3260
Published on এপ্রিল 1, 2019মোহাম্মদ আরিফুল হকঃ
একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলার মাটিতে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা ছিল বিংশ শতাব্দীর নৃশংসতম গণহত্যা। পাকবাহিনীর পরিকল্পিত এ গণহত্যায় প্রাণ দিয়েছিল ৩০ লাখের অধিক মানুষ। সম্ভ্রম হারিয়েছিল ৫ লক্ষাধিক মা-বোন। ২৫ মার্চের গভীর রাতে ঘুমন্ত বাঙালীদের নিধনের মাধ্যমে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এ হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, দ্বীপাঞ্চল ভোলাতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী মে মাসে ভোলায় এলেও তাদের গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু হয় জুন মাসের দিকে। অগণিত নদী-খাল-ঝোপঝাড় সন্নিবেশিত ভোলা মহকুমা পাকিস্তানী বাহিনীর চলাচলের জন্য সহজগম্য ছিল না। ফলে ওয়াপদা কলোনিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে তাদের মূল হত্যা ও নির্যাতন কেন্দ্র। ওয়াপদা ভবন সুরক্ষিত ও তাদের মূল ঘাঁটি হওয়ায় সমগ্র ভোলা মহকুমা থেকে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে সেখানে বন্দী করে নির্যাতন ও হত্যা করা হতো এবং সহজেই লাশ ভাসিয়ে দেয়ার জন্য তারা ব্যবহার করত খেয়াঘাট (বর্তমান ভোলা লঞ্চঘাট)। পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় রাতের বেলা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে নারী-পুরুষদের ধরে নিয়ে আসত। এ দুটি স্থানে তারা কেবল ভোলা শহরের নয়, সমগ্র মহকুমা থেকে ধরে আনা মানুষদের হত্যা করত। ফলে একাত্তরে ভোলা মহকুমাবাসীর জন্য ওয়াপদা কলোনি ও খেয়াঘাট হয়ে উঠেছিল মৃত্যুপুরী।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভয়ে ভোলা শহরের বাসিন্দারা কেউ কেউ বাড়িতে থাকলেও রাতে কেউ-ই ঘরে থাকার সাহস পেত না। বিশেষ করে পরিবারের নারী সদস্যদের পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ও রাজাকারদের হাত থেকে বাঁচাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে রেখে আসত। মহকুমার বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে ওয়াপদা কলোনিতে নির্যাতনের পাশাপাশি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা শহর ও আশপাশে বসবাসরত পরিবারের নারীদের সন্ধ্যার পর জোরপূর্বক ক্যাম্পে নিয়ে যেত, নির্যাতন শেষে ফেরত পাঠাত। আবার কোন কোন পরিবারে পাকিস্তানী সৈন্যরা বিশেষ করে রাজাকাররা বাড়িতে গিয়ে নারী নির্যাতন করত, বহু সম্ভ্রান্ত পরিবারে রাজাকাররা ঘরে গিয়ে দিনের পর দিন নারীদের পাশবিক নির্যাতন করেছে। তাদের অত্যাচারে নিরুপায় হয়ে বহু পরিবার তাদের মেয়েদের সন্ধ্যার পর পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পে পাঠাতে বাধ্য হতো। ১০ ডিসেম্বর ভোলা মুক্ত হলে মুক্তিবাহিনীর একটি দল ওয়াপদা কলোনি থেকে ১৭ জন নারীকে বিধ্বস্ত অবস্থায় উদ্ধার করে।
ভোলায় পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর শুরুর দিকের গণহত্যাগুলো খেয়াঘাটেই সংঘটিত হতো। তারা খেয়াঘাটকে জলবধ্যভূমিতে পরিণত করে। সন্ধ্যা নেমে আসার পর খেয়াঘাট জনশূন্য হয়ে পড়তো। পাক হানাদার বাহিনীর নির্মমতার বর্ণনা দিতে গিয়ে একাত্তরে খেয়াঘাটের চা বিক্রেতা মোঃ আবদুল্লাহ বলেন, ‘রাত হলেই পাকিস্তানী আর্মিরা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধরে আনা মানুষগুলোকে হত্যা করার জন্য খেয়াঘাটে নিয়ে আসত। গাড়ির শব্দ শুনলেই আমরা দোকান ফেলে পালিয়ে যেতাম। তারা গাড়ি ভর্তি করে মানুষ নিয়ে আসত, এদের মধ্যে নারী-শিশু ও ছিল। খেয়াঘাটেই তারা নিরীহ মানুষগুলোকে নির্মমভাবে হত্যা করতো।’
যুদ্ধের শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বেড়ে গেলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী খেয়াঘাটের পরিবর্তে ওয়াপদা কলোনিতে সাধারণ মানুষকে হত্যা করত এবং গর্ত করে লাশ মাটি চাপা দিত। রাজাকার ও পাকিস্তানী বাহিনী যখন যাকে খুশি ওয়াপদাতে ধরে নিয়ে আসত। নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হয় তাকে কলোনিতে হত্যা করত অথবা রাতের আঁধারে ট্রাকে করে খেয়াঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করত। ওয়াপদা কলোনির পূর্ব-দক্ষিণে ছিল বিশাল লম্বা গর্ত। মানুষ জবাই করার জন্য ছিল জল্লাদ। এমনই এক জল্লাদ ছিল আবদুল্লাহ। যে নিজ হাতেই প্রায় ৩০০ জন নিরীহ মানুষকে জবাই করেছে। ওয়াপদা কলোনির গণহত্যা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী হাবিবুর রহমান বলেন. ‘ওহিদুল ইসলাম আমাকে মেসেজ পাঠায় যে ওয়াপদাতে ১৭ জন ইপিআর আটক আছে। এই সংবাদ পেয়ে আমি ওয়াপদার পেছনে পাতাবনের ভেতর দিয়ে গিয়ে যা দেখি তা ছিল অবিশ্বাস্য। শুধু লাশের স্তূপ! আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছবি তুলি এবং সে ছবি পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।’
জুন মাসের মাঝামাঝিতে বোরহানউদ্দিন থানার রাজাকাররা মণিমোহন দে ও নির্মলচন্দ্র দে নামে দু’জনকে মুক্তিবাহিনী হিসেবে চিহ্নিত করে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয়। পাক হানাদার বাহিনী ওয়াপদাতে নিয়ে নির্যাতন করে অর্ধমৃত অবস্থায় দু’জনকে খেয়াঘাটে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। অক্টোবর মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সংগ্রহকারী জোবেদ আলীকে ধরে ওয়াপদা কলোনিতে জবাই করে পাকিস্তানী নরপশুরা। একাত্তরে ওয়াপদা কলোনিতে বন্দী থাকা সরদার আবদুল কাদের বলেন, ‘যে কক্ষে আমাকে আটক রাখা হয় তার সামনে এক ফালি বারান্দায় একজন নারীকে কাঁদতে দেখি। আমাকে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে পাক হায়েনারা চলে যায়। সন্ধ্যা নেমে এলে একদল হানাদার বাহিনী এসে উক্ত নারীকে লাঞ্ছিত করে। আমি যখন বুঝতে পারলাম পাকিস্তানী সেনারা চলে গেছে তখন তাঁকে দরজা খুলতে অনুরোধ করলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর বহু কষ্টে তিনি দরজা খুলে দিলে আমার পরনের একটা কাপড় দিয়ে তাঁকে সম্ভ্রম রক্ষা করতে সাহায্য করলাম। পরে পাকিস্তানী সেনারা তাকে অন্যত্র নিয়ে যায়।’
দ্বীপ অঞ্চল ভোলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা শুধু গণহত্যা-নির্যাতন নয়, অগ্নিসংযোগ-লুটপাটও চালায়। মুক্তিবাহিনীর খোঁজে তারা বাড়িতে বাড়িতে হামলা করত। পরিবারের সদস্যরা মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে কোন তথ্য না দিলে ঘর থেকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যেত। মে মাসে পাকিস্তানী সেনারা ভোলায় আসার পর থেকে ১০ ডিসেম্বর ভোলা মুক্ত হওয়ার আগে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যু ও নির্যাতনের ভয়ে ভীত ছিল।
’৭১-এ ভোলা সদর ওয়াপদা কলোনি ও খেয়াঘাটে কত মানুষ হত্যা করা হয়েছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধরে এনে হত্যা করায় অনেকের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি, অনেকের লাশ ভেসে গিয়েছিল নদীর জলে। প্রত্যক্ষদর্শী, শহীদ পরিবার ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যমতে এ দুটি স্থানে প্রায় ১০০০ নিরীহ নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয়েছিল।
ওয়াপদা কলোনি-খেয়াঘাট গণহত্যা সম্পর্কে ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’ কর্তৃক প্রকাশিত গণহত্যা নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালায় ‘ওয়াপদা কলোনি-খেয়াঘাট গণহত্যা’ নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ গবেষণাগ্রন্থের গ্রন্থমালা সম্পাদক বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন এবং গ্রন্থটির লেখক বাংলা একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা রেহানা পারভীন, প্রকাশকাল বৈশাখ ১৪২৪/মে ২০১৭।
লেখক : গবেষণা কর্মকর্তা, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, খুলনা
প্রকাশঃ দৈনিক জনকণ্ঠ