জিয়াউর রহমান কেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি নির্দয় হলেন?

2190

Published on আগস্ট 10, 2020
  • Details Image

বিভুরঞ্জন সরকার:

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং নভেম্বর মাসের ৩ ও ৭ তারিখে সংঘটিত ঘটনাবলি বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, যে নিষ্ঠুরতার জন্ম দিয়েছে, তা সহজে কাটবে বলে মনে হয় না। ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেনাবাহিনীর কিছু তরুণ সদস্য এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করলেও পেছনে আরো অনেকেই যে ছিলেন সেটা এখন আর গোপন বিষয় নয়। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর সহচর হিসেবে পরিচিত খোন্দকার মোশতাক আহমেদকে ক্ষমতায় বসিয়ে নিজেরা জাতির ওপর ছড়ি ঘোরাতে থাকে। সেনাবাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলেও ঘাতক সেনাচক্রের বাড়াবাড়ি, সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড অমান্য করা ইত্যাদি মেনে নিতে পারছিলেন না। তারা যখন কিছু একটা করার পরিকল্পনা করছিলেন, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে যখন একটি পাল্টা ব্যবস্থার প্রস্তুতি সম্পন্ন, তখনই জেলের অভ্যন্তরে ৩ নভেম্বর সংঘটিত হয় আরো এক ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত চার সহযোগী, তাঁর অবর্তমানে যারা মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করে একই খুনি চক্র।

এর মধ্যে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে শুরু হয় নানা রকম রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন জাসদ প্রভাবিত সৈনিক সংস্থা সেনাবাহিনীতে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়। ৭ নভেম্বর ঘটে তথাকথিত এক ‘সিপাহি জনতার অভ্যুত্থান’। আর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান।

জিয়াউর রহমানকে বলা হয় ভাগ্যের বরপুত্র। তিনি ছিলেন সুযোগসন্ধানী এবং সুযোগের অসদ্ব্যবহারে অত্যন্ত পারঙ্গম। তিনি উচ্চাভিলাষী ছিলেন এবং ছিলেন নিষ্ঠুরও। তিনি সেনা কর্মকর্তা থেকে দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্নেহ পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর উদারতার কারণেই তিনি বীরউত্তম উপাধি এবং সেনাবাহিনীর উপপ্রধানের পদ পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাঙা সংসার জোড়া দিয়েছিলেন পিতৃসম স্নেহপরায়ণ হয়ে। কিন্তু জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর প্রতি সদয় হতে পারেননি। বরং বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ছিল এক ধরনের প্রচ্ছন্ন প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব। বঙ্গবন্ধুর প্রতি জিয়া কেন অনুদার ছিলেন তার কারণ অনুসন্ধান প্রয়োজন। কিন্তু এই প্রয়োজনীয় কাজটি না হওয়ায় জিয়াকে নিয়ে আমাদের দেশে মাতামাতি করার লোকেরও অভাব নেই।

বঙ্গবন্ধুর করুণায় সেনাবাহিনীতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে জিয়া পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং হত্যার পর তার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার সব অপচেষ্টারই মধ্যমণি ছিলেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জিয়াকে যখন পাকিস্তানি অনুচর বলে অভিহিত করা হয় তখন অনেকেই সেটা মেনে নিতে পারেন না। কারণ আওয়ামী লীগ জিয়ার বিরুদ্ধ বললে সেটা কারো কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয় না। আমাদের দেশে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগ বিদ্বেষ এতই প্রবল যে, আওয়ামী লীগ তথ্যপ্রমাণনির্ভর কথা বললেও তারা তাকে বানোয়াট মনে করে। জিয়াউর রহমান যেহেতু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়েছিলেন সেহেতু তার সুনাম ক্ষুণ্ণ করার জন্যই তাকে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানি গুপ্তচর বলে থাকে- এমন ধারণা কারো মনে হতেই পারে।

‘মেজর জিয়া’র নামের সঙ্গে বেশ কিছু সংখ্যক মানুষের আবেগ জড়িত আছে। কারণ তার কণ্ঠ থেকেই প্রথম কেউ কেউ স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছিলেন। তিনি ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ এমন একটি ধারণা নানা প্রচার-অপপ্রচারের মাধ্যমে জনমনে ঠাঁই পেয়েছে। জিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পেয়েছেন। কাজেই তার মুক্তিযোদ্ধার ইমেজও মানুষের মনে উজ্জ্বল। কিন্তু তিনি কি স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, নাকি বিশেষ কোনো মতলব নিয়ে, কারো এজেন্ট হিসেবে গিয়েছিলেন তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তার পরবর্তী সময়ের কার্যক্রম থেকে।

জিয়া মুক্তিযুদ্ধের সময় কি কোনো সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলেন? তার সরাসরি কমান্ডে কোথায় যুদ্ধ হয়েছে? তার সেক্টরে তার যুদ্ধের গৌরবগাথা শোনা যায় না কেন? তিনি যুদ্ধের সময় সেনাপ্রধান জেনারেল এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে কী সদাচরণ করেছেন? রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গেও কি তার সদ্ভাব ছিল? নাকি তিনি সারাক্ষণ নিজের অবস্থান ও মর্যাদার বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন? মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি জিয়ার আনুগত্য প্রশ্নাতীত ছিল না।

স্বাধীনতার পর তিনজন সেনা কর্মকর্তার মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিরোধ ছিল বলে শোনা যায়। এরা হলেন জেনারেল শফিউল্লাহ, জিয়া এবং খালেদ মোশাররফ। জিয়ার আকাক্সক্ষা ছিল সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার। সেটা না হতে পেরে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে তার প্রতি সদয় ছিলেন। তাঁর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নানা মাধ্যমে দেনদরবার করে জিয়া সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হয়েছিলেন। তার জন্যই এই পদটি বঙ্গবন্ধু তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রতি কি জিয়া শতভাগ অনুগত ছিলেন? পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে বলা যায়, জিয়া আদতেই বঙ্গবন্ধুর হিতৈষী ছিলেন না।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে প্রকাশ্যে নেতৃত্বদানকারী দুজন কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশিদ দেশত্যাগ করার পর ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছিলেন যে, তারা মুজিব হত্যা পরিকল্পনার কথা জিয়াউর রহমানকে জানালে তিনি তাদের এগিয়ে যেতে বলেন এবং তারা সফল হলে জিয়া তাদের সঙ্গে থাকবেন বলেও অঙ্গীকার করেন।

এই সাক্ষাৎকারটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। জিয়াউর রহমান তখন অত্যন্ত ‘ক্ষমতাধর’ হয়ে ওঠা সত্ত্বেও কিন্তু খুনি দুই কর্নেলের বক্তব্য অস্বীকার করেননি। বরং তিনি তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। এ থেকে এটা ধারণা করা যায় যে, জিয়া ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার মাস্টারমাইন্ড। তিনি যদি দায়িত্ববান হতেন, বঙ্গবন্ধুর প্রতি যদি সামান্য আনুগত্য বা দরদ থাকত তাহলে হত্যা পরিকল্পনার কথা শুনে ওই দুই কর্নেলকে পুলিশে সোপর্দ করতেন। সেটা না করে উল্টো তাদের এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দিয়েছেন। এত বড় একটি রাষ্ট্রদ্রোহের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে জেনেও কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা না করা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ করেছেন জিয়া। সে দিন জিয়া যদি পরিকল্পনাকারীদের আইনের আওতায় আনতেন তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এত বড় বিয়োগান্ত ঘটনা হয়তো ঘটত না।

আসলে জিয়ার অভিলাষ ছিল অন্যরকম। তিনি ইতিহাসের নায়ক হওয়ার লোভে মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনেও জিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল রহস্যজনক। তিনি বিচলিত হননি, ভারাক্রান্ত হননি। বিষয়টি তার জানা ছিল বলেই স্বাভাবিক কণ্ঠে বলতে পেরেছেন, ‘সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেক ওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স’। অথচ কী কদর্যভাবেই না তিনি রাজনীতিতে জড়ালেন এবং রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য ডিফিক্যাল্ট করে দিলেন!

জিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বাঙালির স্বাধীন অস্তিত্বের ঠিকানা খুঁজতে নয়। যদি বলা হয়, তিনি গভীর পাকিস্তান প্রেম বুকে নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তাহলে তা ভুল প্রমাণের পর্যাপ্ত যুক্তি পাওয়া যায় কি? বরং এটাই মনে হয় যে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরিস্থিতির চাপে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও তিনি পাকিস্তান ভাঙার বদলা নেয়ার সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে ছিলেন। খোন্দকার মোশতাক এবং জিয়ার উদ্দেশ্যের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়। তার প্রতি একশ্রেণির মানুষের আবেগী দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশকে একটি মিনি পাকিস্তান বানানোর পথ তৈরি করছিলেন। জিয়া ছিলেন ঠাণ্ডা মাথার দুর্ধর্ষ প্রতারক। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুনাম কাজে লাগিয়ে তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের কাজটি ভালোভাবে করেছেন। গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনেছেন, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জায়গা করে দিয়েছেন। শাহ আজিজের মতো রাজাকারকে প্রধানমন্ত্রী করে জাতিকে অপমানিত করেছেন। জাতীয় ঐক্যের নামে তিনি জাতিকে স্থায়ীভাবে চরম বিভক্তির পথে ঠেলে দিয়েছেন। জয় বাংলা স্লোগান নির্বাসনে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম মুছে ফেলার সব অপচেষ্টাই করেছেন। পাকিস্তানি পরাজিত সৈনিকরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে জায়গায় আত্মসমর্পণ করেছিল সেখানে শিশুপার্ক বানিয়ে ইতিহাসের সঙ্গে তামাশা করেছিলেন জিয়া। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিদেশি মিশনে চাকরি দিয়ে, তাদের বিচারের দায়মুক্তি দিয়ে জিয়া বুঝিয়েছেন তিনি আসলে কাদের লোক।

দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা বাঙালিরা খুনিকে শোক মিছিলে দেখলেই তার অপরাধ ভুলে যাই। জিয়াউর রহমান তথাকথিত সৎ মানুষের কৃত্রিম ইমেজ নিয়ে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যে নীতিহীনতার বীজ রোপণ করে গেছেন, তার বিষফল এখন আমরা ভোগ করছি। তবে ইতিহাস কাউকে মার্জনা করে না। জিয়াউর রহমান ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবকে ইতিহাস থেকে বাদ দেয়ার ঔদ্ধত্য দেখিয়ে এখন নিজেই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ঠাঁই পেতে চলেছেন। খলনায়ক কখনো নায়ক হতে পারেন না। জিয়ার মুখোশ উন্মোচনের জন্য আরো বেশি গবেষণা ও সত্যানুসন্ধান প্রয়োজন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

সৌজন্যেঃ ভোরের কাগজ (প্রকাশ ২০১৯)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত