2459
Published on সেপ্টেম্বর 26, 2020ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ:
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পুরো রাজনীতির মোড় পরিবর্তিত হয়ে যায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে। এ ঘটনার পর প্রায় দেড় দশক দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক শাসন চলে। এমনকি এ হত্যাকান্ডের বিচার আটকে দিতে এবং খুনীদের রক্ষায় একটি অধ্যাদেশ জারি করেন ‘স্বঘোষিত’ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ইতিহাসে তা ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ হিসেবে পরিচিত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্ররোচনা ও মদদে একদল সেনা কর্মকর্তা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডির বাসভবনে আক্রমণ করে। নির্মম এ হত্যাযজ্ঞের শিকার হন বঙ্গবন্ধু, তাঁর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ আবু নাসের, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাব ইন্সপেক্টর ছিদ্দিকুর রহমান, পেট্রোল ডিউটির সৈনিক সামছুল হক ও রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব কর্নেল জামিল।
দেশের বাইরে থাকায় সেদিন প্রাণে বেঁচে যান জাতির পিতার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। জঘন্যতম এ হত্যাকান্ডের দেড় মাসের মধ্যে পঁচাত্তরের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’ জারি হয়। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে স্বাক্ষর করেছিলেন খন্দকার মোশতাক ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এমএইচ রহমান।
দুই অংশের অধ্যাদেশটির প্রথম অংশে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যাই কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোন আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনী প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
আর দ্বিতীয় অংশে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্তবলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোন আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনী প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। এই দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের আইনী সুরক্ষা দেয়া হয়। যা এক অচিন্তনীয় এবং ইতিহাসে বিরল। এই আইন ও পরবর্তী রাজনৈতিক আবহাওয়ায় বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচারের সব পথ রুদ্ধ হয়ে থাকে। অধ্যাদেশ জারি করে দেশের সরকারপ্রধানের হত্যাকারীদের আইনের উর্ধে রাখার এই প্রক্রিয়া ছিল অভূতপূর্ব। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গায়ে একটি রক্তাক্ত কাঁটার মতো এই অধ্যাদেশটি বিঁধে ছিল। যা জাতির জন্য কলঙ্কজনক স্মৃতিও বটে।
জাতির পিতা হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় দীর্ঘস্থায়ী ছেদ পড়ে। ক্যুয়ের পর ক্যু-এর কারণে দেশে ঘোর অমানিশা দেখা দেয়। একের পর এক আরও রাজনৈতিক হত্যাকান্ড আর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্যে পাক খেতে শুরু করে ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর মাধ্যমে অর্জিত সোনার বাংলা। অগণতন্ত্রের গাঢ় প্রচ্ছায়া দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশকে গ্রাস করে। ঘোর অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা দেশকে টালমাটাল করে দেয়।
১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে খন্দকার মোশতাক সরকার ইমডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান ও পাকিস্তানপন্থী প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে এর বৈধতা দেয়া হয়। এমনকি খুনীদের রাজনৈতিকভাবেও পুনর্বাসন করা হয়।
কুখ্যাত খুনী সৈয়দ ফারুক রহমান ও খন্দকার আবদুর রশিদসহ এই হত্যাকান্ডের খলনায়কেরা ফ্রিডম পার্টি গঠন করে রাজনীতির ময়দানে নামে। দেশে যাতে গণতান্ত্রিক রাজনীতি অঙ্কুর মেলতে না পারে, সেটা ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে রাজনীতির মাঠ অস্থির করে রাখে তারা। রাজনীতিতে ঠাঁই গাড়তে থাকে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতির বিভক্তি এ সময়ে দৃঢ়মূল হয়ে ওঠে।
এই অধ্যাদেশ জারির পেছনে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। যিনি তার ঠিক আগেই সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময় বলেছেন, ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডে জিয়াউর রহমান জড়িত। তিনি এও বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমান শুধু জাতির পিতা হত্যার সঙ্গে-ই নয়, জাতীয় চার নেতা এবং একের পর এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাকর্মীদের হত্যার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।’ পরবর্তী সময়ে সামরিক অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল নিজেই রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হয়ে জিয়া ওই অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করেন।
১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় জিয়াউর রহমানের গড়া দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়। এরপরই ওই বছরের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাস হয়। ওই সংশোধনীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত দায়মুক্তি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে আইনী বৈধতা দেয়া হয়। সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিল ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’।
পঞ্চম সংশোধনীতে বলা হয়, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইনপ্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ ও অন্যান্য আইন, ওই মেয়াদের মধ্যে কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আদেশ, কৃত কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ অথবা প্রণীত, কৃত বা গৃহীত বলিয়া বিবেচিত আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ এত দ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং ওই সকল আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল এবং তৎসম্পর্কে কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোন কারণেই কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’
এই সংশোধনীর মাধ্যমে দায়মুক্তি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেয়ায় ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা পাকাপোক্তভাবে দায়মুক্তি পেয়ে যায়।
১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ফলে ১৯৭৫সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশটি কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। ফলে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে বাধা ছিল না।
কিন্তু পথ আটকাতেই জিয়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আনেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, ‘যারা এই হত্যাকান্ডটি সংঘটিত করেছিল, তারাই দায়মুক্ত হতে এই দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি করেছিল। সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯-এর ক্ষমতাবলে ভবিষ্যতে কেউ যাতে ১৫ আগস্টের খুনীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে পারে, সে ব্যবস্থাটিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করা হলো। নিঃসন্দেহে এই অধ্যাদেশটি ছিল আইনের শাসনবিরোধী।’
এভাবেই একটার পর একটা কলঙ্ক বয়ে বেড়ায় বাঙালী জাতি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এর আগে দীর্ঘ ২১ বছর এই অধ্যাদেশটি বাতিলে রাজনৈতিক বা আইনী কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কেন নেয়া হয়নি- এর উত্তর খুঁজতেও বেশি গভীরে যেতে হবে না। কারণ যারা খুনীদের রক্ষা করার জন্য অধ্যাদেশটি করেছিল, তারাই প্রায় দুই দশকে রাষ্ট্র পরিচালনায় ছিল। এক্ষেত্রে বলতেই হবে- তারা খুনীদের পক্ষেই কাজ করেছে। না হলে, কেন-ই বা ইতিহাসের ভয়াবহ এই হত্যাকান্ডের বিচারের বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেবে না?
আওয়ামী লীগের শাসনামলে ১৯৯৬ সালে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল হয়। একই বছরের ২ অক্টোবর ধানম-ি থানায় আফম মুহিতুল ইসলাম নামে একজন এ বিষয়ে এজাহার দায়ের করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকার সময় তার রিসিপসনিস্ট কাম রেসিডেন্টপিএ ছিলেন মুহিতুল।
এর আগে দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি বাতিলের আইনগত দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি কমিটি গঠন করে সরকার। এর প্রধান করা হয় তৎকালীন আইন সচিব আমিন উল্লাহ। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে সংসদে ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল এ্যাক্ট-১৯৯৬’ বিলটি উত্থাপিত হয়। যা ওই বছরের ১২ নবেম্বর সংসদে আইন হিসেবে পাস হয়। আর এর মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের সকল বাধা দূর হয়।
বিচারিক কার্যক্রম শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নবেম্বর ঢাকা জেলা ও দায়রাজজ কাজী গোলাম রসুল ১৯ জন আসামির ১৫ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন। আসামিদের ১১ জন ছিলেন পলাতক। এরপর এ মামলার আপিল-শুনানি হয় হাইকোর্টে। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এই মামলার দ্বিধাবিভক্ত রায় দিলে সেটি যায় তৃতীয় বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের বেঞ্চে।
তার রায়ে ১২ জন আসামির ফাঁসির আদেশ বহাল থাকে, তিনজনকে খালাস করে দেয়া হয়। এরপর বিএনপির শাসনামলে বিচার প্রক্রিয়া কার্যত স্থবির হয়ে যায়। অবশেষে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সুপ্রিম কোর্টে মামলাটির সর্বশেষ পর্যায় শুরু হয়। টানা ২৯ কার্যদিবস শুনানির পর ২০০৯ সালের ১৯ নবেম্বর রায়ের তারিখ ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপীলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। আর ভারতে পলাতক খুনী মাজেদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় গত এপ্রিলে।
আর এর মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতির সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়ের অবসান ঘটে। রাজনৈতিক এই হত্যাকান্ডের ন্যায়বিচার পথ খুলে দেয় আরও অনেক রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিচারের পন্থা। সবচেয়ে বড় কথা, এ রায়ের মধ্য দিয়ে দেশে সৃষ্টি হয়েছে আইনের শাসনের পথরেখা। বঙ্গবন্ধুর সাজাপ্রাপ্ত বাকি খুনীদেরও দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হোক-এই প্রত্যাশা।
লেখক : উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেলান্দহ, জামালপুর
সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ