2841
Published on মে 16, 2020তোফায়েল আহমেদঃ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি যেদিন বাংলাদেশে ফিরে আসেন, সেদিন শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল না; ছিল সর্বব্যাপী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ। সামরিক স্বৈরশাসনের অন্ধকারে নিমজ্জিত স্বদেশে তিনি হয়ে ওঠেন আলোকবর্তিকা; অন্ধকারের অমানিশা দূর করতে আলোর পথযাত্রী।
১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশন। কাউন্সিলে জাতীয় ও দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয়। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন তিনি। একই বছরের ১৭ মে এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুুব্ধ, বৃষ্টিমুখর দিনে তিনি বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে। লাখ লাখ মানুষ তাকে সংবর্ধনা জানাতে সেদিন বিমানবন্দরে সমবেত হয়।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলেছিলেন স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়া। জেনারেল জিয়া সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন- 'মানি ইজ নো প্রবলেম' এবং 'আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ানস।' জেল-জুলুম-হুলিয়া, গুম-খুন ইত্যাদি ছিল তখন নিত্যকার ঘটনা। চারদিকে গড়ে তোলা হয়েছিল সর্বব্যাপী ভয়ের সংস্কৃতি। রাজনৈতিক নিপীড়নের মধ্যেই ১৯৭৭-এর ৩ ও ৪ এপ্রিল মতিঝিলের হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে কয়েক হাজার নেতাকর্মী সমবেত হয়। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় আহ্বায়ক কমিটি। দুঃসময়ের সেই দিনগুলোতে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের ভূমিকাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
১৫ আগস্টের পর থেকেই আমাকে প্রথমে গৃহবন্দি, পরে গ্রেফতার করে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন করে খুনিচক্র এবং ৫ সেপ্টেম্বর কারান্তরালে নিক্ষেপ করে। কারাজীবনের ২০ মাস ময়মনসিংহ এবং ১২ মাস কুষ্টিয়া জেলে ছিলাম। প্রায় ৩৩ মাস পর আমার ও শ্রদ্ধেয় আবদুুর রাজ্জাকের মুক্তির ব্যাপারে হাইকোর্টে রিট করলে প্রথমে রাজ্জাক ভাই এবং ৪ মাস পর '৭৮-এর ১২ এপ্রিল আমি মুক্তিলাভ করি। কারামুক্তির পর দলকে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করতে সারাদেশ চষে বেড়াই। দলের অভ্যন্তরে ছিল নানা রকম মতবিরোধ। সব ধরনের দলীয় মতানৈক্য দূর করে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী প্রাণপ্রিয় দল আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করে সামরিক শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত করতে আমরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করি।
১৯৮১-এর সম্মেলনে সবাই ধরে নিয়েছিল- আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা জীবন-পণ চেষ্টা করে সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে আওয়ামী লীগের ঐক্য ধরে রেখে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ওপর দলের নেতৃত্বভার অর্পণ করেছিলাম। যেদিন তিনি ফিরে এলেন সেদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মনে করেছিল, তারা শেখ হাসিনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকেই যেন ফিরে পেয়েছে। সম্মেলনের সমাপ্তি দিবসে সন্ধ্যার প্রাক্কালে সবার সিদ্ধান্ত অনুসারে আমি যখন দলীয় প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যার নাম প্রস্তাব করি, তখন তা সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়। সে কী আনন্দ-উচ্ছ্বাস, সে কী দৃশ্য! সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার নাম শুনে নেতাকর্মীরা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং বিপুল করতালির মাধ্যমে দলের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করে। শেখ হাসিনা সভানেত্রী; সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে শ্রদ্ধেয় আবদুর রাজ্জাক এবং আমি পুনর্নির্বাচিত হই। কাউন্সিল অধিবেশনের সার্বিক সাফল্য কামনা করে শেখ হাসিনা একটি বার্তায় সর্বপ্রকার দ্বন্দ্ব-বিভেদ ভুলে 'আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধি'র মাধ্যমে কাউন্সিলর ও নেতাদের বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি সোনার বাংলা বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে গণবিরোধী স্বৈরশাসকের ভিত কেঁপে উঠেছিল। '৮১-এর ১৭ মে দেশে ফিরে আসার আগে জেনারেল জিয়ার নির্দেশে 'শেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি' গঠন করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে এ ব্যাপারে সতর্ক ও সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছিলাম আমরা।
বিমানবন্দরে অবতরণের পর লাখ লাখ লোক তাকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়েছিল। সেদিন মনে হয়েছে- বঙ্গবন্ধুই যেন শেখ হাসিনার বেশে আবার আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন। আমরা যখন মানিক মিয়া এভিনিউতে যাই, রাস্তার দু'পাশে লাখ লাখ লোক। মঞ্চে উঠে তিনি শুধু ক্রন্দন করলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে হৃদয়ের আবেগ ঢেলে সেদিন বলেছিলেন, 'আজকের জনসভায় লাখো চেনামুখ আমি দেখছি। শুধু নেই প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাই, আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমি এসেছি। আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। আপনাদের ভালোবাসার আশা নিয়ে আমি আগামী দিনের সংগ্রাম শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা না পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের ভার সরকারের কাছে নয়; আমি আপনাদের কাছে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।'
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটানা ১৪ বছর দলের সাংগঠনিক সম্পাদক (তখন একজন সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল) হিসেবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবেও তার কাছে থেকে কাজ করেছি। এ ছাড়াও মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে তাকে কাছ থেকে দেখেছি। আমার বারবার মনে হয়েছে, যখন তার কাছে বসি বা কেবিনেট মিটিং করি বা সভা-সফর করি, তখন বঙ্গবন্ধুর কথা স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে। প্রিয় নেত্রী আওয়ামী লীগের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে দলকে সংগঠিত করেছেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে '৯৬-এ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে। আমি সেই মন্ত্রিসভার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলাম। কাছে থেকে দেখেছি দৃঢ়তা ও সক্ষমতা নিয়ে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। 'ইনডেমনিটি বিল' বাতিল করে সংবিধানকে কলঙ্কমুক্ত করে জাতির জনক হত্যার বিচার কাজ তিনি শুরু করেছিলেন। ২০০১-এ বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেই বিচার বন্ধ করে। আবার ২০০৮-এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে তিনি শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কাজই সম্পন্ন করেননি; মানবতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজও করে চলেছেন এবং ইতিমধ্যে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শেষে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরও হয়েছে। ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত ১০ বছরের বেশি আমরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে। এই ১০ বছরে শেখ হাসিনা দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর ভাষায়, বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি চমৎকার। এটা আন্তর্জাতিক বিশ্বের জন্য অনুসরণীয়-অনুকরণীয়। নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনের ভাষায়, সামাজিক-অর্থনৈতিক সর্বক্ষেত্রে আজ আমরা পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারত থেকেও আমরা এগিয়ে। অনেক বড় বড় প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমাপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করার পরও দৃঢ়তার সঙ্গে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে আজ তা সমাপ্তির পথে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বন্দর, গভীর সমুদ্রবন্দরসহ অসংখ্য উন্নয়নমূলক কাজ তিনি হাতে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এত উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে, যা এই ক্ষুদ্র লেখায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
২০০৮-এর নির্বাচনে রূপকল্প তথা ভিশন-২০২১ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং মধ্যম আয়ের দেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ স্বপ্ন নয়, বাস্তব। ইতিমধ্যে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছি এবং নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করেছি। ২০২১-এ যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে, তখন আমরা পরিপূর্ণভাবে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করব। এগুলো সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের কারণে। আজ আমরা দেখি, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করেছেন। আসলে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুসরণ করেছেন। কারণ বাংলার মানুষ যদি লক্ষ্য করে তবে দেখবে, '৯১ সালে তাদের কোনো রূপকল্প ছিল না, '৯৬ সালে রূপকল্প ছিল না; ২০০১ সালেও কোনো রূপকল্প ছিল না। ২০০৮-এর নির্বাচনেও তাদের কোনো রূপকল্প ছিল না। কিন্তু আজকে তিনি যে রূপকল্প ঘোষণা করেছেন, তা প্রকৃতপক্ষেই শেখ হাসিনাকে অনুসরণ করা। এই 'ভিশন-২০৩০'-এ তিনি এমন কিছু কথা বলেছেন, যা নিজেই বিশ্বাস করেন না। তবুও একটি রাজনৈতিক দল তার কর্মসূচি দিতে পারে। এ ব্যাপারে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু শেখ হাসিনা যা বিশ্বাস করেন, জাতির জনকের মতো তাই তিনি বলেন এবং বাস্তবায়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। জাতির পিতা দুটি লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আরেকটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন। অর্থনৈতিক মুক্তির কাজটি দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা করে চলেছেন। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। এটাই তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে আমার প্রত্যাশা।
লেখক- আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য