9208
Published on মার্চ 19, 2019ড. মোহাম্মদ হাসান খানঃ
বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে ছোট্ট একটি গ্রাম, টুঙ্গিপাড়া। এই গ্রামে জন্ম নেন এক মহানায়ক। শুধু তা-ই নয়, জন্ম নেন একটি কিংবদন্তি, যার নাম শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি বাঙালির জন্য কাঁদতেন, ভালোবাসতেন। বটবৃক্ষ হয়ে ছায়া দিতেন তার জনগণ ও নেতাকর্মীদের। ছিলেন ’৭১-এর অনেক পিতৃহীন পরিবারের আশ্রয়। বীরাঙ্গনাদের তিনি দিয়েছিলেন মায়ের মর্যাদা, দিয়েছিলেন পিতৃপরিচয়। আর বাংলার জনগণ ছিল তার সন্তানের মতো, যাদের সুখ-দুঃখকে নিজের সুখ-দুঃখ, জনগণের অধিকার আদায়কে নিজের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ভাবতেন। বিনিময়ে নিজের জীবন দিতেও তিনি সদা প্রস্তুত ছিলেন। এ কারণেই পাকিস্তানিদের শত হুমকি, নির্যাতন তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন মাত্র ৫৪ বছর। এর মধ্যে ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি জেলে কাটিয়েছেন। তিনি ফাঁসিমঞ্চ দেখেও ভীত হননি, আপস করেননি পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে। তিনি বাংলার মানুষকে দিয়েছেন একটি ভূখ-, একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, বিশ্বের বুকে গর্বিত পরিচয়। স্বাধীন বাংলাদেশে দিয়েছেন স্বাধীনতা, জাতীয় সংগীত, সংবিধান। তিনি শিখিয়েছেন সংগ্রাম, অধিকার আদায়ের দৃঢ়তা, ন্যায়ের পথে মাথা উঁচু করে বাঁচা, অন্যায়ের কাছে হার না মানা। তাই তো তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক।
ভাগ্য আমাদের ভালো, তিনি এই ভূখণ্ডে জন্মেছিলেন। তা না হলে নিপীড়িত জাতি হিসেবে পৃথিবীর কাছে আমরা পরিচিত হতাম। পরাধীনতার গ্লানি ঘুচত না। বঙ্গবন্ধু না থাকলে মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনা সম্ভব হতো না। বঙ্গবন্ধু গবেষকরা মনে করেন, ‘বঙ্গবন্ধু ছিলেন আজীবন লড়াকু একজন মানুষ। শোষকদের রক্তচক্ষু তাকে পিছু হটাতে পারেনি। জেল-নির্যাতন তাকে গণমানুষের অধিকার আদায়ের পথ থেকে টলাতে পারেনি। কেননা তিনি মৃত্যুভয়ে ভীতু ছিলেন না, বরং বাঙালির জন্য জীবনদানে ছিলেন সদা প্রস্তুত।’ তিনি বলতেন, ‘আমি মানুষ, আমি বাঙালি, আমি মুসলমান। একবার মরে, বারবার না।’ মুসলমান হয়েও কিন্তু অন্য ধর্মের প্রতি, অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। তিনি জানতেন ধর্ম যার যার। কিন্তু রাষ্ট্র সবার। বঙ্গবন্ধু যতদিন বেঁচেছিলেন, ততদিন সব শ্রেণির মানুষের স্বাধীনতা রক্ষা, অধিকার আদায়ে কাজ করে গেছেন। তিনি এই উপমহাদেশে অন্যতম অসাম্প্রদায়িক উদারপন্থি নেতা ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বগুণ ও জনগণের প্রতি তার ভালোবাসা পৃথিবীবাসী দেখে বিস্মিত হয়েছে। কিউবার কিংবদন্তি নেতা ফিদেল কাস্ত্রো এ কারণে বলেছেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এ মানুষটি হিমালয়ের সমান। তাই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।’ আমাদের শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন হিমালয়ের চেয়েও বৃহৎ হৃদয়ের অধিকারী। ‘নিউজউইক’ ম্যাগাজিন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিল, ‘পোয়েট অব পলিটিকস’। ‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’ লিখেছে, ‘বঙ্গবন্ধু না থাকলে কখনই বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না।’ ‘টাইম’ ম্যাগাজিন বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করেছিল। এতে লেখা ছিল, ‘বাংলাদেশ : ফ্রম জেল টু পাওয়ার’। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ শেখ মুজিবকে ‘বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে তুলে ধরেছিল। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৭২ সালে সব প্রটোকল ভঙ্গ করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্থ হিথ বঙ্গবন্ধুর গাড়ির দরজা খুলে দেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর এমন বিস্ময়কর আচরণে অনেকে সমালোচনা করলেও তিনি এতে কান দেননি।
শেখ মুজিব স্বীকার করতেন, তার সবচেয়ে বড় শক্তি তার জনগণ। বড় দুর্বলতাও তার জনগণ। সব শ্রেণির মানুষকেই তিনি আপন করে নিয়েছিলেন। এ কারণে বাংলাদেশ গঠনের পর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সবাই প্রবেশ করতে পারতেন। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বঙ্গভবনে যেতে বললেও বঙ্গবন্ধু রাজি হননি। ১৫ আগস্টের কালরাতের অনেক আগেই বঙ্গবন্ধুকে ভারত সরকার সতর্ক করে জনিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তার জনগণকে এতই ভালোবাসতেন যে, তাকে কেউ হত্যার ষড়যন্ত্র করতে পারে, তা বিশ্বাস করেননি। ওই বিশ্বাসই তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। শত্রুরা যাকে হত্যা করতে পারেনি, সেই বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করল বাংলাদেশের বিপথগামী কতিপয় মানুষ! সৃষ্টি হলো বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর পাকিস্তানপন্থি প্রেতাত্মারা তার নাম চিরতরে মুছে দিতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। যার নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি, তার নাম উচ্চারণ করা এ দেশে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করা বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর নেতাকর্মীদের ওপর চলে হত্যা, নির্যাতন, জেল-জুলুম। কিন্তু ইতিহাস কথা বলে। যেসব কীট ’৭৫-এ জাতির জনকের নাম মুছে দিতে চেয়েছে, তাদের প্রতি ঘৃণা জানাই। তারা কি পেরেছে বঙ্গবন্ধুর নাম ও আদর্শকে মুছে দিতে? না, তা পারেনি। কারণ আদর্শকে হত্যা করা যায় না। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু থাকবেন। তিনি অজেয় মৃত্যুঞ্জয় মুজিব।
লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, চাঁদপুর জেলা।
প্রকাশঃ দৈনিক আমাদের সময়