2883
Published on ডিসেম্বর 2, 2020মজিবর রহমানঃ
যার নেতৃত্ব ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতো না, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই লেখাটি উৎসর্গ করছি বঙ্গবন্ধুর নামে।
আমার রাজনৈতিক জীবনের অতিতের স্মৃতিগুলো আমাকে সবসময়ই আত্মবিশ্বাসী হতে এবং অনুপ্রেরণা যোগাতে সহায়তা করে। ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনে অংশগ্রহণসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমার রাজনৈতিক জীবনের নবদিগন্তের অধ্যায় শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে লেখা-পড়া ও খেলাধুলার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সমাজ সংস্কার, দেশ ও জাতি গঠনে এবং মানবকল্যাণে সবসময়ই নিজেকে সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমার রাজনৈতিক জীবনের প্রেক্ষাপট নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্যই এই ছোট্ট প্রয়াস।
১৯৭১-এর ২৪ মার্চ সকাল থেকেই আমরা বন্ধু-বান্ধব ও সহপাঠী মিলে সকাল থেকেই যার যার প্রস্তুতি নিয়ে স্কুলে ঢুকে ক্লাসে উপস্থিতি দিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে মিছিলে মিটিংয়ে অংশ নিয়ে জেলা শহরের অলি-গলি প্রদক্ষিণ করি। এ সময় স্লোগানে, স্লোগানে জেলা শহর সরগরম হয়ে ওঠে। মিছিল-মিটিং শেষ করে আমরা যার যার বাসায় ফিরছিলাম। একটু পড়েই খবর পেলাম কিশোরগঞ্জ সরকারী গুরুদয়াল কলেজের ছাত্রলীগের আমাদের এক বড় ভাই সেই সময়কার সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন (ত্রনএসএফ)-এর এক ক্যাডারকে চাকু মেরে আহত করেছে। মুহূর্তের মধ্যেই সরকারী পুলিশ বাহিনী সারা শহর তল্লাশি করে। আমাদের ছাত্রলীগের ছেলেদের গ্রেফতারের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালায়। সন্ধ্যায় আমার কাকা পুলিশ কর্মকর্তা বাসায় এলে ভীষণভাবে বকা-ঝকা দিয়ে আমার নিরাপত্তার কারণে রাতের মধ্যেই বাসা ত্যাগ করে শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিলেন। ’৭১-এর ২৪ মাচর্’ রাতেই কিশোরগঞ্জ পুলিশের এএসপি (সার্কেল) আমার শ্রদ্ধেয় কাকা সাফায়েত আলীর স্ত্রী আমার শ্রদ্ধেয় খালাম্মার নিকট থেকে কিছু টাকা নিয়ে রাত ১০টায় ট্রেনে কিশোরগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ শহর হয়ে ২৫ মার্চ ভোর ৫টায় ঢাকার কমালপুর স্টেশন থেকে বাসে উঠে গাবতলী, সাভার নয়ারহাট ফেরিঘাট পার হয়ে বিকেল ৫টায় ঘিওর থানার বড়কুষ্টিয়া নন্দীগ্রামে নিজ বাড়িতে পৌঁছাই।
ঢাকার কমালপুর স্টেশন থেকে যখন বাসে উঠি তখন সারা ঢাকা শহর জুড়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রাস্তায় রাস্তায় টহল দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের পর রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছাত্র-জনতা ও সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ সকলেই স্ব স্ব এলাকায় মুক্তিবাহিনী সংগঠনের কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, গ্রামে-গঞ্জে বাঁশের লাঠি দিয়ে ও ড্যামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে। আমাদের মানিকগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলসহ ঘিওর, তেরশ্রী, দৌলতপুর, টাঙ্গাইল আঞ্চলেও ব্যক্তিক্রম ছিল না। ঘিওর থানা থেকে আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তেরশ্রী খেলার মাঠে রাতের অন্ধকারে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি এবং ট্রেনিং শুরু করা হয়ে গেছে। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেই আমিসহ কয়েকজন বন্ধু প্রদীপ নারায়ণ চন্দ্র, শাহাদত হোসেন মল্লিক, জুম্মাত আলী মল্লিক মিলে নাগরপুরের উদ্দেশে যাত্রা করি। টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল লাউহাটি গ্রামে ব্যারিস্টার শওকত আলী সাহেবের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধোদের সংগঠিত ও ট্রেনিং দেয়া শুরু হয়ে গেছে। টাঙ্গাইল জেলার ৬ আসন নাগরপুর ও দেলদুয়ারের উপজেলার সাবেক সংসদ সদস্য খন্দকার আব্দুল বাতেন সাহেবের নেতৃত্বে ১০/১২ জনের একটি কমিটি করে প্রায় ৭০/৮০ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধাদল গঠন করে অস্ত্র গোলাবারদ সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। আমাদের পরিবারের বিশেষ করে আমার বাবা ছিলেন অসম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। বাবার সুপরামর্শে এবং তার অনুপ্রেরণায় সে সময় আমাদের গ্রামের কয়েকজন বন্ধু মিলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। এ সময় পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তারাই আমাদের অস্ত্র চালনা ও যুদ্ধ করার জন্য ট্রেনিং দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় ১১নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার নাগরপুর ও দেলদুয়ার উপজেলার সাবেক সংসদ সদস্য খন্দকার আব্দুল বাতেন সাহেবের নেত্বত্বে টাঙ্গাইলের কিছু অংশ নাগরপুর, এলাসিন, লাউহাটি, দৌলতপুর, ঘিওর, সাঁটুরিয়া অঞ্চলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও দেশীয় রাজাকারদের সঙ্গে জীবন বাজি রেখে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য হয়েছে। নবেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে দৌলতপুর উপজেলায় কলিয়া ইউনিয়নের ঘড়িয়ালা গ্রামে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংঘবদ্ধ দল সন্ধ্যায় রাতের খাবার খেয়ে, নিরলী বাজারের পূর্বদিকে নদী পার হয়ে রাত আনুমানিক ১১/১২টার সময় দরগ্রাম হাই স্কুলের মাঠে অবস্থান নেই। এর পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত দল কর্মপরিকল্পনা করে সাঁটুরিয়া থানা অপারেশনের উদ্দেশে যাত্রা করি। ভোর রাত থেকে আমরা সাঁটুরিয়া থানার পশ্চিম দিক থেকে অপারেশন শুরু করি। সাঁটুরিয়া থানা অপারেশনে সম্মুখ যুদ্ধে আমাদের একজন সহযোদ্ধা শহীদ হন। অপারেশন শেষে আমরা মুক্তিযোদ্ধা দল দৌলতপুর থানার নিরালি বাজারে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করি। এরপর বিভিন্ন অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পাক সেনাদের ওপর আক্রমণ চালাই।
১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের পর আমরা মুক্তিযোদ্ধরা অস্ত্র জমা দিয়ে স্ব-স্ব এলাকায় ফিরে আসি। এর পরে আবার লেখাপড়ায় যোগদান করি। লেখাপড়ায় পাশাপাশি ঢাকাসহ ময়মনসিংহের জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণ করি। ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। ১৯৭৪ সালের ঘটনা। তখন আমি ঢাকার বাংলামটর বাসায় থাকি। মার্চ মাসের শেষার্ধে হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম আমাদের মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার জামশা গ্রামে ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় তিন/চার শত লোক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ভোরবেলায় আমিসহ চার/পাঁচজন বন্ধু মিলে সিংগাইর উপজেলার জামশা গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করি। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েই দেখি বঙ্গবন্ধু ঘূর্ণিঝড় এলাকা পরিদর্শনে এসেছেন। সেই দিন বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। প্রায় ছয় ফুট লম্বা পাজামা-পাঞ্জাবি ও গায়ে মুজিব কোট পরিহিত চোখে কালো চশমা, ঘূর্ণিঝড়ে হতাহতের ঘটনা দেখে বঙ্গবন্ধুর দু’চোখে অশ্রুজলে ছলছল করছে। মানব প্রেমিক মহান নেতার চোখে মুখে বিষণ্নতার ছাপ দেখে উপস্থিত সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের হৃদয়বিদারক দৃশ্য আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠেও সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সেই দিন খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর আমার জীবনের প্রেক্ষাপট বদলে যায়। আত্মগোপনে ঢাকায় চলে আসি। সম্মানিত পাঠকবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে যেভাবে দেখেছি, মানবপ্রেমিক মহান নেতার আদর্শের একজন সৈনিক হিসেবে যে কথাটি অবশ্যই বলা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু আমাদের যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। জীবনে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৮৮ সালের শেষার্ধে ঢাকা ক্লাবে চাকরিতে যোগদান করি। ঢাকা ক্লাবে চাকরি করার সুবাদে পরিচয় হয় ক্লাবের সম্মানিত সদস্য বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা এমআর আক্তার মুকুল, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক ফয়েজ আহম্মেদ, বর্তমানে শিশু একাডেমির মহাপরিচালক কথাসাহিত্যিক ও লেখক সেলিনা হোসেন, বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ এস এ সামাদ, সংবাদের সম্পাদক আহমেদুল কবির, বিশিষ্ট সাংবাদিক গোলাম সারোয়ার, বিশিষ্ট সাংবাদিক রাহাত খান, প্রাক্তন সিনিয়র সচিব আহ্বাব আহমেদ, প্রাক্তন সিনিয়র সচিব টাঙ্গইল ভুয়াপুরের সাবেক এমপি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক খন্দকার আসাদ্দুজামান, বৈমানিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টিন শাহাব উদ্দিন, বীর উত্তম। দেশবরেণ্য এই সকল গুণীজনের আদর, স্মেহ, ভালবাসা ও অনুপ্রেরণায় সমাজ সংস্কার, দেশ ও জাতি গঠনে অবসর সময়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করি। সবসময়ই গর্ব করে বলি মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র জমা দিয়েছি। আবারও বলছি ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে। কিন্তু আমার যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। আমাদের যুদ্ধ সমাজের ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরের ঘাপটি মেরে থাকা সুবিধাভোগী লোকদের আনিয়ম অবহেলা, অন্যায়, অবিচার, ঘুষখোর দূরর্নীতিবাজ ও স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী রাজকারদের বিরুদ্ধে। আসুন আমরা সকালে মিলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলি। মহান বিজয় দিবসের এই মাসে বঙ্গবন্ধুসহ মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বীর শহীদদের প্রতি জানাই আমাদের গভীর ভালবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও লাইব্রেরিয়ান