2457
Published on জানুয়ারি 5, 2021বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির অনেক আকাঙ্খিত সুসংবাদটি ঢাকায় পৌছলে গােটা বাংলাদেশে এক অবিস্মরণীয় অভূতপূর্ব আনন্দের হিল্লোল বইতে থাকে। স্বাধীন ভুমিতে বিজয়ের আনন্দ যেন তখন কানায় কানায় ভরে গেছে। অগণিত বাঙালি নরনারী অনিশ্চয়তার আবর্তে স্বস্তির সন্ধান পেল। অকূল পাথারে কূল খুঁজে পেল।
মুজিব নেই, বিজয়ী হয়েও এতদিন খুশি হতে পারে নি সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। মুজিব ছাড়া ষােলই ডিসেম্বরের বিজয়ের আনন্দ যেন অসম্পূর্ণ।
সন্তানহারা মায়ের বুকে শূন্যতার হাহাকার আছে। স্বামীহারা, ভাইবােন হারা, পিতামাতা হারা ঘরে ঘরে আছে ব্যথার ঝড় । ইজ্জত লুষ্ঠিত অবলা নারীর করুণ ক্রন্দনে সদ্য স্বাধীন স্বদেশের বাতাস আজ ভারি। তবু স্বান হারানাের সব ব্যথা বেদনাকে ছাপিয়েও এক অতলান্ত বিস্তৃত শূন্যতা সব বাঙালির হৃদয়কে অনির্বচনীয় বেদনাঘন অনুভূতিতে জর্জরিত করছিল।
যে মানুষটির ডাকে নিরস্ত্র বাঙালি জনগণ দুর্ধর্ষ পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যার নেতৃত্বের সম্মােহনে বাঙালি তরুণরা দুস্তর সাগর পাড়ি দিয়েছিল। অকুতােভয় নাবিকের মতাে যার আহ্বানে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে প্রতিরােধের দুর্গ গড়ে উঠেছিল, যিনি লাখ লাখ বাঙালিকে শত ভ্রকুটি বাধার মুখে দেশ মাতৃকার মুক্তির বেদীমূলে আত্মবলিদানে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, নিরাপস আজীবন সংগ্রামী বাঙালিরা স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক, বিজয়ের নিপুণ ভাস্কর শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেয়েছেন।
তিনি যে বাংলার স্পন্দনের আত্মার সত্তার প্রতীক্ষা। বাঙালির অত্যন্ত আপনজন, কাছের মানুষ শেখ মুজিব।
পাকিস্তানের কারগার থেকে যে মুজিব মুক্ত হয়ে তার স্বপ্নের বাংলায় ফিরে আসছেন তিনি যে বাঙালির ভালােবাসার কারাগারে বন্দী। তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার যেনাে কোন স্বাদ নেই, রস নেই, সুগন্ধ নেই, মুজিবের অনুপস্থিতিতে বিজয়ের সব আয়ােজনই যেন ফাঁকা ফাঁকা টানা দীর্ঘশ্বাসে ভরা। এখন মুক্তির সংবাদে যুদ্ধবিধ্বস্ত রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশের হৃদয়ে আনন্দ যেন আর ধরে না। শহরে বন্দরে হাঁটে-ঘাটে খুশির জোয়ার উপচে গিয়ে যেন আছড়ে আছড়ে পড়ছে।
সবে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা জাতীয় বীর শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় বিভাের। অধীর অপেক্ষা সারাদেশের সব শহর গায়ে রাস্তায় রাস্তায় নেমেছে খুশিতে আত্মহারা জনতার ঢল । শিশুরা আনন্দে নেচে নেচে ধ্বনি তুলছে জয় বাংলা, জয় শেখ মুজিব। সীমাহীন আনন্দ আজ মুক্তিযোদ্ধাদের। তাদের সংগ্রামের প্রেরণার উৎস শেখ মুজিব আসছেন শত্রুমুক্ত স্বদেশে। খুশিতে মুক্তিযােদ্ধারা আকাশে ফাঁকা গুলি ছুড়তে লাগলাে। কণ্ঠে জয়বাংলার ধ্বনি। দিকে দিকে মােহনীয় সুরের লহরী—আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালোবাসি। বাংলাদেশের সব রাস্তাই সেদিন ঢাকা অভিমুখী। প্রিয় নেতাকে একটু দেখবার জন্যে হৃদয়ের কত আকুতি বাঙালির।
ঢাকায় দলে দলে হর্ষোৎফুল্ল জনগণ শেখ মুজিবের বাড়ি অভিমুখে ছুটে চলছেন। ওখানে দীর্ঘ ন'টি মাস ছেলেমেয়েদের নিয়ে দুঃসহ অবরুদ্ধ জীবনের যাতনা সয়ে বেগম মুজিবও সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত প্রখ্যাত স্বামীর গৃহ প্রত্যাবর্তনের ব্যাকুল প্রতীক্ষায়। সেদিন রােজা করেছেন, মুজিব পত্নী। ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর। বেগম মুজিবের গণ্ড বেয়ে নেমে আসছে অফুরান আনন্দাশ্রুর ধারা।
রক্তের দাগ, ধ্বংসের চিহ্ন সর্বত্র। ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ সব শহরগুলিকে দেখতে মনে হচ্ছিল পরমাণু বােমা হামলায় বিধ্বস্ত ভয়াবহ বিস্তৃত ধ্বংসাবশেষের মতাে। বিবেক বর্জিত পাশবিক অভিযানের দগদগে ঘা সব গাঁয়ে-জনপদে। কমপক্ষে ৬০ লাখ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান বাহিনী ও ওদের সহযােগীরা। এক কোটিরও বেশি লােক হয়েছে ঘরছাড়া। যুদ্ধের শেষ দিনগুলােতে কোটি কোটি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে দেয়া হয়েছে। বাকি যা ছিল তাও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যােগাযােগ ব্যবস্থাকে বিস্ফোরণে বিপর্যস্ত করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সব সেতু-রাস্তা ধ্বংস করেই ওরা ক্ষান্ত হয় নি। নৌচলাচলের রুটেও স্থাপন করে গিয়েছে বিপর্যয়কর ব্যারিকেড। বিশ্বব্যাংক পর্যবেক্ষক দলের সাম্প্রতিক এক রিপাের্টও তাে ঠিক একথাই বলে। ৯ই জানুয়ারি রাতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে একটা রােলস রয়েস গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হল লন্ডন শহরের অদূরে এক ব্রিটিশ বিমান ঘাঁটিতে। বিশেষ বিমান আর এ এফ কমেট বাংলাদেশের নেতাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে লন্ডন ত্যাগ করল। বিমানটি পথিমধ্যে একবার সাইপ্রাসের রাজধানী নিকোশিয়ায় অবতরণ করে। প্রয়ােজনীয় জ্বালানি সংগ্রহ করে আবার আকাশে। এরপর দিল্লীর পালাম বিমান বন্দরে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি। সেখানে অপেক্ষমাণ হাজার হাজার হর্যোৎফুল্ল ভারতীয় জনতা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বিজয়ী বীর শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ সম্পন্ন করে মুজিব এবার স্বদেশের রাজধানী ঢাকার উদ্দেশে।
শেখ মুজিব উদাস দৃষ্টি মেলে ধরেছেন বাইরে। শ্যামল দু'তীর বাঁধা একে বেঁকে বয়ে যাওয়া নদী। সবুজ বৃক্ষরাজি শােভিত চলমান মায়াবি গ্রামগুলাে। ধানী জমিনে শীতের তেজী রােদ খিলখিল হাসছে। ভারতের সীমানা পেরিয়ে বিমানটি স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশ সীমায় এসে গেছে। বিমান ক্রমেই নিম্নমুখী। অদূরে ঢাকা। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী।
মুজিবের পাশে এসে একজন পাইলট স্যালুট দিয়ে দাঁড়ালেন। মুখে স্মিত হাসি ফুটিয়ে বললেন, মিঃ প্রেসিডেন্ট, পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমরা ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করবাে। দয়া করে আপনার সিটবেল্ট বেঁধে ফেলুন।
শেখ মুজিবুর রহমানের কৌতূহলী চোখের সামনে তখন শীতের শান্ত নদী দিগন্ত বিস্তৃত হলুদ সর্ষেক্ষেত, ঝলমলে রােদুরে বাতাসে দোলায়মান ইক্ষুগাছের সবুজ পাতাগুলাে।