4899
Published on মার্চ 21, 2021১৯৭১ সাল। বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, তখন পড়শি দেশ হিসেবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ভারত। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের প্রতি ভারতের সরকার ও গণমানুষের সহযোগিতার ইতিহাস তাৎপর্যপূর্ণ। সেসময় প্রায় এক কোটি মানুষ প্রাণের তাগিদে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেয় ভারতে। শুধু তাই নয়, ভারত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়ে আমাদের স্বাধীনতার রক্তাস্নাত যুদ্ধে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের মাটি এবং মানুষ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয় বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে। ভারত সরকার একদিকে যেমন আশ্রয় দিয়েছিলেন শরণার্থীদের, অন্যদিকে তাদের রাজ্যের বিভিন্ন স্থান পরিণত হয়েছিল মুক্তিফৌজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। এভাবেই একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখতে শুরু করে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত পৃথিবীর মধ্যে পঞ্চম বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সীমান্ত। বর্বর পাকিস্তানিদের সেনা অভিযানে বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশত্যাগীদের সিংহভাগই ঢুকে পড়ে ভারতে। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বিভিন্ন রাজ্যে সর্বমোট ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জন শরণার্থী প্রবেশ করেন। বিপুল এই ছিন্নমূল মানুষের দায়িত্ব নিতে হয় ভারত সরকারকে। ভারতের সাধারণ মানুষ ও সরকারের জন্য এটা ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তারপরও মানবিক সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছিল তারা আমাদের দিকে।
প্রায় ১৪ হাজারের অধিক ভারতীয় জওয়ান বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামে জীবন দিয়েছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে প্রশিক্ষণ নিন এবং অবশেষে বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। ইতিহাসে যার যতটুকু ভূমিকা স্বীকার করা ও স্মরণে রাখা প্রয়োজন।
১৯৭১ সালের যুদ্ধচলাকালে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কোর্ট মার্শালে বিচারের আয়োজন করেছিল জান্তারা। কিন্তু তা প্রতিহত করতে তৎকালীন ভারত সরকার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, তা ইতিহাসে বিরল।
ভারত সরকার পাকিস্তানবদের এই নাটকীয় কোর্ট মার্শাল নিয়ে ১০ আগস্ট ১৯৭১ জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টকে যে বার্তা প্রেরণ করে, তার ভাষান্তরিত রূপ হলো : “আগামীকাল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হতে যাচ্ছে। রাওয়ালপিন্ডির এই ঘোষণায় আমরা বিপন্ন ও বিস্মিতবোধ করছি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক বিবৃতির প্রাক্কালে ‘শেখ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং রাষ্ট্রদ্রোহী কাজে লিপ্ত হয়েছেন’ এই অজুহাতে বিচার করতে যাচ্ছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের অবিসংবাদিত নেতা, তাদের অত্যন্ত প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয়। ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে নির্বাচনে এমন অভূতপূর্ণ বিজয় সম্প্রতি পৃথিবীর আর কোথায় ঘটেনি। পূর্ববাংলায় পাকিস্তান সরকারের অভিযানে আমাদের জন্য যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও ব্যক্তির ওপর চূড়ান্ত কিছু ঘটলে এই সংকটের তীব্রতা ১০ গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে আমাদের জনগণ, গণমাধ্যম, পার্লামেন্ট এবং সরকার মনে করে। আপনার মহানুভবতার কাছে আমাদের আবেদন, অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করে পাকিস্তান সরকারকে বলুন তারা যেন এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ না করেন, যা তাদের ও আমাদের সংকটকে আরও তীব্র করে তুলবে। যদি তারা মুজিবের কিছু করে তার পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর ও দুর্বিষহ।”
আরেকটি বিষয় এখানে ইতিহাসের পাদটীকা হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি ও বাংলাদেশের জনযুদ্ধের বিজয়ে যে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন তা একটু বিস্তারিত জানানো দরকার। ভারতীয় পার্লামেন্টে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, পাকিস্তানের মিত্রদের প্রস্তাবিত কিছু প্রান্তিক উদ্যোগ যে সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হতে বাধ্য তা সাধারণভাবে পশ্চিমা বিশ্বের সিভিল সোসাইটি এবং জনমত বুঝতে পেরেছে। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “ঐসব দেশের নেতৃবৃন্দের অনেকেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন যে, বাংলাদেশের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক উদ্যোগ কেবল ঐ সংকট সমাধানের একমাত্র পথ এবং এ জন্যে The Release of Sheikh Mujib is essential.” তিনি আরও বলেন, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে এটা এখন স্পষ্ট যে, বিষয়টি আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয় কিংবা ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক ইস্যুও নয়। কারণ : Pakistan efforts to side-track and could the basic issue by seeking to involve the United Nation and to transform the struggle of the people of Bangladesh into an Indo-Pakistan confrontation and conflict have been exposed.”
তিনি বলেছিলেন, আমরা আন্তর্জাতিক বিশ্বে সহানুভূতি ও সমর্থন পেতে পারি তবে সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের তাদের ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না; বরং বাংলাদেশকে নিজের শক্তিতে স্বাধীনতার অর্জন করতে হবে এবং ভারত পূর্ণ শক্তি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর এই বিশ্লেষণ যথার্থ ছিল। কারণ ১৯৭১-এর বাংলাদেশের বাঙালিদের সামাজিক ঐক্য পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা সম্মিলিত স্রোতের চেয়ে বেগবান এবং এই জনযুদ্ধের বিজয় তাই অনিবার্য। ১৫ নভেম্বর ১৯৭১, Newsweek-এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনযুদ্ধ যে ন্যায়সংগত, গণতান্ত্রিক এবং একটি পরিপূর্ণ সংগ্রাম তারই একটি সংক্ষিপ্ত অথচ চিত্তাকর্ষক বিবরণ দিয়েছিলেন। এই পরিসরে সেটার কিছুটা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
“As you know, the majority of the guerrillas are the para-military force of East Bengal. ... And they are the ones who are training new people... the Pakistani Army will have to kill all the 75 million people in East Bengal Before they can have control over them. ... And I have absolutely no hesitation in saying that if I were placed in a situation like the Bengalis, I certainly would fight.”
ইন্দিরা গান্ধী সর্বশেষ পশ্চিম জার্মানির বনস্থ বিথোভেন হলে এই বক্তৃতায় বাংলাদেশের ওপর আমরা কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেই না কিংবা তাদের কোনো পরামর্শও দিতে পারি না। তিনি বলেন, ভারতের পক্ষে তিনি যদি ইয়াহিয়ার সাথে বাংলাদেশকে আপস করার পরামর্শও দেই, তারা তা কেন গ্রহণ করবে? সর্বোপরি ইতিহাসের পরিবর্তনের মুহূর্তে ইন্দিরা গান্ধী দলমত নির্বিশেষে তার দেশের সমগ্র জনতার সমর্থন পেয়েছিলেন। বামপন্থী, মধ্যপন্থী ও দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতা ও সংসদ সদস্য একযোগে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। যেমন- গোয়ালিয়র থেকে নির্বাচিত জনসংঘ (বর্তমানে বিজেপি)-এর সংসদ সদস্য অটল বিহারী বাজপেয়ী ৬ ডিসেম্বর লোকসভায় তার ভাষণে যা উল্লেখ করেছিলেন সেটির জন্য বাংলাদেশ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে দ্বিধান্বিত হয়নি। ২০১৫ সালের ৭ জুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতার লড়াইয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে অনন্য ভূমিকার কথা স্মরণ করে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিজেপি নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ীকে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ দিয়েছিল। আমাদের স্মরণে রাখা দরকার, ভারতের লোকসভায় অটল বিহারী বাজপেয়ী বলেছিলেন, “স্পিকার মহাশয়, দেরিতেই হোক না কেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি সঠিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নিয়তি এই সংসদ, এই দেশকে এমন গুরুত্বপূর্ণ কালপর্যায়ে এনে উপস্থিত করেছে যখন আমরা মুক্তিসংগ্রামে আত্মহুতি দানকারী লোকদের সমভিব্যাহারে যুদ্ধ করছি, আমরা কিন্তু ইতিহাসের গতির নতুন দিকনির্দেশের জন্যও সচেষ্ট রয়েছি।... আমি মনে করি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী সত্যি ধন্যবাদের পাত্রী।”
একাত্তরে ভারত আভাস দিয়েছিল যে, সীমান্তের ওপারের মানুষ এপাড়ের মানুষগুলোর সঙ্গে একাত্ম। এ আভাস মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। ভারতের মানুষ বিভিন্ন রসদ জোগান দিয়েছিল সেটি শুধু মুক্তিসেনাদের উৎসাহিত করেনি বরং তাদের বাহুতে নতুন করে বল সংযোজিত হয়েছিল। ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত রসদ পাঠানো হয়েছিল। ভারতের শরণার্থী শিবিরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র, আহতদের রক্তদানের ব্যবস্থা করতে কোনো প্রকার কাল বিলম্ব করা হয়নি।
শুরুর দিকে একটু কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে শরণার্থীদের জন্য সুসময় আসতে থাকে। প্রতিটি শরণার্থীকে কলেরা ভ্যাকসিন, মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট, দুধ এবং সবচেয়ে বড়ো যেটা দু’বেলা পেটপুরে ভাতের জোগান দেওয়া হয়েছিল।
ইন্দিরা গান্ধী ৩১ অক্টোবর ১৯৭১ সালে লন্ডনে বলেছিলেন : ‘শরণার্থী সমস্যা ছোট করে দেখার উপায় নেই। বাংলাদেশের সমস্যা শুধু শরণার্থী সমস্যা নয়, বরং এরচেয়ে অনেক গভীর। ভারতের জন্য শরণার্থী সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক নয় বরং এটা ভারতের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার জন্য বিরাট হুমকি। শরণার্থীদের ওপর যে বর্বরোচিত নির্যাতন হচ্ছে বিশ্ব তা জানে না, কিন্তু প্রতিদিন শরণার্থীরা ভারতে আসছে। মানুষ আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, কতদিন এই ভার আমরা বহন করতে পারব? আমি বলছি, সেই সময় পেরিয়ে গেছে। আমরা আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছি, জানি না কখন সেটা উদগীরণ শুরু করবে? আমরা সংযত, কিন্তু কতটা সংযত থাকব বিষয়টি নির্ভর করছে, সীমান্তে কী ঘটছে এর ওপর। আমরা মনে করি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব এর সমাধান খুঁজে বের করা। সবচেয়ে ভালো হয় এবং সেটা মানবিক, তাহলো এর রাজনৌতিক সমাধান বা বাংলাদেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
শরতের শুরুতে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পক্ষে আক্রমণাত্মক কূটনৈতিক সফরে পশ্চিমা বিশ্বে যান এবং যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সকে পক্ষে আনতে সমর্থ হন। এই দুই রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য এবং মার্কিন বলয়ের, কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে এরা ভারতকে সমর্থন দেয়। ওই সময় ইন্দিরা গান্ধীর বিরাট কূটনৈতিক বিজয় ছিল, ৯ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ২০ বছর মেয়াদি ‘বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি’। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটা ছিল একটি বড় আঘাত। এর ফলে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে চীনের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা কমে যায়। চীন তখন পাকিস্তানকে নৈতিক সমর্থন বা সামান্য সামরিক সাহায্য দিলেও ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটায়নি। ইন্দিরা গান্ধী ওয়াশিংটন সফর করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাকে ততটা আমলে নেননি। হোয়াইট হাইসের ‘রোজ গর্ডেনে’ বসেই ইন্দিরা গান্ধী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন যে, আমেরিকা না চাইলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। ইন্দিরা গান্ধীর জীবনী ‘মাই ট্রুথ’ গ্রন্থে বাংলাদেশের ঘটনাবলি বিশদ বিবৃত আছে।
২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে পূর্ণ সমর্থন দেন। শরণার্থীদের আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়। পশ্চিমবাংলা, বিহার, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা সীমান্তে শরণার্থী শিবির খোলা হয়। নির্বাসিত বাংলাদেশি সেনা অফিসার ও স্বেচ্ছাসেবীরা ওইসব ক্যাম্প থেকে মুক্তিবাহিনীর সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ কাজে নিয়োজিত হয়। ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকব এক ইন্টারভিউতে বলেছেন, বেসরকারিভাবে ভারত এপ্রিল মাস থেকে বাংলাদেশে জড়িয়ে যায়, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে সেটা ঘটে অনেক পরে। তিনি জানান, এপ্রিল থেকেই ভারত মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং দিতে শুরু করে। জেনারেল জ্যাকব আরো বলেন, এটা ছিল বাংলাদেশের ফাইট, ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে ভালোবেসে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, আমরা পাশে ছিলাম।
ভারতের রাজ্যসভা ও লোকসভা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রশ্নে যৌথভাবে অধিবেশনে বসেছে। এটা প্রমাণ করে যে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা বাংলাদেশকে সমর্থন প্রদানে কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, যেমন- ৩১ মার্চ ১৯৭১, রাজ্যসভা ও লোকসভায় ‘Recent Development in East Bengal’ শিরোনামে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন ইন্দিরা গান্ধী এবং উভয় সভায় প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। একইভাবে ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, রাজ্যসভা ও লোকসভার আরেকটি যৌথসভা বসে, সেখানে “Statement by Prime Minister Re : Recognition of Bangladesh.” ৩ ডিসেম্বর লোকসভায় জরুরি অবস্থা ঘোষণাবিষয়ক প্রস্তাব পাস করে। এই প্রস্তাব উত্থাপনকালে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তার বক্তৃতায় বলেন, “We have stood for peace, but peace itself has to be defended.” আগেই বলা হয়েছে যে, ভারতীয় রাজ্যসভা ও লোকসভায় ইন্দিরা গান্ধীর প্রদত্ত বক্তৃতার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ ঘোষণা ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান। তিনি ৬ ডিসেম্বর তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে নিম্নোক্ত ঘোষণা প্রদান করেন :
“I am glad to inform the House that in light of the existing situation and in response to the repeated requests of the Government of Bangladesh the Government of India have after the most careful consideration, decided to grant recognition to the GANA PRAJATANTRI BANGLADESH.”
সেদিনকার বক্তৃতায় তিনি আরও বলেছিলেন, আমাদের চিন্তা এবং যাবতীয় কর্মকাণ্ড এ-মুহূর্তে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের (Father of New State) সাথে রয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় যে, ৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের জাতির পিতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ভারতে ঐ উপাধি তার পিতা জওহরলাল নেহরুরও ছিল না। কারণ ভারতের জাতির পিতা হচ্ছে মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী। ৬ নভেম্বর ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় তার নিজের চেয়ে, বঙ্গবন্ধুকে জনগণের কাছে বিশাল জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিহিত করেন। তার মতে, “I am congratulated on my great majority. But it was nothing compared to the majority which Sheikh Mujibur Rahman gained in the election in Pakistan. It was a tremendous victory for him. And he is not an extremist. He was a moderate person.”
বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে কিন্তু ক্ষমতা পায় না। পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন শুরু হয়। ২৫ মার্চ ১৯৭১ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পাকিস্তান গণহত্যা শুরু করলে একইদিন দিবাগত রাতে (২৬ মার্চ ১৯৭১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন। তাকে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান ২৬ মার্চ প্রথম রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু। পাকিস্তান গণহত্যা চালায়। ভারত সীমান্ত খুলে দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়ায় এবং মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সেই শুরু। ভারত-পাকিস্তান শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে এ সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। তিনি হিসাব করেন যে, এই বিপুল শরণার্থীর ভার বহনের চেয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে খরচ কম হবে। ফলে ভারত মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তান অকস্মাৎ ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। ভারত পাল্টা আঘাত হানে। শুরু হয় আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ। তিনটি ভারতীয় কর্পস তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করে, সঙ্গে প্রায় তিন ব্রিগেড মুক্তিবাহিনী। ভারতীয় বিমান বাহিনী এক সপ্তাহের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের আকাশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। পশ্চিমেও প্রায় একই অবস্থা, ভারতীয় নেভি একই সময়ে প্রায় অর্ধেক পাকিস্তানি নৌবহর ও ট্যাঙ্কার ধ্বংস করে। জাতিসংঘে বারবার যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব সোভিয়েত ভেটোতে বানচাল হয়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে পাকিস্তান ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ করে। পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারত সর্বাত্মক সুবিধাজনক অবস্থায় থাকার পরও ইন্দিরা গান্ধী একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। যুদ্ধ শেষ। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে আত্মসমর্পণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একসঙ্গে এত সৈন্যের আত্মসমর্পণ এই প্রথম। লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী এতে স্বাক্ষর করেন। পৃথিবীর বুকে ৭ম জনবহুল ও ৪র্থ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র বাংলাদেশ জন্ম নেয়। পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে পাকিস্তানিরা স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে।
ইন্দিরা গান্ধী ও বিশ্ব নেতাদের চাপে পাকিস্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়। তিনি ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ দেশে ফিরে আসেন। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। বাংলাদেশ জাতিসংঘে সদস্যপদ চায় কিন্তু চীনের ভেটোতে সেটা হয় না। বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করে যে, দখলদার পাকিস্তান বাহিনী ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছে এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত কেড়ে নিয়েছে। পাকিস্তানের জন্য এই পরাজয় ছিল অবমাননাকর ও লজ্জাজনক। পাকিস্তান তার অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা হারায়। টু-নেশান থিওরি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। পাকিস্তান এক-তৃতীয়াংশ সৈন্য, এক-চতুর্থাংশ বিমান বাহিনী এবং অর্ধেক নেভির শক্তি হারায়। ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের অবসান ঘটে। জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতাসীন হন। ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তি হয়। ভারত যুদ্ধবন্দিদের ১৯২৫ সালের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তদারকি করে। ৯৩ হাজার বন্দিকে মুক্তি দেয়, এমনকি যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ২০০ সেনাকেও ক্ষমা করে দেয়। একই সঙ্গে পশ্চিম রণাঙ্গনে দখলকৃত ১৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার ভূমি ফেরত দিয়ে দেয়। এই বিশাল পরাজয়ের গ্লানি ঘুচাতে এবং আর একটি ভারতীয় আক্রমণ ঠেকাতে ভুট্টো পারমাণবিক বোমা কর্মসূচিতে হাত দেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এটা সবারই প্রত্যাশা ছিল যে বাংলাদেশ ও ভারতের পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে দুটো দেশই এগিয়ে যাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শান্তির পথে। সত্যি সত্যি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দুই দেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছিল। একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টা বেশ পরিষ্কার হয়ে যাবে, ১৯৭২-৭৩ সালে শুধু খাদ্য বা ভোগ্যপণ্য নয়, পরিবহন যোগাযোগ-ব্যবস্থার মেরামত ও পুনর্গঠনের জন্য এবং শিল্প-কারখানায় কাঁচামাল সরবরাহেও ভারত ব্যাপক সহায়তা প্রদান করে। ভারত নিজে তেলের আমদানিকারক হয়েও বাংলাদেশের জ্বালানি তেল শোধনাগারের (রিফাইনারি) জন্য অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করে জরুরি সহায়তা করেছিল। ভারত বেসামরিক বিমান ও জাহাজ সরবরাহ করে। নতুন দেশটির জন্য সবচেয়ে জরুরি ছিল খাদ্য। ১৯৭২-এর শুরুতে বাংলাদেশ একদিকে যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতি এবং আরেক দিকে পরপর দুবার শস্যহানির কবলে পড়ে। ভারতে সহায়তা হিসেবে শুধু ৪ লাখ টন খাদ্যশস্যই দেয়নি, খাদ্যশস্য পরিবহনেও সহায়তা করে। প্রথম ছয় মাসে মোট প্রাপ্ত খাদ্য সহায়তার ৭৪ শতাংশই ভারত দিয়েছিল। ১৯৭১-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২-এর জুনের মধ্যে ২০ কোটি মার্কিন ডলার দান হিসেবে এবং পণ্য আমদানি ও প্রকল্পের জন্য অত্যন্ত সহজ শর্তে ৪.২ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করে। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪-৭৫ সময়ে ভারত ৩০.৮ কোটি মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫৭.৭ কোটি মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তার পর দাতাদের মধ্যে এটাই ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সহায়তা।
ভারতের সর্বস্তরের মানুষ তথা রাজনীতিবিদ, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, আইনজীবী, গৃহিনী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ শ্রমজীবী যারা ইতিহাসের যুগ-সন্ধিক্ষণে নিজেদের আবেগ ও যুক্তিতে বরণ করে নিয়েছিলেন এক কোটি শরনার্থী, একাত্ম হয়েছিলেন পরম বন্ধু হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাতারে। নিজেদের দেশ থেকে বিতারিত হয়ে আসা বিবর্ণ মুখগুলোর জন্য ভারতের সাধারণ মানুষের ভালবাসা ছিল সীমাহীন। মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বাংলাদেশের মাটি, রচিত হয়েছে আরেক অমচোনীয় ইতিহাস। এসব ঘটনাবর্তে মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের সকল স্তরের মানুষের অবদান বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কখনও ওষুধ, কখনও খাদ্য কিংবা কখনও সেবার মাধ্যমে বুকভরা ভালবাসা দিয়ে ভারতের মানুষ যে ঋণের জালে আবদ্ধ করেছে, তা বোধকরি কোন দিন ভুলতে পারবে না বাংলাদেশের মানুষ।