2934
Published on মে 7, 2021সুভাষ সিংহ রায়ঃ
আমার এ লেখাটি মূলত আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশ্যে এবং নতুন-পুরনো মিলিয়েই। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা এতিম করে দিয়েছিল। প্রকৃতার্থে খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে সমগ্র বাঙালি জাতিকে এতিম করে দিয়েছিল। তারপর বাঙালি জাতির জীবনে অমানিশার অন্ধকার। বঙ্গবন্ধুর দু-কন্যার কষ্ট এখনকার সময়ে আওয়ামী লীগারদের বোঝার কথা নয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে ও ২০০৭ সালের ৭ মে দুটো দিন; ২৬ বছরের ব্যবধান। সবাইকে দুটো দিনের কথা মনে করতে বলব। দুটো দিনেই শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। ১৯৮১ সালে জিয়া সরকার বশংবদদের দিয়ে ‘শেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি’ পর্যন্ত করিয়েছিল।
কতটা দুর্বিষহ অবস্থার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাকে পথ চলতে হয়েছে। ছয়টি বছর কাটাতে হয়েছে অত্যন্ত অসহায়, বেদনাহত দুর্ভোগ নিয়ে। শেখ রেহানার বয়স তখন মাত্র ১৭ বছর হবে, পড়াশোনা আর শেষ করতে পারেননি। ১৯৭৮ সালে লন্ডনে এক চাচার বাসায় তার বিয়ে হয়েছিল মা-বাবার মনোনীত পাত্র ড. শফিক সিদ্দিকীর সাথে। এক প্লেনের টিকিটের অভাবে শেখ হাসিনা সেই বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারেননি। বর্তমান সময়ে এসে আওয়ামী লীগের পুরনো নেতারা তা কতখানি তা উপলব্ধি করেন। ১৯৮১ সালে লড়াই করে দেশে ফিরে আসার পর কারা কারা মমতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। হাতেগোনা কয়েকজন। লন্ডনে শেখ রেহানার কষ্টের জীবন নিয়ে এখনকার সময়ের দলের নেতারা কতখানি উপলব্ধি করতে পারেন। ভারতের বঙ্গবন্ধু দু-কন্যার নির্বাসিত জীবনের কষ্টের কাহিনি কিছু কাহিনি “হাসিনা এ ডটার’স টেল”-এ ফুটে উঠেছে। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ তারিখে কলকাতার নন্দন প্রেক্ষাগৃহে ডকুফিল্মটি যখন দেখানো হয়েছিল। তখন হলভর্তি কলকাতার নাগরিক সমাজের সবার চোখে বেদনার অশ্রু দেখতে পেয়েছি।
একবার ভাবুন তো ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরে আসেন, সেইদিন রাতে শেখ হাসিনার থাকার জায়গা দলের নেতারা কী ঠিক করে রাখতে পেরেছিলেন? বঙ্গবন্ধুর এক নিকট আত্মীয় সাবেক যুগ্ম সচিব সৈয়দ হোসেনের লালমাটিয়ায় দু-রুমের বাসায় ছিলেন। শেখ হাসিনা তার বাবার বাড়ি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ঢুকতে পারেননি। এমনকি মিলাদ পড়তে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। কবি হেলাল হাফিজের এক বিখ্যাত কবি ‘ফেরিওয়ালা’। ‘কষ্ট নেবে কষ্ট, সাদা কষ্ট, নীল কষ্ট, মাল্টিকালারড কষ্ট আছে’। সারা পৃথিবীতে এমন অভাগা আছেন যিনি শেখ হাসিনার মতো এক জীবনে এত কষ্ট পেয়েছেন। যারা তাকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বানিয়েছিলেন, তারা কি সবাই ভালোবেসে বানিয়েছিলেন। অনেকটা বাধ্য হয়েই বানিয়েছিলেন। কেননা এ সিদ্ধান্তের বিকল্প ছিল না। আওয়ামী লীগের মরমি কর্মীদের একটা ভীষণ চাপ ছিল। শেখ হাসিনার এই কষ্ট কোনোদিন ভুলতে পারবেন না তার পিতার লাশ ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে রেখে আওয়ামী লীগের নেতারা খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় শপথ নিয়েছিলেন।
১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। পুরনো পত্রিকা ঘাঁটলে দেখা যায়, কাউন্সিলকে সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন স্থানে নেতা ও কর্মীদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য ভয়ঙ্করভাবে প্রকট হয়ে পড়ে। প্রথমে নারায়ণগঞ্জ, তারপর চট্টগ্রামে সাংগঠনিক জেলা কাউন্সিল দু-দল কর্মীর মধ্যে মারামারি-হানাহানির ফলে পণ্ড হয়ে যায়। চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ কয়েকটি স্থানে জেলা কমিটির পাল্টা জেলা কমিটি গঠিত হয়। মারামারি-হানাহানির ঢেউ ঢাকায় এসেও লাগে। এমনকি অধিবেশনের দুদিন আগে দলের অঙ্গসংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগ দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠনের মাধ্যমে। ১৯৮১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকার সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নানারকম ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে সেই কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ বলেছিলেন, “কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হওয়াতে এটা প্রমাণিত হয়েছে আমরা শত্রুদের একটি ঘৃণিত চক্রান্তকে ব্যর্থ করতে পেরেছি।”
‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ সালের সংখ্যা থেকে জানতে পারি কীভাবে শেখ হাসিনা ওই সময়ে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে কাজ করেছেন। সেই সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে এগিয়ে যান’। শেখ হাসিনার একটি বার্তা তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক সম্মেলনে পাঠ করে শোনান। তোফায়েল আহমেদ টেলিফোনে শেখ হাসিনার সঙ্গে শেখ সেলিমের আলোচনার কথা উল্লেখ করে ইতোপূর্বে ঘোষণা করেন, ‘একটি সুসংবাদের অপেক্ষায়’ তারা আছে। শেখ হাসিনা তার বার্তায় সর্বপ্রকার দ্বন্দ্ব-বিভেদ ভুলে আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে কাউন্সিলর ও নেতাদের বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি বাস্তবায়নের আহ্বান জানান। আর সুসংবাদটি হচ্ছে শেখ হাসিনা সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আজকে আওয়ামী লীগের পুরনো-নতুন সবাইকে শেখ হাসিনা সেই এই দলের হাল ধরেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে। আজ তিনি বাঙালির বিকল্পহীন অবলম্বনে পরিণত হয়েছেন। কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান একবার ঢাকায় কোনো এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আবদুল গাফফার চৌধুরীকে হাত ধরে বলেছিলেন, “দোহায় গাফফার, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কিছু লিখো না। বয়স তো কম হলো না। কম তো আর দেখলাম না। ডান-বাম সব নেতাকেই তো দেখলাম। ক্রাইসিসের সময়ে শেখ হাসিনাকে ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায় না।” সে-সময়ের কদিন আগে গাফফার চৌধুরী কোনো এক বিষয়ে শেখ হাসিনাকে সমালোচনা করে লেখা লিখেছিলেন। যে-কারণে শওকত ওসমান বর্ষীয়ান সাংবাদিক গাফফার চৌধুরীকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলেন।
শেখ হাসিনা যখন ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন তখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেমন ছিল, তা সবারই জানা আছে। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বঙ্গবন্ধুর দু-কন্যাই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটির জন্য ব্রিটেনে প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছেন। ১৯৮০ সালে লন্ডনের ইয়র্ক হলে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যাকাণ্ড ও জেলখানায় চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তারই ধারাবাহিকতায় "SHEIKH MUJIB, murder enquiry; preliminary report" নামে ব্রিটিশ সংসদীয় কমিটির এক খসড়া রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই কমিটিতে স্যার থমাস উইলিয়ামস এমপি (Sir Thomas Williams MP), শ্যেন ম্যাকব্রাইড (Sean Macbride QC), জেফরি থমাস (Jaffery Thomas QC), আব্রে রোজ (Aubray Rose) মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীরা ছিলেন।
তদন্ত কমিটির প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন; কিন্তু জিয়াউর রহমান সরকার কোনোভাবেই আসতে দিতে চায়নি। ১৯৮১ সালের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর সময়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আন্তর্জাতিক খ্যাত ‘নিউজউইক’ পত্রিকা থেকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “আপনি এত বিপদ জেনেও কেন বাংলাদেশে যাচ্ছেন?” শেখ হাসিনা তখন স্পষ্ট জবাব দিয়েছিলেন, “মহৎ কাজ করতে হলে ঝুঁকি নিতেই হয়।” সত্যি সত্যি গত চার দশক যাবত শেখ হাসিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, দলের ভিতরে অবস্থানরত কেন্দ্রীয় নেতারা সব সময় শেখ হাসিনাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়েছেন?
দুই
শেখ হাসিনা ছয় বছর নির্বাসিত জীবন শেষ করে যখন বাংলাদেশে ফিরেন তখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি কেমন ছিল, তা সবারই জানা আছে। ‘আওয়ামী লীগ’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারণ করাটাও ছিল অপরাধের কাজ। কবিরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখে জেল খেটেছেন। এমনি ছিল সে-সময়কাল শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। মৃত মুজিবকে মোকাবিলা করার জন্য ৪ আগস্ট ১৯৭৬, ইতোপূর্বে জারি করা রাজনৈতিক দলবিধি সংশোধন করা হয়। প্রথমে জারি হওয়া দলবিধিতে ছিল, ‘ক্ষতিকর কার্যকলাপে’ লিপ্ত কোনো সংগঠনকে নিবন্ধন দেওয়া হবে না। ৪ আগস্টের সংশোধনীতে ক্ষতিকর কার্যকলাপের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ১০টি উপ-দফার উল্লেখ করা হয়। ১০ নম্বর উপ-দফায় বলা হয় : “কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি বা উৎসাহিত করিবার জন্য পরিকল্পিত হয় কিংবা এইরূপ শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি বা উৎসাহিত করিতে পারে বলিয়া সম্ভাবনা রহিয়াছে।” সরকার চিকিৎসার জন্য তাকে লন্ডনে পাঠায়।
চিকিৎসা শেষে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬, ঢাকায় ফিরে ভাসানী বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন : “দেশের জনগণ এ মুহূর্তে নির্বাচন চায় না। এ দেশের জনগণ মুসিলম লীগ ও বিগত আওয়ামী লীগ আমলেও নির্বাচনের কোনো সুফল পায়নি। দেশের মানুষ এই মুহূর্তে নির্বাচন চায় কি না, গণভোটের মাধ্যমে তা যাছাই করা দরকার।... একটা ‘বাজে’ গণপরিষদ কর্তৃক জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সংবিধান বাতিল করে সরকারের ভেতরের ও বাইরের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নতুন খসড়া সংবিধান তৈরির জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। নির্বাচন হইলে হানাহানি-কাটাকাটি হইবে। ইহা শান্তিপ্রিয় জনগণ চায় না। এই ধরনের নির্বাচনে ইতিপূর্বে যাহারা ক্ষমতায় গিয়াছিল... আবার তাহারাই ক্ষমতায় আসিবে।” এ-মুহূর্তে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে, এ-রকম একটা ‘আশঙ্কা’ ছিল মওলানা ভাসানীর। তাই তিনি চেয়েছিলেন নির্বাচন যাতে না হয়। ভাসানীর এই দাবি ছিল সামরিক সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন। (তথ্য সূত্র : বিএনপি সময়-অসময়, মহিউদ্দিন আহমেদ, প্রকাশক : প্রথমা প্রকাশন)
আওয়ামী লীগ ফরিদপুর জেলা কমিটির সভাপতি, গোপালগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৩.৩ শতাংশ ভোট (১০০ আসন) পেলেও সরকার গঠন করতে পারেনি। বিএনপি সেবার ৩০.৮ শতাংশ ভোট পেলেও ১৪০টি আসন পেয়েছিল। অনেকগুলো কারণ ছিল। অন্যতম কারণ ছিল ‘বাকশাল’-এর ‘কাস্তে’ মার্কায় প্রার্থী দাঁড়ানো। এতে সারা বাংলাদেশে অন্তত ৪২টি আসনে আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ মার্কার প্রার্থী পরাজিত হয়। অথচ জননেতা আবদুর রাজ্জাক শরীয়তপুরে দুটো আসনে ‘নৌকা’ মার্কায় প্রার্থী হয়ে দুটোতে জয়লাভ করেছিলেন।
১৯৯১ সালে বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসতে না পারত, তাহলে বাংলাদেশের সার্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট অন্যরকম হতো। শেখ হাসিনা গত চার দশক ধরে ক্রমাগতভাবে লড়াই করে চার মেয়াদে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, শেখ হাসিনা তার পিতার মতোই শুধু দেবার জন্যই ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে এসেছিলেন। তার কষ্ট আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী উপলব্ধি করেন, সেটি সঠিকভাবে বলা বেশ কঠিন। শেখ হাসিনা দেশে আসার আগে ১৯৭৯ সালে জাতীয় নির্বাচনে ২৪.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে ৩৩.৩ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ৩৭.৪ শতাংশ, ২০০১ সালে ৪০.১ শতাংশ, ২০০৮ সালে ৪৯.০ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগ একটি অনুভুতির নাম।”
তিন
যারা এখন নতুন করে আওয়ামী লীগ করছেন, তারা কতটুকু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাস জানেন। দলগতভাবে সারাদেশে আওয়ামী লীগের কতজন নেতা-কর্মী-সমর্থক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা জানাতে পেরেছেন?
শেখ হাসিনা ২০০৭ সালের ১৫ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন পুত্রবধূ এবং নবজাতক নাতনিসহ পুত্র-কন্যাদের দেখতে গিয়েছিলেন; কিন্তু সেখান থেকে দেশে আসতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল আর ২০০৮ সালের ১১ জুন মুক্তি পান। ১১ মাস দিন তিনি জেলে ছিলেন। অথচ বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয় শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করার ৬৯ দিন পরে ৩ সেপ্টেম্বরে। এ থেকে বোঝা যায়, শেখ হাসিনা কতটা ষড়যন্ত্রের শিকার। খ্যাতনামা ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট ১৯৭২ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেই ডেভিড ফ্রস্ট ২০০৭ সালের ২৭ এপ্রিল ‘আল-জাজিরা’ টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ডেভিড ফ্রস্ট সেদিন বলেছিলেন, “১৯৭২ সালের শুরুর দিকে আমি তার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখন তিনি একটি নতুন দেশের এসে পৌঁছেছেন মাত্র। পশ্চিম পাকিস্তান তাকে মুক্তি দিয়েছিল। আপনি যদি পুনরায় নির্বাচিত হন তবে কী করতে পারবেন বলে মনে করেন? জনগণ সব সময় সমস্যার কথা বলছেন। এটাকে দূর করা বা এটা থেকে কি মুক্তি পাওয়া সম্ভব।”
এর উত্তরে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমার সময় ১৯৯৬-২০০১ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল তখন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার মধ্যেই আমরা ব্যাপক উন্নয়ন করেছিলাম। আমাদের ৪০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি ছিল। আমরা উৎপাদন বাড়িয়েছি এবং দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছি। আমাদের শিক্ষার হার ছিল মাত্র ৪৫ শতাংশ। আমরা তা ৬৬ শতাংশে উন্নীত করেছি। দারিদ্র্য আমাদের প্রধান শত্রু। আমি খুবই আত্মবিশ্বাসী, আমরা দেশকে দ্বিগুণ এগিয়ে নিতে পারব এবং দুর্নীতিও কমাতে পারব।... আপনি জানেন, আমাদের জাতির জনক, স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতার নেতৃত্বেই আসে গণতন্ত্র। আমি জাতির জনকের কন্যা। কাজেই আমাকে কী করে আটকানো যায়? আমি ছিলাম প্রধানমন্ত্রী। চারবার সংসদ সদস্য ছিলাম। এছাড়া গণতন্ত্রের জন্য, জনগণের মৌলিক অধিকারের জন্য আমি সংগ্রাম করেছি। জনগণের জন্যই আমি আত্মনিবেদিত। জনগণের সঙ্গেই আমি বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছি- কাজেই আমাকে তারা আটকায় কীভাবে? আমি ওটা মানতে পারিনি।” (তথ্যসূত্র : দৈনিক সমকাল, ২৮ এপ্রিল ২০০৭)
শেখ হাসিনাকে ফিরতে না দেওয়ায় সারা পৃথিবীতে ভীষণ রকমের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। শুধু ২২ এপ্রিল দিনটাতে রোববার বিশ্বের ৪১টি দেশের ১৫১টি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক শেখ হাসিনাকে ফিরতে না দেওয়া সম্পর্কিত রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। ২০০৭ সালে ইয়াজউদ্দিন, ফখরুদ্দীন, মঈনউদ্দিন তত্ত্বাধায়ক সরকার ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে আর তার ৬৯ দিন পর খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে। খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের দুঃশাসন, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের অংশীদার তো শেখ হাসিনা নন। শেখ হাসিনা তো তাদের ষড়যন্ত্রে গ্রেনেড হামলায় মরতে মরতেই বেঁচে গেছেন। সুতরাং নির্যাতনকারী ও নির্যাতনভোগীকে কেন এক পাল্লায় তোলা হয়েছিল। নাইকোর সাথে শেখ হাসিনার সরকারের কোনো চুক্তি হয়নি; চুক্তি হয়েছিল খালেদা জিয়ার সরকারের সময়ে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলা দেওয়া হয়েছিল? আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কতটা উপলব্ধি করেন, তা মাঝে মাঝে বুঝতে কষ্ট হয়।
চার
এখনকার আওয়ামী লীগ নিয়ে আওয়ামী সমর্থকদের মধ্যে বেশ খানিকটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা যায়। যখন সুনামগঞ্জের সালনাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সেই সংখ্যাধিক্য হওয়ার পরও প্রশাসনের নিদারুণ ব্যর্থতার কারণে হামলার শিকার হয়। সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নিশ্চুপ থাকে; আবার তাদের ছত্রছায়ায় হামলাকারীরা পার পেয়ে যায় সেখানে বাংলাদেশে আওয়ামী সমথর্করা নিদারুণ কষ্ট পায়। আবার সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও হিন্দু পল্লিতে হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত পুলিশ হামলায় এখন পর্যন্ত ২৩ জনকে আটক করা হয়। ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরে রামুতে বৌদ্ধ পল্লিতে হামলার ঘটনা ঘটে। প্রায় ৯ বছর পার হলেও কোনো বিচার এখনও হয়নি। ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু বসতিতে হামলার তদন্ত প্রায় পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি। রংপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ভোলায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার তদন্ত শেষ হয়নি। এতদিন ছিল ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হামলা। আর সুনামঞ্জের ঘটনায় দেখা গেল হেফাজত নেতা মামুনুল হকের সমালোচনা করায় হামলা। এর সাথে ধর্ম অবমাননার কী সম্পর্ক আছে? আর মামুনুল হক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ছুড়ে ফেলার কথা বলেছেন।
আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম।” আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকরা মনে করেন ঢাকায় থেকে আওয়ামী লীগ পরিচালনা করেন তাদের কতজন এটা বিশ্বাস করেন। এবারের হেফাজত কাণ্ড না হলে বোঝাই যেত না আওয়ামী লীগের ভিতরে সর্বস্তরে আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তির আদর্শ ধারণ করা মতলববাজরা বাসা বেঁধে বসেছে। শেখ হাসিনা হচ্ছেন বাঙালি জাতির বিকল্পহীন অবলম্বন। তিনি দেশে ফিরে না আসলে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিচারও হতো না, যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারও করা যেতো না। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে কোন শক্তি ক্ষমতায় আসবে সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা কর্মীরা যেন সময় থাকতে সজাগ হন ।
লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক
সৌজন্যেঃ জাগোনিউজ২৪