ডন কিংবা অন্য কোনো স্থানে তাকে নির্বাসিত জীবনযাপনে বাধ্য করা। প্রয়োজনে আরাম-আয়েশে জীবন কাটানোর ব্যবস্থা করা হবে। এখন তারেক রহমান যেমন লন্ডনে জীবন কাটাচ্ছেন, অনেকটা সে ধরনের ব্যবস্থাই প্রায় করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা সে অপচেষ্টা বানচাল করে দেয়। শেখ হাসিনা লন্ডনে ব্রিটিশ সরকার ও বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেন- মিথ্যা মামলা টিকবে না। তিনি আদালনে হাজির হবেন। বিচারে যদি দণ্ড হয়, সেটা মাথা পেতে নেবেন। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের পথ ছাড়বেন না। বঙ্গবন্ধু কোনো দিন জেল জীবনকে ভয় পাননি। তাকে ক্যান্টনমেন্টেও বন্দি রাখা হয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে। শেখ হাসিনা মা মহিয়সী নারী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সঙ্গে বার বার পিতার বন্দিজীবন দেখেছেন। কী করে কঠিন সময়েও মাথা উঁচু করে থাকতে হয়, সে শিক্ষা তিনি পিতার কাছ থেকে পেয়েছেন। এইচ এম এরশাদের শাসনামলে তাকে একাধিকবার গৃহবন্দি রাখা হয়েছে। কিন্তু তাকে দমন করা যায়নি। এখনও যাবে না। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বাধ্য করেন তার স্বদেশ ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে। এরপর ফিরে আসেন ৭ মে।
তিনি জানতেন, তাকে বিমান বন্দরেই গ্রেফতার করা হতে পারে। কিংবা সুধা সদনে গৃহবন্দি করে রাখা হতে পারে। কিন্তু দৃঢ় সংকল্প তাঁর- নাথিং উইল গো আনচ্যালেঞ্জড। তিনি দলকে জানিয়ে দেন- রাজপথে থাকতে হবে। নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধুকন্যার বার্তা বুঝে যায়। দলে দলে তারা অবস্থান নেয় ১৫-১৬ কিলোমিটার পথ জুড়ে। গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে পারে তারা। হয়ত কেউ কেউ ফুটপাতে কিংবা রাস্তার মোড়গুলোতে বাড়তি লোকের উপস্থিতি দেখতে পেয়েছেন। সড়কের আশপাশের গাছের ছায়ায় কিংবা বিভিন্ন দোকান ও বাসভবনের সামনে ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। তবে কেউ বিশেষভাবে খতিয়ে দেখেনি কেন এত দীর্ঘ পথ জুড়ে বাড়তি লোকের সমাবেশ। ওই রাতে টেলিভিশন সংবাদ থেকে এবং পরদিন সংবাদপত্রের মাধ্যমে সবাই জেনে যায় বঙ্গবন্ধুকন্যা অভাবনীয় সংবর্ধনা পেয়েছেন। এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ তার সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় রাখতে পেরেছে। তৃণমূলে সংগঠন থাকলে এবং দলেল প্রতি কর্মী-সমর্থকদের দরদ ও আন্তরিকতা থাকলে প্রয়োজনের সময়ে সাড়া মিলবেই। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্তরা সেটা পারে, তার প্রমাণ মিলেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের, জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার দুঃশাসনের সময়।
৭ মে’র পর শেখ হাসিনা অবশ্য বেশি দিন মুক্ত জীবনে থাকতে পারেননি। তাকে ১৬ জুলাই গ্রেফতার করা হয়। ওই দিনই আদালতে নেওয়া হলে দলের নেতা-কর্মীরা ফের স্লোগানমুখর হয়- শেখ হাসিনার মুক্তি চাই। তিনি যতদিন কারাগারে ছিলেন, একের পর এক মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্ভিক। কর্মীরাও ছিলেন রাজপথের সাহসী সৈনিক। ১১ মাসের বন্দিজীবন শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি মুক্তিলাভ করেন। সাড়ে ৬ মাস পর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জয়ী হয়। যে নেতা-কর্মীরা শেখ হাসিনাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনে তাদের পরিশ্রম স্বার্থক হয়। শুরু হয় বাংলাদেশের নতুন যাত্রা।