1909
Published on ডিসেম্বর 9, 2020'রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনে একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে দেখি, হলের পাশেই লাশের স্তূপে পড়ে আছি। তখন আসলে কী ভেবেছিলাম, মনে করতে পারব না। পরে বুঝতে পেরেছি, মরে গেছি ভেবে আমাকেও লাশের সঙ্গে ফেলে রেখে গেছে। তাকিয়ে দেখছিলাম, চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। রক্ত ও পচা গন্ধে দম বন্ধ যাওয়ার মতো অবস্থা।'
কথাগুলো বলছিলেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা আবদুল মান্নান সরকার। নগরীর বালিয়াপুকুর এলাকার বাসিন্দা তিনি। ৪৯ বছর আগের স্মৃতি হাতড়ে মান্নান সরকার বলেন, তখন তার বয়স ছিল ২১। রাজশাহীর বালিয়াপুকুর রণাঙ্গন এলাকাটি সুবেদার লস্কর বাহিনীর অধীনে ছিল। সুবেদার লস্করের অনুপ্রেরণায় তারই অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন মান্নান সরকার। মান্নান সরকারসহ প্রায় ৩০০ মুক্তিকামী যোদ্ধা শিরোইল কলোনিতে বিহারি ও খানসেনাদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন। চালক মোখলেছুর রহমানের জিপে করে মান্নান সরকার, মীর ইকবালসহ কয়েকজন জেবর মিয়ার ইটভাটার কাছে বন্দুক আনতে যান। আসার পথে তাদের জিপটি রাস্তার পাশে পড়ে যায়। এতে মান্নান সরকার ও গাড়ির চালক মোখলেছুর রহমান গুরুতর আহত হন। পরে ১৩ এপ্রিলের দিকে মানুষ রাজশাহী ছেড়ে পালাতে থাকে। এর আগে মান্নান সরকার রাজশাহী রেশম বোর্ডের আশপাশের এলাকার যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন।
বালিয়াপুকুরের মান্নান সরকারদের বাড়িতে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়। অস্ত্র রাখার ভান্ডার। জেল থেকে পালিয়ে আসা বাঙালিদেরও ওই বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া হতো। মান্নান সরকার বলেন, '১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের বাড়ির এসব কাজের নিশানা পেয়ে যায়। ফলে আমরাও পালাই। চার দিন পর ভয়ে ভয়ে রাজশাহীতে আসি বাড়ির অবস্থা দেখতে। পরিস্থিতি ভালো নেই বলে আবার গ্রামে চলে যাই। দুর্গাপুরে তরুণদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করি। পরে অক্টোবরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছন দিয়ে মেহেরচণ্ডীর ভেতরের রাস্তা হয়ে রাজশাহীর বাসায় আসি। এরপরই আমার জীবনে ঘটে বিভীষিকাময় ঘটনা।'
মান্নান সরকার বলেন, 'সেদিন ছিল ১৬ অক্টোবর। ভোরের আলো ফোটেনি। রাজশাহীর বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলাম। পাকিস্তানি মিলিটারিরা ভোররাতে আমার বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। বিছানা থেকে আমায় টেনে তুলে বাইরে আনে। বাইরে এসে দেখি, আমার ভাই-ভাবি কাঁদছে। তাদের হয়তো মারধর করেছে। ভাইয়ের ছয়-সাত বছরের ছেলে আসলাম সরকার, বর্তমানে অ্যাডভোকেট ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা, তার মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছে। তখন আমাকে তাদের সামনে দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যায়। মা কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে আসতে চাইলে এক রাজাকার আমার মাকে টেনে মাটিতে ফেলে দেয়।'
শুধু মান্নান সরকারকে একা নয়, পাকিস্তানিরা তখন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মীর রহমত আলীকেও তুলে নিয়েছিল। মান্নান সরকার বলেন, 'আর্মিরা টেনে নিয়ে যেতে লাগলে একটু সামনে গিয়ে দেখি, মীর রহমত আলীকে মারধর করতে করতে একটি বাড়ি থেকে নিয়ে আসছে। তারা আমাদের দুইজনকে শিরোইল স্কুলের কাছে নিয়ে সেনাবাহিনীর জিপের ভেতরে আছাড় দিয়ে ফেলে। বুকের ওপরে সেনাবাহিনী সদস্যরা বুট দিয়ে চেপে ধরে গাড়ির সিটে বসে। পানির পিপাসায় বুক ফেটে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু পানি চাওয়ার জন্য যে কথা বলব, সেটাও মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না। এরপর এভাবেই আমাদের নিয়ে সেনাবাহিনীর গাড়ি চলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর সম্ভবত ঘোড়ামারায় আমাদের চোখে কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। সেখানে রাজাকাররা গাড়ি থেকে নেমে যায় আর সেনাবাহিনী আমাদের নিয়ে চলতে শুরু করে। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর একটি ক্যাম্পে গিয়ে গাড়িটি থামে। আমাদের টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে ধাক্কা দিয়ে ভবনের বারান্দায় ফেলে। তারপর চোখের কালো কাপড়টি খুলে দেওয়া হয়। এরপর নাম-ঠিকানা লিখে এবং মারতে থাকে। দোতলায় নিয়ে আমাদের ধাক্কা দিয়ে একটি ঘরের ভেতর ফেলা হয়। তখন ওই ঘরে আরও একজন নির্যাতিত ব্যক্তি ছিলেন। তার বাড়ি ছিল পাবনা। তিনি একজন হিন্দু ভদ্রলোক ছিলেন। পরে তিনি আমাকে বলেছিলেন, পাবনায় তার অনেক সম্পদ ছিল, সেগুলো দিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন। তার সম্পদের লোভে স্থানীয় রাজাকাররা তাকে মিলিটারির হাতে তুলে দেয়। পাশের রুমগুলো থেকে বাঁচাও বাঁচাও, মা গো বাবা গো চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। মিলিটারিরা আমাদের আটকে রেখে চলে গেল। পাবনার ওই ভদ্রলোকটি অনেক কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে আমাদের কাছে এসেছিলেন এবং জানিয়েছিলেন, আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুজ্জোহা হলে আছি। এই হলে যাদের আনা হয়, তাদের কাউকে বাঁচিয়ে রাখা হয় না।'
মান্নান সরকার ১৬ থেকে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন ক্যাম্পে। তিনি বলেন, 'ওই তিন দিনের কাহিনি সারাজীবনেও বলে শেষ করতে পারব না। সে সময় কতবার যে জ্ঞান হারিয়েছি, তা বলতে পারব না। এ সময়ে তারা প্লাস দিয়ে টেনে হাত-পায়ের আঙুলগুলো তুলে ফেলে। নির্যাতনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আবার মুখে পানি দিয়ে জাগিয়ে তোলে। তারপর আবার মাথা চেপে ধরে পিঠে বেত দিয়ে মারে। নির্যাতনের ফাঁকে ফাঁকে জানতে চায়- হাতিয়ার কোথায়, মুক্তি কোথায়? এভাবে আমাদের তিনজনকেই নির্যাতন করা হয়।'
২১ অক্টোবর দিনটির কথা বলতে গিয়ে মান্নান সরকার এখনও আঁতকে ওঠেন। তিনি বলেন, 'জোহা হলের দোতলা থেকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিচে নামানো হয়। এসে দেখি, সেখানে মানুষকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সারি সারি করে দাঁড় করানো আছে। কিন্তু সেদিন মীর রহমত আলী ও পাবনার সেই হিন্দু ভদ্রলোককে আর দেখতে পাইনি। তারপর সেখান থেকে আরেকটি রুমে আমাকে আবার নিয়ে যায়। আবার হাত-পায়ের আঙুল প্লাস দিয়ে টেনে ধরে নির্যাতন চালায়। পায়ের তালুতে আর সারা পায়ে বেত দিয়ে পিটিয়ে জখম করে ফেলে। সেখানেও বারবার বলে- তোর হাতিয়ার, হিন্দু মুক্তিযোদ্ধারা কোথায়? সেখানে আমি দেখেছি, রাজশাহীর কিছু মানুষ উঁকি দিয়ে আমাদের এসব দেখছে। তারা শহরেরই রাজাকার ছিল। তাদের নির্যাতনে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।'
এরপর কী হয়েছিল, মনে নেই মান্নান সরকারের। তিনি বলেন, 'একসময় আমার জ্ঞান ফেরে। তখন নিজেকে লাশের স্তূপে দেখতে পাই। তারপর দেখি, একজন ব্যক্তি পাশ দিয়ে একটি গরু নিয়ে যাচ্ছেন। মূলত তিনি গরু নেওয়ার নামে মৃতপ্রায় মানুষকে সেখান থেকে সরাতেন। ওই ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অফিসারের বাড়ির কাজের লোক। তিনি আমাকে তার গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে কোলে করে একটি ভবনের সিঁড়ির নিচে এনে রাখেন। আমি তার কাছে পানি চাই। ওই ভদ্রলোক আমাকে পানি ও এক গ্লাস হরলিকস খেতে দেন। আমি তখন শুনতে পাই, বাড়ির ভদ্রমহিলা তাকে বলছেন, একে যেখান থেকে আনছ, সেখানে ফেলে এসো। না হয় সেও মরবে, তোমার-আমার মৃত্যুর কারণ হবে। এরপর আবার লোকটি আমাকে নিয়ে একটি স্কুলঘরে ফেলে আসেন।'
এরপর মান্নান সরকারের হামাগুড়ি দিয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়া বেশ কঠিন ছিল। তিনি বলেন, 'কাজলা এলাকার মোজাম নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। মামা বলে ডাকতাম তাকে। তিনি আমাকে দেখতে পান এবং রিকশায় করে আমাকে বাড়িতে রেখে যান। নির্যাতনে সারাশরীর ও পায়ে ক্ষত। বাড়ির লোকজন ভাবল, এখানে আর আমাকে রাখা যাবে না। গরুর গাড়িতে করে হরিয়ান স্টেশনের পাশে এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করান। তারপর ফের দুর্গাপুরের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কিছুদিন থেকে ভারতে চলে যাই।'
মান্নান সরকার বলেন, 'ভারতে গিয়েছিলাম যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে। কিন্তু নিজের শরীর এতটাই খারাপ ছিল যে সেটা আর সম্ভব হয়নি। এর মধ্যেই শুনতে পাই, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর আবার ফিরে আসি দেশে।'
সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল