পঁচাত্তরের খুনিদের দায়মুক্তি অধ্যাদেশ এবং আমাদের দায়

2282

Published on সেপ্টেম্বর 26, 2020
  • Details Image

মো. জাকির হোসেন:

২৬ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের ইতিহাসে বিচারহীনতার সংস্কৃতির এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালের এই দিনে। ১৫ই আগস্ট ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর নয়, রক্তাক্ত হয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশ। খুনিরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বাঙালি জাতিকে পিতাহন্তারকের কাঠগড়ার দাঁড় করিয়ে ক্ষান্ত হয়নি। হত্যাকাণ্ডের এক মাস ১০ দিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর সভ্যতা ও মানবতার ইতিহাসের এক ভয়ংকর কালো আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বর্বর জাতির তকমা সেঁটে দেয় বাঙালি জাতির গায়ে। অধ্যাদেশের মূল কথা হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোরে আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, খুনিদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা বা অভিযোগ দায়ের করা যাবে না। নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের পর খুনিদের যাতে বিচার করা না যায় সে জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে খুনি মোশতাক। আর পেছনে মূল ক্রীড়নক ছিলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ৯ দিনের মাথায় সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকে হটিয়ে নতুন সেনাপ্রধান বনে যাওয়া জিয়াউর রহমান।

মোশতাক খুনিদের দায়মুক্তি দিয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করলেও সংবিধান অনুযায়ী এটি ছিল অবৈধ। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে উপরাষ্ট্রপতি কিংবা স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। খন্দকার মোশতাক মন্ত্রী ছিলেন, উপরাষ্ট্রপতি কিংবা স্পিকার ছিলেন না। কাজেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ এবং খুনিদের বাঁচানোর জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। তদুপরি রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ইচ্ছাখুশি যেকোনো বিধান জারি করতে পারেন না। সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ প্রণয়নের ক্ষমতা বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়া অবস্থায় অথবা উহার অধিবেশনকাল ব্যতীত, কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট আশু ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রহিয়াছে বলিয়া সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে তিনি উক্ত পরিস্থিতিতে যেরূপ প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে করিবেন, সেইরূপ অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করিতে পারিবেন এবং জারি হইবার সময় হইতে অনুরূপভাবে প্রণীত অধ্যাদেশ সংসদের আইনের ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন হইবে : তবে শর্ত থাকে যে এই দফার অধীন কোনো অধ্যাদেশে এমন কোনো বিধান করা হইবে না, (ক) যাহা এই সংবিধানের অধীন সংসদের আইন দ্বারা আইনসংগতভাবে করা যায় না...’।

কোনো বিধান সংসদের আইন দ্বারা আইনসংগতভাবে করা যায় না সে বিষয়ে সংবিধানের ৭ ও ২৬ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো আইন যদি সংবিধানের সঙ্গে অসমঞ্জস হয়, তাহলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে। অন্যদিকে ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসমঞ্জস আইন বাতিল। ২৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসমঞ্জস কোনো আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হলে তা মৌলিক অধিকারের কোনো বিধানের সঙ্গে যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক আইন জারি হলেও সংবিধানকে বাতিল করা হয়নি বিধায় সংবিধানের ৩১ এবং ৩২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার, যার দ্বারা আইনের আশ্রয়লাভ এবং জীবনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সে বিধানসমূহ বলবৎ ছিল।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানের ৩১ এবং ৩২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী হওয়ায় তা শুরু থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাতিল ছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হিসেবে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং সুবিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানে বর্ণিত আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার লাভের নিশ্চয়তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধায় সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শুরু থেকেই অসাংবিধানিক ও বাতিল ছিল। খুনি মোশতাকের অসাংবিধানিকভাবে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা দখল করায় তিনি ছিলেন অবৈধ রাষ্ট্রপতি। একজন অবৈধ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারীকৃত সংবিধানবিরোধী অধ্যাদেশ ছিল আইনের ভাষায় অস্তিত্বহীন ও অবৈধ। সামরিক আইনের আওতায় এই অবৈধ অধ্যাদেশকে জোর করে বহাল রাখলেও ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই অধ্যাদেশটি কার্যকারিতা হারায়। সে সময়ের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ইচ্ছা করলে ১৫ই আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু জিয়া খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, অন্য কেউ যাতে ব্যবস্থা নিতে না পারে সে জন্য দায়মুক্তিকে আরো পাকাপোক্ত করতে দিতে অস্তিত্বহীন, অবৈধ আইনকে সংসদের আইনের মর্যাদা দেন। জিয়া পরবর্তী সময়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে মানবতা, মানবাধিকার, সভ্যতা, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারবিরোধী এই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানের অংশে পরিণত করে নজিরবিহীন রক্তমূল্য ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধানকে কলঙ্কিত করেন।

হত্যার বিচার চাওয়ার পথ সাংবিধানিকভাবে রুদ্ধ করে দিয়ে জিয়া বাংলাদেশকে মানবাধিকার ও সভ্যতাবিরোধী অমানবিক, অসভ্য, জংলি রাষ্ট্রে পরিণত করেন। জিয়া খুনিদের দায়মুক্তি অধ্যাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেই থেমে থাকেননি, দূতাবাসে চাকরির যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিশেষ ব্যবস্থায় খুনিদের চীন, আর্জেন্টিনা, আলজেরিয়া, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, ইরান, কুয়েত, আবুধাবি, মিসর, কানাডা ও সেনেগালের বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করেন। জিয়াউর রহমানের পর বিচারপতি সাত্তার, জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকলেও কেউই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেননি। বরং জিয়া খুনিদের দূতাবাসে যে চাকরি দিয়েছিলেন, এরশাদ ও খালেদা জিয়া তাঁদের পদোন্নতি দিয়ে বাঙালি জাতির কলঙ্কের দায়কে দীর্ঘায়িত করেছেন। দায়মুক্তি পেয়ে ও দূতাবাসে চাকরি-পদোন্নতি পেয়ে খুনিরা ১৫ই আগস্টের হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতেন।

কেউ কেউ সংগতভাবে কলাম বিষয়ে দুটি প্রশ্ন করতে পারেন—এক. পৃথিবীর অনেক দেশে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান এমনকি রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যা করা হয়েছে, শুধু বাংলাদেশেই এমন ঘটনা ঘটেনি? দুই. ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হয়েছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, খুনিদের একাংশের দণ্ড কার্যকর হয়েছে, এরপর এ বিষয়ে আর আলোচনার কী আছে? প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলব, যুক্তরাষ্ট্রের আব্রাহাম লিংকন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, রাজিব গান্ধী, রাশিয়ার ভ ই লেনিন, পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট বন্দর নায়েকেসহ অনেক রাষ্ট্রনায়ক, রাষ্ট্রের স্থপতি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কিন্তু সেসব দেশে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়নি। বরং দ্রুততার সঙ্গে এমনকি মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব হলো, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হয়েছে, খুনিদের বিচার হয়েছে সত্যি, কিন্তু যাঁরা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে, সংবিধানে এই আইনকে অন্তর্ভুক্ত করে জনকের হত্যার বিচারের পথকে রুদ্ধ করেছিলেন, তাঁদের অনুসারীরা তাঁদের পূর্বসূরিদের অপরাধ অনুধাবন করে অনুতপ্ত হয়েছেন কি? উত্তর, অবশ্যই না। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর যেদিন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিত করার জন্য সংসদে আইন পাস হয়, সেদিন বিএনপি ও জামায়াতের সংসদ সদস্যরা সংসদে অনুপস্থিত থাকেন এবং খুনিদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি বাতিলের বিরুদ্ধে হরতাল আহ্বান করেন। ইনডেমনিটি আইন বাতিলকে চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৭ সালে খুনি শাহরিয়ার রশিদ উচ্চ আদালতে যে রিট দায়ের করেছিলেন সে মামলায় শাহরিয়ার রশিদের আইনজীবী ছিলেন খালেদা জিয়া সরকারের মন্ত্রী অ্যাডভোকেট কোরবান আলী। এ মামলায় আদালত বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব উদ্দীন আহমেদকে নিরপেক্ষ পরামর্শ দেওয়ার জন্য আদালতের মিত্র তথা অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দিলে তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধ আইন হিসেবে যুক্তি তুলে ধরেন। তার মানে, পরোক্ষভাবে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকে তিনি বৈধ মনে করেন।

এরশাদ খুনিদের রাজনৈতিক দল গঠন ও সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, আর খালেদা জিয়া ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে খুনি শাহরিয়ার রশিদকে সংসদে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচন করেছিলেন। কথায় কথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পুনরাবৃত্তির হুমকি শুনি বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের মুখে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে ‘১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট’ নিয়ে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘১৫ আগস্ট এবং ২১ আগস্ট এগুলো কোনো বিষয় না, এ রকম দুর্ঘটনা হতে পারে। এটা নিয়ে সারা জীবন কান্নাকাটির কী আছে?’ এসব ঘটনা প্রমাণ করে মোশতাক-জিয়ার অনুসারীদের অবস্থান পরিবর্তন হয়নি। তাই ২৬ সেপ্টেম্বরকে স্মরণ করে প্রতিটি প্রজন্মকে জানাতে হবে এমন একটি জাতির অংশ আমরা, যে জাতি তার পিতাকে হত্যা করে হত্যার বিচারের পথ আইন করে রুদ্ধ করে দিয়েছিল। নতুন প্রজন্ম জানুক কতটা অবিচার করা হয়েছিল তাদের জাতির পিতার সঙ্গে। দায়মুক্তি আইন বাতিল হয়েছে, আমাদের বিবেকের দায়মুক্তি হয়েছে কি?

লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত