3864
Published on মার্চ 19, 2019মোহাম্মদ আরিফুল হকঃ
‘সবুজ পূর্ব পাকিস্তানকে লাল রঙে রাঙাতে হবে’ রাও ফরমান আলীর এই আদেশই হয়তো বাংলা ভাষাভাষীকে সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম অপরাধের বলিতে পরিণত করেছিল। উত্তাল একাত্তরের ১৩ নবেম্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে এক নারকীয় গণহত্যার শিকার হয়েছিল বর্তমান রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর থানার অন্তর্গত হাতিয়া ইউনিয়নের সাধারণ জনগণ।
একাত্তরে কুড়িগ্রামবাসীর ভূমিকা ছিল অনন্য। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস জুড়ে কুড়িগ্রামের দুটি মুক্তাঞ্চলে প্রায় হাজার বর্গমাইল এলাকা শত্রুমুক্ত ছিল। দেশের মাটিতে প্রশিক্ষণ নিয়েই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী বাহিনীকে ঠেকিয়ে রেখেছিল অসীম সাহসী যুদ্ধ করে। মুক্তাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বেসামরিক প্রশাসন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মুক্তাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন ডাক, বিচার, রাজস্ব ও পুলিশ বিভাগ। এ কারণে কুড়িগ্রামের প্রতি পাকিস্তানী বাহিনীর বিশেষ নজর ছিল। এখানকার সাধারণ মানুষ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর শ্যেন দৃষ্টিতে পড়ে।
হাতিয়ার ইউনিয়নের গ্রামে গ্রামে বিশাল সংখ্যক মুক্তিবাহিনীর অবস্থান এবং এদের পেছনে রয়েছে ভারতীয় বাহিনী- এ রকম একটি সংবাদ দ্রুত বেগে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এ খবর রাজাকারদের কাছ থেকে পাওয়ার পরেই পাকিস্তানী বাহিনী হাতিয়া অপারেশনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। ৭ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ তুলে নিয়ে নিরাপদ অবস্থানে চলে যেতে বাধ্য হন এবং ঐ দিনই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দখল করে নেয় কুড়িগ্রাম শহর, শুরু হয় নির্বিচারে গণহত্যা। কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তান বাহিনী উলিপুরে ক্যাম্প স্থাপন করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় মুসলিম লীগ-জামায়াত চক্র এবং এরই ধারাবাহিকতায় হাতিয়া ইউনিয়নে ডা. বাবর আলীর নেতৃত্বে গঠিত হয় শান্তি কমিটি। এই বাবর আলীই পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের সুযোগে হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হন।
হাতিয়া গণহত্যার মূল স্থান দাগারকুটি গ্রাম, যার পূর্বে ধরলা নদী এবং পশ্চিমে অনন্তপুর বাজার ও হাতিয়া ইউনিয়ন কার্যালয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ৩২ দিন আগে স্থানীয় রাজাকার ও দালালদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী হাতিয়া অপারেশনের নামে নির্মম ও জঘন্যতম বর্বরতা চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে অগণিত নিরাপরাধ মানুষ। দিনটি ছিল ২৭ রমজান, ১৩ নবেম্বর, শনিবার। সেহরির ঠিক পরপর তখন মসজিদে আজানের ধ্বনি, শুরু হয়েছে নামাজ। হঠাৎ গগনবিদারী আওয়াজে চমকে ওঠে গ্রামের নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আকাশছোঁয়া আগুনের লেলিহান শিখায় ছাই হয়ে যায় পুরো গ্রাম। আগুন ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি বাড়িতে। পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে বাড়িঘর, গরু-ছাগল আর নিরীহ মানুষজন। যারা ঘর ছেড়ে বের হতে পারেনি তারা আগুনে পুড়ে গিয়েছিল, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। আর ঘর ছেড়ে যারা বের হতে পেরেছে, তারা প্রাণ হারিয়েছে পাকিস্তানী হানাদারদের গুলিতে। পুরো হাতিয়া ইউনিয়নে প্রায় দশঘণ্টাব্যাপী নজিরবিহীন গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায় পাকিস্তানী নরপশু ও তাদের এ দেশীয় দোসররা।
হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের পাশে অনন্তপুর বাজারে শোভা পাচ্ছিল সত্তরের নির্বাচনের ব্যানার-পোস্টার। আওয়ামী লীগের পোস্টার দেখা মাত্রই গুলি ছুড়তে থাকে পাকিস্তানী সেনারা। আশ্চর্যের বিষয় ছিল, ওইদিন শুধু পাকিস্তানী সেনারাই নয়, অস্ত্র চালিয়েছিল জামায়াতে ইসলামের নিজস্ব আধা-সামরিক বাহিনী আলবদর-আলশামস ও স্থানীয় রাজাকাররাও। পাশবিক নির্যাতন চালানো হয় হাতিয়া ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামের যুবতী-নারী ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের ওপর। বাগুয়া, অনন্তপুর, রামখানা, নয়াডোরা, নীলকণ্ঠ ও দাগারকুটি এবং আশপাশের কলাকাটা, জলংগারকুটি, ফকির মোহাম্মদগ্রামসহ কয়েকটি গ্রামেও হামলা করে পাকিস্তানী বাহিনী। হাতিয়া ইউনিয়নজুড়ে দীর্ঘ অপারেশনের পর পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় এক হাজার নিরপরাধ মানুষকে ধরে নিয়ে আসে। ধরে নিয়ে আসা এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে দাগারকুটি গ্রামে ধরলা নদীর তীরবর্তী একটি ডোবার কাছে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানী বাহিনী।
সেদিনের গণহত্যায় গুলি খেয়েও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বাবর আলী বলেন, ‘সেদিন সকালে পাকিস্তানী বাহিনী অনন্তপুর বাজার ও গ্রামের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। অনন্তপুর বাজারে পাকিস্তানী বাহিনী বলছে- জ্বালাও, আগ লাগাও, কাহাহে মুক্তি, খোঁজো। তারা যাকেই সামনে পাচ্ছে তাকেই গুলি করছে। আমি বাড়ির পাশের ঝোপে লুকানোর চেষ্টা করলেও পরে তাদের হাতে ধরা পড়ে যাই। আমার বাড়িতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টাঙানো ছিল, খানসেনারা বঙ্গবন্ধুর ছবিতে গুলি করে ও ছবিটি মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে লাথি মারতে থাকে।’
সেদিন কিছু লাশ প্রিয়জনরা দাফন করলেও অনেকের লাশ ভেসে গিয়েছিল ধরলা নদীর জলে। একই গর্তে অনেক লাশ মাটি চাপা দেয়া হয়। অনেকে গুলি খেয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন। এ গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ণনা মতে সেদিন পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে প্রায় সাত-আটশত মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। এদের মধ্যে ৪১৪ জনের নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়।
হাতিয়া ইউনিয়নের গণহত্যা সম্পর্কে ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’ কর্তৃক প্রকাশিত গণহত্যা নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালায় ‘হাতিয়া গণহত্যা’ নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ গবেষণা গ্রন্থের গ্রন্থমালা সম্পাদক বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন এবং গ্রন্থটির লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক মিঠুন সাহা, প্রকাশকাল ফাল্গুন ১৪২১/মার্চ ২০১৫।
লেখক : গবেষণা কর্মকর্তা, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, খুলনা
প্রকাশঃ দৈনিক জনকণ্ঠ