7177
Published on মার্চ 19, 2019মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)
-
১৯৭১ সাল থেকে মার্চ মাস হয়ে আছে আমাদের স্বাধীনতার মাস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের মার্চ মাসে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে স্বাধীনতা অর্জনের পথ বাতলিয়ে দিয়েছিলেন। তার নির্দেশগত পথ ধরে মাত্র ৯ মাসের মাথায় আমরা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে সশস্ত্র যুদ্ধে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। তারপর ৪৮ বছর, আরেকটি মার্চ মাস আমরা অতিক্রম করছি। বঙ্গবন্ধুর হুকুমে ও নেতৃত্বে আমরা যারা সম্মুখসমরে যুদ্ধ করেছি, তাদের অনেকেই আজ আমাদের মধ্যে নেই। আমরা যারা বেঁচে আছি, তাদের মনে আনন্দ ও বেদনা দুটোই আছে।
যারা একাত্তরে যুদ্ধ ক্ষেত্রে শহীদ হয়েছেন তারাই সবচাইতে ভাগ্যবান। কারণ, তাদের পঁচাত্তর দেখতে হয়নি। তাদের দেখতে হয়নি এমন পরিবেশ যখন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেওয়া ছিল সবচাইতে বড় বিপদের কথা। তখন কতিপয় পদস্খলিত মুক্তিযোদ্ধা একাত্তরের পরাজিত শক্তি, যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বলতে যা কিছু বোঝায় তার সবকিছুকে ধ্বংস করার সংকল্প নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিল। এমন দৃশ্য শহীদদের দেখতে হয়নি বলেই তারা ভাগ্যবান। তাদের দেখতে হয়নি রাজাকার শিরোমণি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং সেটি করেছেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যাকারী মন্ত্রী হয়ে লাল সবুজের পতাকা গাড়িতে উড়িয়েছে, এমন অপমানজনক ও বেদনাদায়ক দৃশ্যের বোঝা শহীদদের বহন করতে হয়নি বলে আমি বলছি তারা অনেক ভাগ্যবান। চট্টগ্রামের এক কুলাঙ্গার যুদ্ধাপরাধী বিএনপির কৃপায় ২০০১-২০০৬ মেয়াদে মন্ত্রীর মর্যাদা পেয়ে কটাক্ষ সুরে জাতীয় পতাকাকে ইঙ্গিত করে প্রকাশ্যে বলে, ওই যে এক টুকরো কাপড় উড়ছে ওটা দেখতে আমার ভালো লাগে না। এমন স্পর্ধা শহীদদের সহ্য করতে হয়নি।
কিন্তু বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের এসব দৃশ্য দেখার বেদনা কোনো দিন ঘুচবে না। তাই মার্চ মাস এলেই মনে পড়ে কেমন বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করলাম আর জীবদ্দশায় কী দেখলাম, কী দেখছি এবং আগামীতে কী হতে চলেছে। এই ৪৮ বছরের উত্থান-পতনে কখনো কখনো হতাশায় পেয়ে বসলেও আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ভিতর যে অফুরন্ত অনুপ্রেরণার জায়গা রয়েছে তার ওপর ভর করে আমরা রাষ্ট্র হিসেবে যতদূর এগিয়েছি তাকে কিছুতেই কম বলা যায় না। পশ্চিমা বিশ্বের একজন খ্যাতিমান পণ্ডিত বলেছেন -The future is like a corrdior into which we can see only by the light falling from behind. তাই পেছনে থেকে আলো ফেলার উজ্জ্বল বাতিগুলো সচল থাকলে ভবিষ্যতের পথ চলায় আমাদের জন্য কোনো সংকট সৃষ্টি হবে না। সুতরাং মার্চ মাস হচ্ছে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বাতিঘর। একাত্তরের এই মাসে সমগ্র বাঙালি জাতি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গর্জে উঠেছে- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ জাতির পিতা বলেছেন, রক্ত যখন দিয়েছি, আরও দিব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।
৭ মার্চে রচিত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক মহাকাব্য। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। কত বড় আত্মবিশ্বাস তার মনে জন্মেছিল। পঁচাত্তরের পরে দুই সামরিক শাসক ও তাদের প্রতিভূদের দ্বারা বাংলাদেশে যা ঘটেছে তাতে তখন কি কেউ ভাবতে পেরেছে, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হবে, বাংলাদেশ উন্নয়ন ও জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনে রোল মডেল হবে। কিন্তু এসবই সম্ভব হয়েছে। বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। কারণ, মার্চ আমাদের সঙ্গে রয়েছে। যারা মার্চের এই অপ্রতিরোধ্য শক্তিকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল, সেই একাত্তরের পরাজিত ও পঁচাত্তরের পরে উত্থিত অপশক্তি আজ পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। এটা আমাদের জন্য কত বড় অর্জন তা একটু চোখ মেলে চারদিকে তাকালেই বোঝা যায়।
পঁচাত্তরের প্রতি বিপ্লবী গোষ্ঠী এত তাড়াতাড়ি পিছু হটবে তা ভাবা যায়নি। বিশ্বের ইতিহাসে দেখা যায় বিপ্লবের পর যদি প্রতিবিপ্লবীরা পুনরায় ক্ষমতায় আসে তাহলে তাদের কবল থেকে সহজে আর মুক্ত হওয়া যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি সম্ভব হয়েছে। এর প্রধান কারণ বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাঙালি জাতির নেতৃত্বে আবার এসেছেন। নিজের জীবনকে বাজি রেখে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আজ যে মর্যাদায় উঠিয়েছেন তাতে বঙ্গবন্ধুর অমোঘ বাণীর সত্যতা প্রমাণ হয়েছে, বাঙালিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
৪৮ বছর আগে দেওয়া ৭ মার্চের সেই ভাষণ শুনে আজও বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু থেকে বৃদ্ধের সব শরীরে আগুন জ্বলে ওঠে। সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার অফুরন্ত শক্তির উৎস ৭ মার্চের ভাষণ। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এমন একটা বিশাল অস্ত্র তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে আড়াল করে রাখা হয়েছে ২১ বছর, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত। জীবিত প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার কাছে জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারবেন, একাত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে সব গোলাবারুদের চাইতেও হাজার গুণ শক্তি জুগিয়েছে ৭ মার্চের ভাষণ এবং তার সঙ্গে জয় বাংলা স্লোগান। সুতরাং রাষ্ট্র হিসেবে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে আমাদের চলার পথের ধ্রুবতারা হিসেবে রাখতে হবেÑ ১৯৪৮-১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ছয় দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের ভাষণ এবং সর্বোপরি ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়। এসব ঘটনাবলির চাইতে উজ্জ্বল নক্ষত্র কি বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্য আর কিছু আছে, নাকি কোনোকালে ছিল? তাই এসব ধ্রুবতারার নির্দেশক পথ ধরেই আমাদের সর্বদা হাঁটতে হবে। জাতীয় সংকট ও সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে এসব উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলোকছটায়।
এসব ঘটনাবলির ভিতর থেকেই সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ। অন্য কোনো ঘটনার কেন্দ্র থেকে উৎপত্তি হওয়া অনুভূতিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা কোনোটাই বলা যাবে না। সুতরাং উপরোক্ত ঘটনাবলিকে যারা মূল্যায়ন করে না, তাদের মুখে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা মানায় না। গত ১০ বছরে প্রমাণিত হয়েছে একাত্তরের মার্চ মাসের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রচিত পথে অটুট থাকলে প্রকৃতপক্ষে বহুল আকাক্সিক্ষত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আমরা পাব। সেখানে ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সমান অধিকার পাবে। অন্ধগলির মধ্যে বাংলাদেশকে টেনে নেওয়ার সুযোগ ও সাহস কেউ পাবে না। বাংলাদেশের সব নাগরিক আধুনিক, প্রগতিশীল এবং বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার সুযোগ পাবে। সেই বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে। ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি বাংলাদেশে থাকবে না। ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি সংস্কৃতি হবে সব রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির মূল অবলম্বন। উগ্রবাদী জঙ্গিদের চাপাতির কোপে কারও জীবন প্রদীপ নিভে যাবে না।
এমন বাংলাদেশ সৃষ্টি ও তৈরি করার যাত্রা আমরা শুরু করেছিলাম একাত্তরের মার্চ মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। পথিমধ্যে কি ঘটেছে সেটি তো এখন আমরা সবাই জানি। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৪৮ বছরের মাথায় এসে বাংলাদেশ একটা মর্যাদার জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে নতুন প্রজন্মের মন-মানসিকতায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রথিত করা একান্ত প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর জীবনের আকাশসম গুণাবলি এবং পথ চলার দ্রুত বিশাল নির্দেশনা, এগুলো বাংলাদেশের জন্য তো বটেই, সারা বিশ্বের মানুষের কল্যাণ যদি উন্মুক্ত করা যায়, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে সেটাই হবে প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সঠিক ও উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন। তাতে বঙ্গবন্ধু হবেন বিশ্বজনীন। বিশ্ব অঙ্গনে মর্যাদা বাড়বে বাংলাদেশের। তাই এখনই উপযুক্ত সময়। বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও কর্মকে কেন্দ্র করে বিশ্বমানের একটা থিঙ্কট্যাংক ও থিমপার্ক তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন। সবার মনে রাখা দরকার বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না।
যুগে যুগে মহান নেতা ও মনীষীদের রেখে যাওয়া আলোর পথ ধরেই বিশ্ব সভ্যতা আজ এ পর্যন্ত এসেছে। বাংলাদেশের সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধু আমাদের রাষ্ট্রনায়ক। বিশ্বের অনেক বড় ও মহান নেতার জীবন ও কর্মের পথ বিশ্ববাসীর কাছে উন্মোচন করার জন্য তৈরি হয়েছে বিশ্বখ্যাত থিমপার্ক এবং থিঙ্কট্যাংক। সেখানে ওই রাষ্ট্রনায়কের প্রতিটি কর্ম ও চিন্তার ওপর গবেষণা হয়। গবেষণা লব্ধ ফলের সঙ্গে বর্তমান সময়ের সংযোগ ঘটিয়ে মানব সভ্যতার অগ্রগতির পথকে করা হয় গতিময় ও সমৃদ্ধশালী। বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও কর্ম সারা বিশ্বের মানুষের জন্য বিশাল সম্পদ ও পাথেয়। এই সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও চর্চায় বিশ্বসভ্যতা ও মানবতা যদি উপকৃত হয়, তাহলে সেটি হবে আমাদের জন্য বিরাট গৌরবের বিষয়। একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের পরে এক সময়ে মনে হয়েছিল সব বোধহয় বৃথা হয়ে গেল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের কথা সত্য হয়েছে। বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখা যায়নি।
গত ১০ বছরে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম আজ অপার সম্ভাবনার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পারছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির মাত্রা সর্বত্রই প্রশংসিত। বিশ্বের প্রায় অর্ধশত মুসলিম প্রধান দেশের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংবিধানের অন্যতম মৌলিক আদর্শ। মার্চ মাস আমাদের পথ দেখায়। একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং একাত্তরের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন। এগুলো সম্পর্কে যা কিছু বলতে চান তার সর্বাগ্রে আসবে শেখ মুজিবের নাম, যার নিজের জন্মদিনও এই মাসে, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। একটি মাসে এতসব গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলি বোধহয় বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নেই।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
প্রকাশঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন