আত্মত্যাগী বঙ্গবন্ধু ও আত্মঘাতী বাঙালি

2583

Published on মার্চ 14, 2021
  • Details Image

মেহেদি আরিফঃ

বাঙালি জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম রাজা শশাঙ্কের সময় থেকে শুরু হয়ে শেখ মুজিব পর্যন্ত চলেছিল। কিন্তু এ সংগ্রামে মুজিব ব্যতীত তারা কেউ সফল হতে পারেননি। কারণ তারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পাল রাজারাও রাষ্ট্র গঠন করতে পারেননি। গৌড়ের সুলতান বাঙালি জাতিকে একটি রূপ দিতে কিছুটা সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু পুরোপুরি একটা স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। আর মোগল সম্রাটরা বাঙালির উপর ফার্সি ও ইংরেজরা ইংরেজি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা যেমন সেনদের সংস্কৃত ভাষা গ্রহণ করেনি, তেমনি গ্রহণ করেনি মোগলদের ফার্সি ও ইংরেজদের ইংরেজি ভাষাকেও। তাই আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শশাঙ্ক থেকে সিরাজউদ্দৌলা এবং সিরাজউদ্দৌলা থেকে মুজিব পর্যন্ত চলে। জাতি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আবুল কাশেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী বিশেষ ভূমিকা পালন করলেও, বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন জাতীয়তাবাদের আন্দোলন চললেও- বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনের পূর্ণতা ও সফল পরিণতি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু মাত্র ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন। আসলে বেঁচে ছিলেন বললে ভুল হবে, বলা উচিত আমরা তাকে বাঁচতে দিয়েছিলাম। এ ৫৫ বছর অর্থাৎ দিনের হিসেবে ২০ হাজার ২৩৮ দিনের ক্ষুদ্রজীবনে তিনি জেলের ভেতরেই ছিলেন ৪ হাজার ৬৮২ দিন। তার সমগ্র জীবনের প্রায় এক চতুর্থাংশ তিনি জেলে বন্দি ছিলেন। একজন মানুষের জীবনের যে সময়টা সবচেয়ে উপভোগ্য সে সময়কাল তিনি অতিবাহিত করেছেন কারাগারে। আমাদের কি কখনো ভেবে দেখার সময় হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে কী কারণে এতদিন জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি থাকতে হয়েছে?

তিনি কি অন্যায়ভাবে নিজের ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে বছরের পর বছর জেল খেটেছেন? না। তিনি নিজের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে জেল খাটেন নি। তাহলে কেনো তাকে বারবার জেলে ঢুকতে হয়েছে, সইতে হয়েছে নিযার্তন, থাকতে হয়েছে পরিবার থেকে দূরে? বঙ্গবন্ধুর সন্তানরা তাদের বাবাকে কাছে পেতেন না বললেই চলে। যা একটু দেখা হতো সেটাও জেল গেইটে অথবা সামান্য কিছুসময়ের জন্য বাড়িতে যখন থাকতেন তখন। তিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন অভাগা বাঙালি জাতিকে মুক্ত ও স্বাধীন করার জন্য। আর তার এই ত্যাগের প্রতিদানে আমরা তার বুকে সৃষ্টি করেছি আঠারটি গভীর ক্ষত, নিহত হয়েছেন সপরিবারে। প্রত্যেকটি বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস। কোনও বাঙালি তাকে হত্যা করবে একথা তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি। এজন্য অনেকে বারবার সতর্ক করার পরেও তিনি গণভবনে থাকেননি। থেকেছেন ন্যূনতম নিরাপত্তাহীন ৩২ নং রাস্তার ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে। কারণ এ বাড়িতে যেকোনও মানুষ যেকোনও সময় অবাধে আসা যাওয়া করতে পারতো। গণভবনে থাকলে যা সম্ভব ছিল না। তিনি মানুষের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এত কম নিরাপত্তা নিয়ে কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বসবাস করার নজির নেই বললেই চলে। কিন্তু আমরা তার এ অকৃত্রিম বিশ্বাসের প্রতিদান দিয়েছি বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, ক্ষতি কিন্তু আমাদেরই হয়েছে। পঁচাত্তরের পরে বাংলাদেশ একটি অরাজক, বিশৃঙ্খল ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিচিত হয়। যে বাকশাল ব্যবস্থার দোহাই দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল ঘাতকরা ক্ষমতায় এসে কিন্তু সেই বাকশাল ব্যবস্থা বাতিল করেন নি। এ সময় দেশে হয়েছে অসংখ্য ক্যু, রাজনৈতিক হত্যা ও নির্যাতন অন্যায়-অবিচার। প্রহসনের বিচার করে অসংখ্য সামরিক বাহিনীর সেনা ও কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কারণ হিসেবে তারা বলেছিল- বঙ্গবন্ধুর তথাকথিত ‘দুর্নীতি’ ও ‘স্বৈরাচারিতা’র কথা। কিন্তু শিশু শেখ রাসেলসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের কি দোষ ছিল? তাদের কেন হত্যা করা হল? এসব প্রশ্নের জবাব ঘাতকরা দিতে পারেনি আর কোনদিন পারবেও না। আসলে এই হত্যাকাণ্ড আকস্মিকভাবে ঘটা কতিপয় বিপথগামী কোনো সেনা সদস্যের দ্বারা সংগঠিত ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে দেশি-বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র। যেখানে জড়িত ছিল স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানপন্থি দেশি-বিদেশি কতিপয় মহল। যারা বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমহলে পরিচিত করে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চাইতো।

পাকিস্তান থেকে মুক্ত হওয়ার পর তার স্বপ্নের বাংলাদেশে ফিরলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এখন তার ভূমিকা আর আন্দোলনকারীর নয়, এখন ভূমিকা যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন ’সোনার বাংলার’, তা পূরণ করার। তার ’সোনার বাংলা’ তখন একেবারে বিধ্বস্ত। অনেকে ভেবেছিলেন, ভারতের গান্ধী বা চীনের মাও সে-তুংয়ের মতো তিনি আর রাষ্ট্র পরিচালনার ভার নেবেন না, কারণ তিনি তো তখন আর দলীয় নেতা নন, তিনি বাংলাদেশের । কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবেই দায়িত্ব নিলেন। কারণ শেখ মুজিব ছিলেন কাজের লোক, চ্যালেঞ্জ নেওয়ার লোক । চ্যালেঞ্জিং কাজ করতে তিনি পছন্দ করতেন। দেশের বিপদে দেশ গড়ার মত এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা সময় ঘরে বসে থাকার মতো লোক তিনি নন। তার সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল।

যেমন- মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার ও মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন করা; শহীদ ও আহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারবর্গকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া; মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দালালদের আটক করে বিচারের সম্মুখীন করা; পাকিস্তানে আটক প্রায় ৪ লাখ বাঙালিকে ফিরিয়ে আনা; বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় সোয়া লাখ ভারতীয় সেনাকে ভারতে ফেরত পাঠানো; স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি লাভ করা; জাতিসংঘসহ সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ অর্জন করা; যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য আর্ন্তজাতিক অনুদান লাভ করা; বাংলাদেশকে ঘিরে সৃষ্ট আর্ন্তজাতিক চক্রান্ত; মুক্তিযুদ্ধেও চেতনা বিনাশের ষড়যন্ত্র ইত্যাদি মোকাবলা করা। সর্বোপরি, দেশের জনগণের আকাশচুম্বী আশা-আকাঙক্ষার বাস্তবায়ন করা।

বঙ্গবন্ধুর শাসনামল মাত্র তিন বছর ৭ মাস ৩ দিন স্থায়ী ছিল। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন করার জন্য যে সময় প্রয়োজন আমরা তাকে সময় দেয়নি। এ ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যেও এমন কোন সেক্টর পাওয়া যাবে না, সে সেক্টরে তিনি কাজ শুরু করেননি। বঙ্গবন্ধুকে আর কিছুদিন সময় দিলে বাংলাদেশ হয়তো আজকে বিশ্বেও দরবারে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যেত।

মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন গ্রুপে, দলে, সেক্টরে ভাগ হয়ে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের ছিল বিভিন্ন ধারা । এ বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে স্বাধীনতার পরও অস্ত্র থেকে গিয়েছিল। এসব অস্ত্র যেকোনও দেশের জন্যই ভয়ানক হুমকি, বিশেষ করে নব্য স্বাধীন দেশের জন্য। এজন্য নতুন সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল অস্ত্রগুলো ফিরিয়ে নেওয়া। এই কঠিন কাজটি বঙ্গবন্ধু খুব সুনিপুণভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। কারণ শেখ মুজিব ছাড়া এমন কোন ব্যক্তি এদেশে ছিল না যার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সবাই অস্ত্র জমা দিবে। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা না নেওয়া পর্যন্ত দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন ছিল। বঙ্গবন্ধু ফেরার পর তার আহ্বানে সকল ঘরানার মুক্তিযোদ্ধরা তাদের অস্ত্র সর্মপণ করেন।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও দক্ষতার আরেকটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হল- দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সকল সেনাসদস্যকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে প্রত্যাহার করে নিতে ইন্দিরা সরকারকে রাজি করানো। এ থেকে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বে এক অসাধারণত্ব প্রকাশ পায়। যে ভারত ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের জন্য এতকিছু করলো, সে ভারতকে তিন মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল যা বিশ্বের সকল যুদ্ধের ইতিহাসেও একটি বিরল ঘটনা । কেননা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পঞ্চাশ বছর পরেও র্জামানির মাটিতে মার্কিন, সোভিয়েত, ব্রিটিশ ও ফরাসি সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিল। কোরিয় যুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরও দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন সেনা আর জাপানে এখনো মার্কিন সেনা অবস্থানের কথা উল্লেখ করা যায়। এদিক থেকে স্বাধীনতার মাত্র ৯০ দিনের মাথায় সদ্য স্বাধীন একটি দেশের মাটি থেকে বিদেশি একটি দেশের সৈন্য প্রত্যাহার করিয়ে নেওয়া বিরল এক ঘটনা।

১৯৭১ সনে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হলো তখন সমগ্র বাংলাদেশ একটা ধ্বংসস্তুপ ছিল। সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী বিগত নয় মাস ধরে বেতন পাননি। তাদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা ছিল, বিশাল বড় একটা চ্যালেঞ্জ। কৃষক-শ্রমিকের হাতেও কোন টাকা-পয়সা ছিল না। সারা দেশে ডাক বিভাগ ছিল বন্ধ, তার বিভাগ হয়ে পড়েছিল অচল, অসংখ্য কালভার্ট ব্রিজ-সেতু ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল বিধ্বস্ত । মাইন পোতার কারণে নৌবন্দরগুলি ছিল অচল। ব্যাংকগুলি ছিল বন্ধ এবং তহবিল শূন্য। রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, বাড়ি-ঘর, অফিস-আদালত সব ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছে হানাদার বাহিনীরা। সারা দেশে বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার দালালরা কয়েক লাখ হালের বলদ ও গাভী জবাই করে মাংস খেয়েছে। ফলে হালচাষের জন্য গবাদি পশুর সংকট দেখা দেয় । এসব সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে কৃষি ঋণ প্রদান, বীজ সংগ্রহ করা, গভীর ও অগভীর নলকূপ মেরামত বা পুনর্খনন করা, কয়েক লাখ গরু আমদানি করা ইত্যাদি বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষি পুনর্বাসন কাজ ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী প্রায় ১ কোটি শরণার্থী ও দেশের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তু হওয়া লাখ লাখ পরিবারকে পুনর্বাসনের এক কঠিন দায়িত্ব এসে যায় সরকারের সামনে। শিল্প উৎপাদন ছিল না বললেই চলে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম। চারদিকে শুধু অভাব আর অভাব, সবাই শুধু চায়- কিন্তু কোথা থেকে আসবে এটা ভাবে না। রাষ্ট্রীয় কোষাগার একদম খালি। কিন্তু মানুষের আকাঙক্ষা আকাশছোঁয়া। এই রকম হাজারো চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু মাত্র তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছরে এমন কোন সেক্টরে এমন কোন কাজ নেই যেটাতে হাত দেন নি। মাত্র নয় মাসে আমরা একটা আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ সংবিধান পেয়েছি, যেটা পাকিস্তানের পেতে সময় লেগেছিল নয় বছর আর ভারতের তিন বছর।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার কারণে বিজয় অর্জনের মাত্র তিন মাসের মাথায় ভারতীয় সেনারা এদেশ থেকে সুন্দরভাবে সসম্মানে ফিরে গিয়েছে। ক্ষমতা গ্রহণের ১০০ দিনের মধ্যে পাক হানাদার বাহিনীর আতঙ্কে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া এক কোটি শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে এনে সমালোচকদের গায়ে চপেটাঘাত করেন- যারা মনে করতো শেখ মুজিব কি ওইসব শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনতে পারবে? তাদের অধিকাংশ ছিল হিন্দু।

প্রতিদিন গড়ে এক লাখ শরণার্থী দেশে ফিরে আসে। বেশিরভাগই সরকারি যানবাহন ব্যবহার করে দেশে ফিরেছিল। এক বিস্ময়কর দ্রুততার সাথে এই কাজ সম্পন্ন করা হয়, যা ইতিহাসে বিরল। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির কারণে বাংলাদেশ সফলভাবে জাতিসংঘ, ওআইসি, আইএমএফ, ন্যামসহ সর্বমোট ১৬টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলাদেশের ১৩৬ তম সদস্যপদ লাভ ও ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষণ দেন। গুটি কয়েকদেশ যেমন: চীন, সৌদি আরব ছাড়া সকল দেশের স্বীকৃতি লাভ করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতি ছিল ’সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বৈরী মনোভাব নয়’। প্রথম তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ ৬৩টি দেশের স্বীকৃতি লাভ করে। ৩ মাস ২১ দিনের মধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় দুই বছর দুই মাসের মধ্যে। সর্বমোট ১২১টি দেশ স্বীকৃতি দেয়। এছাড়াও ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত হয় ২৫ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তি।

বঙ্গবন্ধুর ত্রুটি যারা খুঁজতে থাকেন তারা বারংবার বাকশালের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। বাকশাল নিয়ে এদেশে অনেক নেতিবাচক কথা প্রচলিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে তার সমকালীন জায়গা থেকে বুঝতে হলে তৎকালীন পরিস্থিতিতে বাকশাল গুরুত্ব বোঝা প্রয়োজন। বাকশাল বাংলাদেশকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দুয়ারে নিয়ে যাচ্ছিল।বাকশাল একদলীয় কোন শাসন ছিল না। বাকশাল ছিল স্বাধীনতার পক্ষের সকল দল নিয়ে গঠিত সর্বদলীয় শাসন। সেই সময়ের প্রেক্ষিতে বাকশাল সঠিক পদক্ষেপ ছিল। বাকশাল মাত্র ২৩২ দিনের ছিল। ২৩২ দিনে বাকশাল যা করেছিল তা লক্ষ্য করার মতো ছিল।

বঙ্গবন্ধুর বসার ভঙ্গিমা ও কথা বলার বাচনভঙ্গি এবং চলাফেরার ধরন ছিল অসাধারণ। যা সবাইকে মুগ্ধ করতো ও আকর্ষণ করতো। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ গুণ ছিল তিনি সবাইকে কাছে টেনে নিতেন এবং মন খুলে কথা বলতেন। ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুর হৃদয় ছিল খুব কোমল। ছোটবেলায় তিনি একবার গোপালগঞ্জে শীতের মধ্যে দেখেন, এক ছেলের গাড়ে কাপড় নেই। পরনে শতচ্ছিন্ন একটা লুঙ্গি। তিনি তখন নিজের গায়ের চাদর পরে নিয়ে ছেলেটাকে লুঙ্গি আর শার্ট দান করে দিয়েছিলেন। ছোটবেলায় দুর্ভিক্ষের সময় নিজের গোলার ধান দান করে দিতেন। সমিতি করে অন্যদের কাছ থেকেও ধানচাল সংগ্রহ করে গরিব শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিলি করতেন। কলকাতায় একবার এক বৃদ্ধাকে রাস্তার ধারে পড়ে থাকতে দেখে তিনি কোলে করে হাসপাতালে দিয়ে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তি ছিল তুলনাহীন । তিনি যাকে একবার দেখতেন, তাকেই মনে রাখতেন, বহু বছর পরে দেখা হলেও তার নাম ধরে ডাকতে পারতেন । তিনি যে বইগুলো লিখেছেন, সেগুলো লিখেছেন জেলখানায় বসে। হাতের কাছে কম্পিউটার ছিল না, কোনো নোটবই ছিল না। কিন্তু তিনি বহু বছর আগে দেখা তাজমহল বা চীন ভ্রমণের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, নজরুলের কবিতা তিনি মুখস্থ বলে দিতে পারতেন । এমনকি যৌবনে যাদের সাথে তার পরিচয় হয়েছে তাদেরও তিনি ভোলেননি।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সনে জানুয়ারির শেষদিকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকা ভারতীয় সাংবাদিক নিখিল চক্রবর্তীকে অবাক করে দিয়েছিলেন। তাদের দুজনের শেষ দেখা হয়েছিল ১৯৪৪ সনে। এরপর আর দেখা হয়নি। এবং চক্রবর্তী নিজেও ভেবেছিলেন যে বঙ্গবন্ধু তাকে চিনতে পারবেন না। কিন্তু তার ধারণা ভুল ছিল। বঙ্গবন্ধুর কক্ষে ঢোকার পরে যখন বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি ওই সাংবাদিকের উপর পড়েছিল। তখন তিনি তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ’তুমি নিখিল না’? বাকি বিষয় তো আর বলার দরকার নেই। বঙ্গবন্ধু অখ্যাত রাজনৈতিক কর্মীসহ সাধারণ মানুষ, কৃষক ও শ্রমিকদের নামও মনে রাখতে পারতেন এমন বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি লাখ লাখ মানুষের কাছে প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা কখনোই চিন্তা করেন নি। সম্পদ বলতে এক বাড়ি ছাড়া তার কিছুই ছিল না। তিনি ছিলেন নির্লোভ, নির্মোহ একজন মানুষ। ইচ্ছা করলে অনেক সম্পদের মালিক তিনি হতে পারতেন। আমরা জানি যে জাতির পিতা যখন জেলে থাকতেন তখন সংসার চালানোর জন্য বঙ্গমাতাকে প্রায়ই হিমসিম খেতে হতো। এমনকি তাকে স্বর্ণালংকার পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে। এ পরিবারের জীবন যাপন ছিল একদম সাদামাটা, কোন প্রকার বিলাসিতা বা আত্ম-অহংকার তাদের ছিলো না। সকল ধরনের মানুষের যাতায়াত ছিল ৩২ নম্বরে।

বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট একবার বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন- ’হোয়াট ইজ ইউর কোয়ালিফিকেশন’? বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে উত্তর দিয়েছিলেন, ’আই লাভ মাই পিপল’। তারপর ফ্রস্ট আবার প্রশ্ন করলেন, ’হোয়াট ইজ ইউর ডিসকোয়ালিফিকেশন’? বঙ্গবন্ধু বললেন, ’আই লাভ দেম টু মাচ’। বঙ্গবন্ধুর এ কথার মাধ্যমে বোঝা যায় যে তিনি মানুষকে কতটা ভালোবাসতেন। সাধারণ মানুষকে ভালোবাসতেন বলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্তুথশ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য ১৯৪৯ সনের ২৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এক চরমপত্র দেয়। তাকেসহ পাঁচজনকে পনের টাকা জরিমানা দিয়ে এবং অভিভাবক মারফত মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব রক্ষার জন্য বলা হয়। কিন্তু আজন্ম প্রতিবাদী ও আপসহীন বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সিদ্ধান্ত ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন । কিন্তু কর্মচারীদের দাবি আদায়ের আন্দোলন থেকে সরে না আসায় ১৯৪৯ সনের ১৮ এপ্রিল তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হিসেবে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “সাত কোটি বাঙালির ভালবাসার কাঙাল আমি। সব হারাতে পারি কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালবাসা হারাতে পারবো না। তিনি বলেছিলেন, “আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম, বলেছিলাম আমি বাঙালি আমি মানুষ, আমি মুসলমান। মুসলমান একবার মরে দুই বার মরে না। আমি বলেছিলাম আমার মৃত্যু আসে যদি আমি হাসতে হাসতে যাবো, আমার বাঙালি জাতকে অপমান করে যাবো না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না।”

বঙ্গবন্ধুকে শুধু “বঙ্গবন্ধু” বললে তিনি অপূর্ণ থেকে যান। তিনি ছিলেন বিশ্ব মানবতার বন্ধু। তিনি ছিলেন বিশ্ববন্ধু। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ বলেছিলেন, “পৃথিবীতে মানুষ যতদিন পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে ততদিন এই ভাষণ প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে। মানুষের সংগ্রাম আজও চলমান। শোষণের বিরুদ্ধে মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রাম যতদিন থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু উজ্জ্বল সূর্যের মত জ্বাজ্জল্যমান থাকবে।“

১৯৭৩ সনের ৯ সেপ্টেম্বর আলজিয়ার্স জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত। শাসক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।”

পৃথিবীতে যতদিন শোষণ থাকবে, শোষিত মানুষ থাকবে বঙ্গবন্ধু ততদিন প্রাসঙ্গিক থাকবেন

সৌজন্যেঃ bdnews24.com

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত